২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাদাজলে পুতিন, উদ্ধার করবে কে

কাদাজলে পুতিন, উদ্ধার করবে কে - ফাইল ছবি।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আমেরিকান লেখক হেনরি ডেভিড থোরিও তার এক বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেছেন, বেশির ভাগ মানুষই বেপরোয়া স্বভাবের হয়ে থাকে। এই বেপরোয়া স্বভাব পুতিনকেও গ্রাস করতে যাচ্ছে। যেমন, এখন তিনি নিজের তৈরি ইউক্রেন যুদ্ধের ফাঁদ থেকে বের হওয়ার কোশেশ করছেন।

রাশিয়ার গর্ব মস্কোভা বিপর্যয়ে হতবাক পুতিন তার বিশেষ সামরিক অভিযান নিয়ে রহস্যজনক নীরবতা পালন করেন। দীর্ঘ অচলাবস্থা তার কাম্য ছিল না, মস্কোতে গাড়িবোমা বিস্ফোরণের প্রত্যাশাও তিনি করেননি। অপমানজনক এবং পিলে চমকে দেয়ার মতো ক্রাইমিয়া দুর্গ আক্রমণও তার কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।

নিদেনপক্ষে পুতিন কি আশা করেছিলেন যে তার ৮০ হাজার জওয়ান হতাহত হবে? তার সাথে পুতিনের ‘গ্রেটার রাশিয়া’ নামের অলিক-অবাস্তব স্বপ্নও ম্লান হয়ে গেছে। তার অর্জিত সব সুনাম লুপ্ত, তবে হত্যাকারী এবং শান্তি-বিনাশী তকমাটা সমুজ্জ্বল।

চোরাবালিতে আটকে গেলে তার চলবে না, কেননা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার তুষের আগুনে ক্ষয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি ও সামরিক জনবল, ফুরিয়ে আসছে রসদ। অতএব তার করণীয় কী?

তিনি এই বলে আত্মতুষ্টির বিজয় ঘোষণা করে বলতে পারেন যে, ন্যাটোর হুমকি প্রশমিত। অধিকৃত এলাকাগুলো হজম করার জন্য তিনি একটা সমঝোতা চাইবেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত জানেন যে, কিয়েভ স্বেচ্ছায় এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হবে না। উস্তাদ বাজিগর হিসাবে তিনি উত্তরের বেলারুশ-ইউক্রেন সীমান্তে দ্বিতীয় ফ্রন্ট চালুর জন্য তার একান্ত অনুগত ভৃত্যসম আলেকজান্ডার লুকোশেঙ্কোকে লেলিয়ে দিতে পারেন যা তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে দখল করতে গিয়ে প্রচণ্ড মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসেন। তবে মি. লুকোশেঙ্কোর জেনারেলদের সে মুরোদ আছে কি না তা নিয়ে সমরবিদদের মধ্যে সংশয় আছে। পলায়ন করাটা তার জন্য সহজ নয়। অচলাবস্থা নিরসনের জন্য তার ওপর চাপ বাড়তে থাকলে তিনি ইউক্রেনকে সমর্থন দানকারী ইউরোপীয়ান দেশগুলোর ওপর যুদ্ধের বোঝা বাড়ানোর মাধ্যমে কিয়েভের প্রতিরোধ স্পৃহায় পানি ঢালার চেষ্টা করবেন।

ইতোমধ্যে তিনি তা শুরু করেছেন। যুদ্ধের কারণে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের জনগণ জ্বালানি খরচ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। এটা নিয়ে সবাই চিন্তিত। আসন্ন শীত মৌসুমে, শীতলতম শীতল যুদ্ধে ইউরোপ থমকে যেতে পারে।

ঐক্যবদ্ধ ইউরোপে ফাটল তৈরিতে তিনি সিদ্ধহস্ত, তার আছে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার অনেক উপায়-অবলম্বন এবং ফন্দি-ফিকির। উত্তরাধিকার সূত্রে সোভিয়েট আমল থেকেই ইউরোপ বিবিধ ভূ-রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। আশ্চর্যজনক হলেও রাজনৈতিকভাবে দ্বিধা-বিভক্ত ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার অনেক মিত্র ও সমর্থক রয়েছে।
তার পশ্চিমের বন্ধুরা কি প্রাচ্যের ধেয়ে আসা মূর্তমান আতঙ্ক থেকে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবেন? ইতোমধ্যে তিনি একনায়ক লুকেশেঙ্কোকে পকেটে পুরেছেন। ২০২০ সালের জালিয়াতির নির্বাচনে জয়ী লুকেশেঙ্কোকে ব্যাপক গণবিক্ষোভ থেকে রক্ষা করতে পুতিন সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন এবং তার গদি টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। পুতিনের নির্দেশে মি. লুকেশেঙ্কো খাপ থেকে তলোয়ার বের করে তার ক্যারিশমা দেখাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

পুতিনের ‘ট্রোজান ঘোড়া’ হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান শাখের করাত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পেটের ভেতর অবস্থান করছেন। ইউরোপের অন্যান্য উগ্র ডানপন্থীদের মতোই তিনি অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদ ছড়াতে ব্যস্ত। রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা আরোপে তিনি বারবার বাধা সৃষ্টি করেন। গত মাসে তিনি রাশিয়ার সাথে এককভাবে গ্যাস ক্রয়ের চুক্তি করেন। পশ্চিমারা তাকে বিশ্বাস করে না। পুতিনের ইন্ধনে গত জুনে বুলগেরিয়ার সংস্কারবাদী সরকারের পতন এবং এর ধারাবাহিকতায় মস্কোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা ইউরোপের বিভাজনকে সুস্পষ্ট করে তুলছে।

ইটালিতে পুতিনের বহু সমর্থক রয়েছে। সামনের নির্বাচনের পর কোয়ালিশন সরকার প্রত্যাশী দু’টি ডানপন্থী দলের নেতাদের সাথে মস্কোর দীর্ঘদিনের সখ্য রয়েছে। ২০১৭ সালে পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়ার সাথে ম্যাটিও সালভিনির লীগ জোট গঠন করেছিল। ফোরজা ইটালিয়ার সিলভিও বার্লুসকোনির সাথেও পুতিনের ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইটালির ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগি ইউক্রেনের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।

উগ্র ডানপন্থী ও অতি বামপন্থী বিপ্লবী দলগুলো পুতিনীয় মতাদর্শে এবং রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধে একই সুরের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা প্রয়োগ করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে তারা পুতিনের ভাষায় কথা বলেন। ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের সুনির্দিষ্ট এক পর্যালোচনায় জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং বেলজিয়ামের উগ্রপন্থী দলগুলোকে রাশিয়াপন্থী বলে শনাক্ত করা হয়। যুক্তরাজ্যের ইউকিপও এদের দলে।

দলগুলো ক্রেমলিন প্রণীত নীতির বৈধতার জন্য কাজ করে এবং রাশিয়ার হয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। মাঝে মাঝে তারা ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বিতর্ককে রাশিয়ার অনুক‚লে নেয়ার চেষ্টা করে। পুতিনের জগতে এই ধারাগুলো অতি সম্ভাবনাময়।

পুতিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে মূলধারার রাজনীতিবিদ এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল সার্বিয়ান প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভেসেকের উপরেও ভরসা করতে পারেন। বিরোধীরা তাকে ‘ক্ষুদে পুতিন’ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। ভ্লাভিক জাতিগোষ্ঠীভুক্ত সার্বিয়ার সাথে রাশিয়ার ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে; উভয়েই ন্যাটোবিদ্বেষী। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর বেলগ্রেড বোমাবর্ষণের কথা তারা কি ভুলে যাবে?

যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এই ভেবে শঙ্কিত যে, বিশ্বের মনোযোগ অন্য দিকে ডাইভার্ট করার জন্য পুতিন অস্থিতিশীল পশ্চিম বলকান অঞ্চলকে বেছে নিতে পারেন।

জাতিগত সার্বিয়ানদের ক্ষোভের কারণে কসোভো পুনরায় অশান্ত হয়ে উঠছে। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেসান্দার ভেসেক আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের বিপক্ষে হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড থেকে আমাদের লোকজনকে ন্যাটো রক্ষা করতে এগিয়ে না এলে আমরাই তা করব।’ মস্কোর সাথে ঘনিষ্ঠ বসনিয়ার সার্ব নেতারা পুনরায় হুমকি-ধামকি শুরু করেছেন।

নিজেদের মাটিতে রুশ সৈন্যের উপস্থিতিতে বিভক্ত মলদোভা এবং জর্জিয়াও সম্ভাব্য কনফ্লিক্ট জোনে। এ মাসে পুতিন জাতিগত সংখ্যালঘু রুশদের অধিকার রক্ষার অজুহাতে ন্যাটো প্রতিবেশী এস্তোনিয়াকে ভয় দেখানোর জন্য ইউরোপের কেন্দ্রেস্থলে অবস্থিত রুশ ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছেন।

পুতিন সৃষ্ট ভয়, অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক চাপের কথা চিন্তা করে ইউরোপের বাইরের দেশগুলোও তার বিরুদ্ধাচরণের আগে অন্তত দু’বার ভাবেন। তার ভেটো জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে প্রায়ই অকার্যকর করে দেয়। এবার তিনি শি জিনপিংকে সাথে নিয়ে নভেম্বরে বালিতে অনুষ্ঠিতব্য মহামারী-উত্তর গুরুত্বপূর্ণ জি-২০ সম্মেলনে ইউক্রেন ইস্যুকে পশ্চিম বনাম অবশিষ্ট বিশ্বের শো-ডাউনে পরিণত করার পাঁয়তারা করছেন। তার যুক্তিগুলো অন্তঃসারশূন্য এবং অসত্য তথ্যভিত্তিক।

দখলকৃত জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে পুতিনের ছেলেখেলা এটাই প্রমাণ করে যে, জেতার জন্য তিনি যেকোনো কিছু করতে পারেন। দিনে দিনে তিনি আরো বেশি ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠছেন।


আরো সংবাদ



premium cement