০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভুল বোঝাবুঝি দূর করুন

-

যদি কেউ কোনো ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি যেন তার ভুল বোঝাবুঝি দূর করে ফেলেন। যারা গাজাকে খড়কুটোর স্তূপ বানাতে চায়, তাদের নজর গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিবদ্ধ। তাদের ‘ওপরওয়ালা’ সৌদি আরব ও ইরান থেকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান পর্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশের সীমানা বদলে দেয়ার পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছে। আরব দেশগুলো ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে দেখল, ইসরাইলের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর জুলুম-নির্যাতন কোনোক্রমে হ্রাস পায়নি। ২০২১ সালের রমজানুল মোবারকে ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে গাজা পর্যন্ত তার পাশবিক শক্তি যেভাবে প্রয়োগ করেছে, তার পরে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা বলা মূলত ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় অপরাধে শরিক হওয়ার নামান্তর। ইসরাইলি রাষ্ট্র সেলফ ডিফেন্সের নামে গাজায় ছোট্ট ছোট্ট শিশুর বস্ত্রখণ্ড উড়িয়ে বহু ইহুদিকেও ইসরাইলের নিন্দা করতে বাধ্য করেছে। লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় আমরা অনেক অর্থোডক্স ইহুদি নেতাকে মুসলমানদের সাথে মিলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে স্লোগান দিতে দেখতে পেয়েছি। ইসরাইলি জুলুমের নিন্দায় শুধু মুসলমানই নয়, বরং খ্রিষ্টান ও ইহুদিরাও সামনের সারিতে রয়েছেন। ইসরাইলের ভেতরও এমন মানুষ আছে, যারা জায়নবাদী চিন্তাভাবনার বিরোধী। সময় এসেছে, জায়নবাদী ও ইহুদি হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আমাদের অনুধাবন এবং ইসরাইলি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ইহুদিদের সাথে মিলে বিশ্বজুড়ে জায়নবাদী পরিকল্পনাকে স্পষ্ট করার। ইসরাইল এমন একটি একমাত্র রাষ্ট্র, যা ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এখন পর্যন্ত ওই রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট সীমানার ফায়সালা হয়নি।

ইসরাইল ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময়কালে তাদের সীমানা পরিবর্তন করেছে। কয়েক বছর ধরে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলি পদদলিত করে আবারো নিজেদের ভৌগোলিক সীমানা বৃদ্ধি করছে। ইসরাইলের এই নীতিকে ভারতে মোদির সরকারও অনুসরণ করেছে এবং জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলির বিরুদ্ধাচরণ করে ৫ আগস্ট, ২০১৯-এর পর থেকে তাদের অধিকৃত জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে সংখ্যালঘুতে বদলে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। তবে বর্তমানে ওই পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, করোনাভাইরাস। কী বিস্ময়কর কাকতালীয় মিল! অতীতে যে শক্তিগুলো পাকিস্তানের ওপর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে, এখন সেই শক্তিগুলোই চাচ্ছে যে, পাকিস্তান যেন আলোচনার নামে ভারতের সামনে কাশ্মির বিষয়ে আত্মসমর্পণ করে; যাতে আগামীকালই ভারত কাশ্মির উপত্যকায় সেটাই করতে পারে, যা ইসরাইল আজ গাজায় করছে।

পাকিস্তান ইসলামী দুনিয়ার একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে, যখন পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির দেশ ছিল না, তখন পাকিস্তানের প্রভাব ছিল বেশি। পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র এই অঞ্চলে বিদেশী শক্তিগুলোর সহায়তাকারী হয়ে গেছে। এর ভিত্তিতে সর্বদা কোথাও না কোথাও থেকে ‘ডু মোর’-‘আরো করো’র চাপ থেকেই যাচ্ছে। ভালো কথা হচ্ছে, ইমরান খানের সরকার এখন পর্যন্ত ইসরাইলের ব্যাপারে সেই নমনীয়তা প্রদর্শন করেনি, কিছু ইসলামী বন্ধুরাষ্ট্র তার কাছে যেটা আশা করছিল। ইমরান খানের সাথে শত মতানৈক্য পোষণ করুন, কিন্তু ইসরাইলের ব্যাপারে তার অবস্থান শুধু পাকিস্তান নয়, বরং সারা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করছে। এখন পর্যন্ত তিনি শুধু ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে যাচ্ছেন এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন। নিন্দা জ্ঞাপনের চেয়ে তিনিও বেশি কিছু করতে পারেননি। কেননা ভুট্টোর পরিণাম তিনি ভোলেননি। এ যুগের যুবসমাজ প্রতিটি নির্বাচনে ‘ভুট্টো বেঁচে আছেন, ভুট্টো বেঁচে আছেন’ স্লোগান শোনে, পিপলস পার্টির বর্তমান নেতারা তাদের এ কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যখন ১৯৭৩ সালের রমজানুল মোবারকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়, তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলটদের সিরিয়া ও জর্দান পাঠিয়েছিলেন। এই বিমানযোদ্ধারা কয়েকটি ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করেন। ওই যুদ্ধে উত্তর কোরিয়াও তাদের ২০ জন পাইলটকে মিসর পাঠিয়েছিল। সৌদি আরব, কুয়েত, মরক্কো, লেবানন ও সুদান তাদের বাহিনীকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাঠিয়েছিল। আমেরিকা প্রকাশ্যে ইসরাইলের সাহায্য করে। আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের দখলদারিত্ব থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করতে পারেনি, তবে আরবরা প্রথমবারের মতো ‘তেলের অস্ত্র’ তখন ব্যবহার করে। এই যুদ্ধের কিছু দিন পর ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে লাহোরে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানদের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। ওই কনফারেন্সে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি একই বিমানে লাহোর পৌঁছেন। পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতকে কুয়েতের আমির তার বিমানে করে নিয়ে আসেন। সিরিয়ার সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ ও সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল ভুট্টোসহ একসাথে লাহোরের বাদশাহী মসজিদে বায়তুল মুকাদ্দাসের স্বাধীনতার জন্য দোয়া করেছিলেন। পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির সামনে একটি মিনার আজো ওই মহান কনফারেন্সের স্মারক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওই কনফারেন্সের পর একের পর এক বাদশাহ ফয়সাল, ভুট্টো ও আনোয়ার সাদাত ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন। ইসরাইল আলোচনার নামে আরবদের বিভক্ত করে এবং পরস্পরের মধ্যে লড়াই বেশ বাধিয়ে দেয়। পাকিস্তান যখন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ছিল না, তখন ইসরাইলি আগ্রাসনকে হুমকি দেয়ার যোগ্যতা রাখত। ভুট্টোর ফাঁসির পর এমনটি আর হয়নি। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী বানানো, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও আজ দেশান্তরে। ইসরাইলের নিন্দা তো সবাই করে, কিন্তু আমাদের নেতৃবৃন্দের সবাই ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সাহস হারিয়ে ফেলেছেন।

যারা আমাদের ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ দেন, তাদের কাছে আবেদন, জায়নবাদী চিন্তার পেছনে লুকিয়ে থাকা গ্রেটার ইসরাইলের পরিকল্পনাকে অনুধাবন করুন। যেভাবে হিন্দু উগ্রবাদীরা গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে ‘অখণ্ড ভারত’ বানাতে চাচ্ছে, অনুরূপভাবে জায়নবাদী উগ্রপন্থীরা নীল উপত্যকা থেকে নিয়ে ফোরাত নদী পর্যন্ত এক ‘গ্রেটার ইসরাইল’ গঠনের লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছে। ওই গ্রেটার ইসরাইলের মধ্যে জর্দান, সিরিয়া ও সৌদি আরবের অনেক অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত।

জায়নবাদী উগ্রপন্থার একজন সমর্থক ও মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল র‌্যালফ পিটার্স বহু বছর আগে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ছক প্রকাশ করেছিলেন। তার নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে পাকিস্তানের সীমান্তগুলোকেও বদলে দেয়া হয়েছে। পিটার্সের মানচিত্র অনুযায়ী- তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান ও ইরাকের কুর্দ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে ‘কুর্দিস্তান’ গঠন করা হবে। ইরাককে শিয়া-সুন্নির ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র বানিয়ে দেয়া হবে। সৌদি আরবের কিছু অঞ্চল জর্দান ও ইয়েমেনের মধ্যে যুক্ত করে দেয়া হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল ইরাকি শিয়া রাষ্ট্রে যুক্ত করা হবে।

আফগানিস্তানের কিছু অঞ্চল ইরানকে দিয়ে দেয়া হবে। ইরানের কিছু অঞ্চল আজারবাইজানকে দেয়া হবে। পাকিস্তানের ভেতর স্বাধীন বেলুচিস্তানের নামে নতুন রাষ্ট্র গঠন করা হবে এবং পাখতুন অঞ্চলকে আফগানিস্তানে যুক্ত করে দেয়া হবে। বাহ্যত এটা একটা ‘পাগলের স্বপ্ন’। এর বাস্তবায়ন কঠিন। তবে গ্রেটার ইসরাইলের কল্পনা জায়নবাদী সাহিত্যে বিদ্যমান রয়েছে। ইসরাইলের পক্ষ থেকে পূর্ব জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি বসতিকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের চেষ্টা কারো কাছে গোপন নেই। ইসরাইলের ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তা আজো সঠিক। ইসরাইল ও ভারতের উগ্রপন্থী নেতৃত্ব বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কেউ এ ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা এখনই দূর করে ফেলুন।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৭ মে, ২০২১ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় সহযোগিতার জন্য ওআইসি সদস্যদের প্রতি আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাফা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেয়ার আদেশে হামাসের প্রতিক্রিয়া হিলি বন্দর দিয়ে ১৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর : মন্ত্রী রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় ওআইসি’র সহযোগিতা চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টর্চার সেলে শিশু-বৃদ্ধদের পেটাতেন মিল্টন : হারুন গাজা ত্যাগ করবে না ইউএনআরডব্লিউএ শৈলকুপায় সাংবাদিক মফিজুলের ওপর হামলা : প্রেসক্লাবের উদ্যোগে মানববন্ধন বিএনপির ভাবনায় ক্লান্ত ওবায়দুল কাদের : রিজভী অনলাইন জুয়ায় ২০ লাখ টাকা হেরে যুবকের আত্মহত্যা আল-জাজিরার অফিসে ইসরাইলি পুলিশের হানা

সকল