০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান

শুরু হলো বাঙালিদের দুঃখের দিন

- ছবি : সংগৃহীত

এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হলো। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনো দিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। ঠিক মনে নাই, তবে দুই-তিন দিন পরে আমাকে আবার নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হলো। নিরাপত্তা আইনে বন্দীদের বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকতে হয়। সরকার ভাবল, যে মামলায় আমাকে গ্রেফতার করেছে, তাতে জামিন হলেও হয়ে যেতে পারে; তাই নিরাপত্তা আইনে তাদের পক্ষে সুবিধা হবে আমাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা। কী মামলায় আসামি করেছে আমার তা মনে নাই। আমি নাকি কাউকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছি বা লুটপাট করতে উসকানি দিয়েছি। খবর নিয়ে জানলাম, জেলগেটে একটা গোলমাল হয়েছিল- আমি মন্ত্রী হওয়ার সামান্য কিছুদিন পূর্বে, সেই ঘটনার সাথে আমাকে জড়িয়ে এই মামলা দিয়েছে।

একদিন আমি আওয়ামী লীগ অফিসে ইফতার করছিলাম । ঢাকায় রোজার সময় জেলের বাইরে থাকলে আমি আওয়ামী লীগ অফিসেই কর্মীদের নিয়ে ইফতার করে থাকতাম। হঠাৎ টেলিফোন পেলাম, চকবাজারে জেল সিপাহিদের সাথে জনসাধারণের সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়ায় জেল সিপাহিরা গুলি করেছে। একজন লোক মারা গিয়েছে এবং অনেকে জখম হয়েছে। ঢাকা কারাগার চকবাজারের পাশেই। হক সাহেব মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, আমি তখনও মন্ত্রী হই নাই। আমি আতাউর রহমান সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তার বাসা চকবাজারের কাছে। তিনিও খবর পেয়েছেন, আমাকে তার বাসায় যেতে বললেন। দরকার হলে একসাথে চকবাজার ও জেলখানায় যাওয়া যাবে। আমি পৌঁছার সাথে সাথে দু’জনে দ্রুত চকবাজারে পৌঁছালাম। অনেক লোক জমা হয়ে আছে এবং তারা খুবই উত্তেজিত। আমরা উপস্থিত হলে তারা আমাদের ঘিরে ফেললো এবং সকলে একসাথে চিৎকার করতে শুরু করল। সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়, কী ঘটনা ঘটেছে জানাতে। আমরা যখন তাদের অনুরোধ করলাম, এক একজন করে বলতে, তখন তারা একটু শান্ত হলো এবং ঘটনাটা বলল। একজন ওয়ার্ডারের সাথে এক পানের দোকানদারের কথা কাটাকাটি এবং পরে মারামারি হয়। এই অবস্থায় দু-চারজন ওয়ার্ডারও হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডারের পক্ষ নেয়, আর জনসাধারণ দোকানদারের পক্ষ নেয়। সিপাহিরা একটু বেশি মার খায়। তারা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে রাইফেল এনে গুলি করতে শুরু করে। এতে অনেক লোক জখম হয় এবং তিনজন আহত লোককে ধরে জেল এরিয়ার ভিতরে নিয়ে যায়। অনেক লোক তখন জমা হয়েছে। আমরা দুইজনই তাদের শান্ত হতে বলে জেলগেটের দিকে রওয়ানা করেই দেখতে পেলাম, সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া (তখন মন্ত্রী) খবর পেয়ে এসেছেন। তার সাথে একজন বিশিষ্ট সরকারি কর্মচারী আছেন। আমরা একসাথে জেলগেটের ভিতরে পৌাঁলাম। সেখানে জেল সুপারিনটেনডেন্ট ও জেলারের সাথে আলাপ হলো। এ সময় আরও দু-একজন মন্ত্রী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডিভিশনাল কমিশনার এসে হাজির হয়েছেন। জনসাধারণ মন্ত্রীদের ও আমাদের দেখে একদম জেলগেটের সামনে এসে জড়ো হয়েছে। হাজার হাজার লোক চিৎকার করতে আরম্ভ করেছে।

ঢাকা জেলে তখন একজন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট ছিল, তার নাম মিস্টার গজ। সত্যি কি না বলতে পারি না, তবে জনতা ‘গজের বিচার চাই’, ‘গজ নিজে গুলি করেছে’ ইত্যাদি বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে। গজের বাসা জেলগেটের সামনেই। কে যেন বলে দিয়েছে, এটা গজের বাড়ি। জনতা গজের বাড়ি আক্রমণ করে ফেলেছে। যারা উপস্থিত ছিলেন- মন্ত্রী, নেতা এবং সরকারি কর্মচারী তারা আমাকে অনুরোধ করল বাইরে যেতে এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে, একজন আর্মড পুলিশও এক ঘণ্টা হয়ে গেছে, এসে পৌঁছায় নাই। আমি বাইরে যেয়ে জনতার মোকাবেলা করলাম। নিজের হাতে অনেককে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে নিবৃত্ত করলাম। কর্মীদের নিয়ে মি. গজের বাড়ির বারান্দা থেকে উন্মত্ত জনতাকে ফেরত আনলাম। একটা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করলাম গোলমাল না করতে, শান্তি বজায় রাখতে। বললাম, সরকার বিচার করবে অন্যায়কারীর। মাইক্রোফোন নাই। গলায় কুলায় নাই । আবার গজের বাড়ির দিকে জনতা ছুটেছে। আবার আমি কর্মীদের নিয়ে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাড়ি রক্ষা করলাম। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীও তখন। পৌঁছে গেছে। আমি যখন লোকদের শান্ত করে জেলগেটের দিকে ফেরাই, ঠিক সেই সময় আইজিপি দোহা সাহেব কয়েকজন পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন। তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন এবং বললেন, “আপনি গ্রেফতার।” আমি বললাম, “খুব ভাল।” জনতা চিৎকার করে উঠে এবং আমাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। আমি তাদের বোঝাতে লাগলাম। আবার দুই-তিন মিনিট পরে দোহা সাহেব ফিরে এসে বললেন, “আপনাকে অন্ধকারে চিনতে পারি নাই। ভুল হয়ে গেছে। চলুন জেলগেটে যাই।” আমি তার সাথে জেলগেটের ভিতরে পৌঁছালাম এবং বললাম, “প্রায় দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে গোলমাল শুরু হয়েছে, আপনি এখন পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছেন। এতক্ষণ পর্যন্ত শান্তি রক্ষা আমাদেরই করতে হয়েছে। যা ভালো বোঝেন করেন আমার কি প্রয়োজন। লালবাগ পুলিশ লাইন থেকে জেলগেট এক মাইলও হবে না, আপনার পুলিশ ফোর্স পৌঁছাতে এত সময় লাগল।” আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। জনতা একেবারে জেলগেটের সামনে এসে পড়েছে। আমরা দেখলাম, এক পুলিশ লাঠিচার্জ বা গুলি করতে আরম্ভ করবে। কেউই জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে না। সরকারি পাবলিসিটি ভ্যানও আসতে বলা হয় নাই যে মাইক্রোফোন দিয়ে বক্তৃতা করে লোকদের বোঝানো যায়। খালি গলায় চিৎকার করে কাউকেও শোনানো যাবে না। যারা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের রুমে বসেছিলেন তাদের বলে জনতাকে নিয়ে এক মিছিল করে রওয়ানা করলাম। আমাদের অনেক কর্মীও বাইরে ছিল। আমি বাইরে এসে জনতাকে বললাম, “চলুন এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করার জন্য মিছিল করা যাক।” আমি হাঁটা দিলাম। প্রায় শতকরা সত্তরজন লোক আমার সাথে রওয়ানা করল। আমি সদর ঘাট পর্যন্ত দেড় মাইল পথ এদের নিয়ে এলাম।

আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে পরের দিন পল্টন ময়দানে এক সভা করব ঘোষণা করলাম। এটা খুবই অন্যায়, জেল ওয়ার্ডার কেন জেল এরিয়ার বাইরে যেয়ে গুলি করবে? আর কার অনুমতি নিয়েছে? কে ম্যাগজিন খুলে দিয়েছে? ওয়ার্ডারদের কাছে তো রাইফেল সব সময় থাকে না। আমি যখন আওয়ামী লীগ অফিসে বসে আলাপ করছিলাম তখন রাত প্রায় দশটা। আবার খবর এলো, জেলগেটে গুলি হয়েছে। একজন লোক মারা গেছে। আমি আর জেলগেটে যাওয়া দরকার মনে করলাম না। আতাউর রহমান সাহেবকে টেলিফোনে বললাম, সভা ডেকে দিয়েছি, তিনি সম্মতি দিলেন।

পরের দিন পল্টন ময়দানে বিরাট সভা হলো। আমি বক্তৃতা করলাম, যে দোষী তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত, আর যারা গুলিতে মারা গিয়াছে তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পুলিশ কেন সময় মতো উপস্থিত হয় নাই, তারও একটা তদন্ত হওয়া উচিত। এর কয়েক দিন পরে যখন মন্ত্রী হলাম এবং এ ঘটনা সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, না হয়ে থাকলে। কী করা উচিত এ বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছিলাম। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত ও গভর্নর শাসন কায়েম হওয়ার পরে আমাকে ঐ জেলগেট দাঙ্গার কেসে আসামি করা হলো এবং মামলা দায়ের করা হলো। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই মামলা চলে। জনাব ফজলে রাব্বী, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে বিচার হয়। অনেক মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করেছিল। এমন কি মিস্টার গজের মেয়েও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল। পাবলিক সাক্ষী জোগাড় করতে পারে নাই। জেল ওয়ার্ডের মধ্যে থেকেও কয়েকজন সাক্ষী এনেছিল। তার মধ্যে দুইজন ওয়ার্ডার সত্য কথা বলে ফেলল যে, তারা আমাকে দেখেছে গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে এবং লোকদের চলে যেতেও আমি বলেছিলাম, তাও বললো জেল সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার নাজিরউদ্দিন সরকার কিন্তু সত্য কথা বললেন না, পুলিশ যা শিখিয়ে দিয়েছিল তাই বললেন। এক একজন সাক্ষী এক এক কথা বলল এবং কিছু কিছু সরকারি সাক্ষী এ কথাও স্বীকার করল যে, আমি জনতাকে শান্তি রক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলাম। তাতে ম্যাজিস্ট্রেট আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু না থাকায় আমাকে বেকসুর খালাস দিলেন এবং রায়ে বলেছিলেন যে আমাকে শান্তি ভঙ্গকারী না বলে শান্তিরক্ষকই বলা যেতে পারে।’ তবে এইবারে বোধ হয় আমাকে দশ মাস জেলে থাকতে হলো নিরাপত্তা আইনে।


আরো সংবাদ



premium cement