২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলা যেভাবে জাতিসঙ্ঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা পাবে

স্বাধীনতার পর সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। - ছবি : সংগৃহীত

ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়নেও অবদান রাখবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো, সব মাতৃভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া, দুর্বল বলে কোনো ভাষার ওপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা।

এ দিবসে প্রত্যেকে নিজের এবং অন্য জাতির মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশকে চেতনায় ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ। বাঙালি জাতি বুকের রক্ত দিয়ে বিশ্বকে শিখিয়ে দিয়ে গেল ভাষাকে ভালোবাসার মন্ত্র। মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে দেশ, দেশের মানুষ, দেশের সংস্কৃতি, দেশবাসীর জীবনাচারকে ভালোবাসা আর তার জন্য গর্ববোধ করার মধ্যে।

স্বাধীনতার পর সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের প্রয়োগ না থাকা অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বেশির ভাগ স্তরেই বাংলা বিমুখতা প্রকট আকার ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাইকোর্ট থেকে রুলসহ দু’টি আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভাষাবিদরা বলছেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যে দাবি ছিল তা আজও পূরণ হয়নি। শুধু কাগজে-কলমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বত্রই ইংরেজিসহ বিদেশী ভাষার দাপট। এ অবস্থা চলতে থাকলে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যেতে পারে। ভাষা শহীদদের চাওয়া এখনো পূরণ হয়নি। এত বছর পরও সমাজ ও রাষ্ট্রের সব জায়গায় বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তথ্য মতে, ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রয়োগ করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ এবং বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বানানরীতি’ প্রণয়ন করে। কিন্তু জাতীয় ভাষানীতি না থাকায় বানানে সমতা আনা যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানার অনেক প্রতিষ্ঠান প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করছে না। এ ভাষানীতির অভাবেই বিভিন্ন সরকারের আমলে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ যাতে বৃথা না যায় সে দিকে দৃষ্টি রেখেই সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার চালু করতে হবে। প্রথমে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে অন্যরাও এতে উৎসাহিত হয়।

বাংলা বিশ্বের ৩০ কোটির বেশি মানুষের মাতৃভাষা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ও সরকারি ভাষা। এক কালের ‘ভাবের ভাষা’ একালের কাজের ভাষাও বটে। বাংলাদেশের সরকারি অফিস-আদালত, বেসরকারি অফিস, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রসমূহ, সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় ও সমাজজীবনের বিভিন্ন স্তরে বাংলা ভাষা বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, মননজীবী সবাই তাদের ধ্যান-ধারণায়, চিন্তা-চেতনায় ও কর্মজীবনে নানাভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দ, সুখ ও গর্বের বিষয়। কেননা ভাষা স্থবির নয় বরং জঙ্গম। তা প্রবাহমান নদীর মতো দু’কূল ছাপিয়ে চলে উদ্দাম গতিতে। পথে নানা স্থান হতে সংগৃহীত হয় নানা উপকরণ যা ভাষাকে সতত সমৃদ্ধ করে চলে। তাই ভাষার বহুমাত্রিক ও কলেবর ক্রমাগত বেড়েই চলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, কালের পর কাল। যুগ যুগ ধরে ভাষা সমৃদ্ধশালী হয়। পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয় নতুন আঙ্গিক ও অবয়বে।

বাংলা অনেক সমৃদ্ধ ভাষা। এর শব্দ ভাণ্ডার অফুরন্ত। রয়েছে নানা বৈচিত্র্য এবং মাধুর্য। শিক্ষিত সমাজ, শিক্ষকদের এবং গণমাধ্যমের জন্য একটি পরিমিত বাংলা ভাষা দরকার। শিক্ষকরা যদি নিজেই ভালো বাংলা না বলতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের গ্রামে এবং শহরে মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা পড়ানোর মতো ভালো কোনো শিক্ষক নেই। এটি একটি বড় সঙ্কট। এক সময়ে স্কুলে পণ্ডিত মশাইরা ছিলেন যারা বাংলা পড়াতেন। শব্দের উৎপত্তি, বাংলা ব্যাকরণে তাদের ভালো দখল ছিল। সেই পণ্ডিত মশাইরা এখন আর নেই।

আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়েছি, তবে ভাষার দিকে কোনো খেয়াল নেই। এতে আমরা ভালো বাংলা বা ইংরেজি শিখতে ও বলতে পারছি না। আমরা এখন দাবি করছি জাতিসঙ্ঘের ভাষা হবে বাংলা। সেজন্য যদি পরিভাষা তৈরি করতে না পারা যায়, তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ব। এ জন্য আইন, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ের পরিভাষা তৈরি করতে হবে। কারণ জাতিসঙ্ঘ নানা আইন প্রণয়ন করে থাকে। জাতিসঙ্ঘের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগে আমাদের উচিত হবে বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করা।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করার আগে জরুরি হলো আমরা শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে এবং লিখতে পারি কি না তা যাচাই করা। যারা বাংলায় লেখালেখি করেন তারা অবগত আছেন ব্যাকরণসম্মতভাবে বাংলা বাক্য তৈরি করা এবং শুদ্ধ বানানে বাংলা শব্দ লেখা কতটা কঠিন। প্রথমত, আমাদের কতকগুলো বিষয় আইনগত বাধ্যবাধকতার ভেতর নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। মাঝে মাঝে ইংরেজি বলতে এবং লিখতে পারা মানে বড় কিছু হয়ে যাওয়া- এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা খুবই জরুরি। আরেকটি বিষয় হলো, বিশ্বায়নের যুগে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা। এই বিষয় এখন সারা বিশ্বে আদান-প্রদান হচ্ছে। এক দেশের সাহিত্য অন্য দেশে অনূদিত হচ্ছে এবং প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য জানতে হলেও আমাদের বাংলা ভাষার দুয়ার খুলতে হবে। পৃথিবীর সেরা সাহিত্যগুলো কিন্তু ইংরেজি ভাষায় নয়। আমাদের অনুবাদ সাহিত্য আরো বাড়াতে হবে। কালজয়ী বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। আমাদের মনোজগতে ইংরেজি নিয়ে একটি ঔপনিবেশিকতা তৈরি হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন নেই কিন্তু তাদের চিহ্ন থেকে আমরা বের হতে পারিনি। আমরা চাচ্ছি সর্বস্তরে বাংলা চালু হোক, বাংলা ভাষা যথাযথ মর্যাদা পাক কিন্তু এই ঔপনিবেশিক মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে তা সম্ভব হবে না।

আমরা খাদ্যদূষণ, ফরমালিন, ভেজাল তেল, দুধে পানি মেশানোসহ ভোগ্যপণ্যের বিষয়ে খুবই সচেতন। কিন্তু আমাদের ভাষা যে দূষণের কবলে সে বিষয়ে আমরা কথা বলি না। বর্তমানে এফএম রেডিওতে ভাষার কী পরিমাণ দূষণ হয়েছে তা বর্ণনাতীত। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য হারিয়ে আমরা জগাখিচুরির মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছি। বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে আমরা যে ভাষা তৈরি করছি তা আমাদের আত্মমর্যাদার জন্য অসম্মানজনক। বাংলায় প্রচুর বিদেশী শব্দ রয়েছে যেগুলো আমরা বাংলা হিসেবেই গ্রহণ করেছি।

১৯৫২ সালের ভাষার দাবি কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল স্বাধিকারের আন্দোলন। এরই প্রেক্ষাপটে হলো সশস্ত্র সংগ্রাম; অর্জিত হলো স্বাধীনতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বপরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও থেমে ছিল না। অবশেষে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো কানাডা প্রবাসী বাঙালি তরুণদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে একুশের চেতনা ধারণ করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর ২০০০ সালে ১৬ মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ মর্যাদা দিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশ দিবসটি পালন করবে।

সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনে গুরুত্ব দিয়েই ভাষা বিকাশের ধারা উজ্জীবিত রাখতে হবে। বাংলার বিকাশ সাধনে গবেষণা, অনুবাদ, পরিভাষা, শুদ্ধ ভাষার কথন ও উচ্চারণ, প্রমিত বাংলা বানানরীতি, ভাষানীতি ইত্যাদি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ, যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং শুদ্ধ বানানরীতির অনুসরণে সব বাঙালিকে যত্নবান হতে হবে। তাহলেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে।

বাংলা ভাষা সেভাবে বিকশিত হলেই একদিন তাকে জাতিসঙ্ঘের ব্যবহারিক ভাষা করার দাবি উচ্চকিত হবে এবং বাংলা হবে জাতিসঙ্ঘের দাফতরিক ভাষা।

লেখক : কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

সকল