২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিল্প-সাহিত্য ও ধর্ম, সংঘর্ষ এবং সমাধান

শিল্প-সাহিত্য ও ধর্ম, সংঘর্ষ এবং সমাধান - ছবি : নয়া দিগন্ত

শিল্প-সাহিত্য এবং ধর্ম- দুটিই মানব সভ্যতার আদিম প্রবৃত্তি। প্রবৃত্তির বেশ কিছু অর্থ আমরা পেতে পারি যেমন নিযুক্ত, রত হওয়া, অভিরুচি, ঝোঁক, প্রবণতা ইত্যাদি। যে অর্থই আমরা গ্রহণ করি না কেন, প্রবৃত্তি হলো মানুষের এক ধরণের প্রবণতা, যা মানুষ তার জন্মের সঙ্গে নিয়ে আসে। শিল্প-সাহিত্য ও ধর্মকে যদি সহজাত প্রবৃত্তি বলা হয়, তাহলে আরো সঠিকভাবে তাকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। সৃষ্টির শুরু থেকে জীবন ও জগত সম্পর্কে জানার এবং বোঝার একটা সহজাত প্রবৃত্তি মানুষের ভেতরে কাজ করে এসেছে। তারই একটা অংশ হিসাবে শিল্প-সাহিত্য ও ধর্ম এসেছে। ছোট থেকেই শিশুমনে নানান ধরণের প্রশ্নের উন্মেষ ঘটে। সবকিছু সে দেখতে, জানতে ও বুঝতে চায়। যে কারণে পৃথিবীর সব দেশে রূপকথার অজস্র গল্পের সৃষ্টি হয়েছে, নির্মিত হয়েছে গুহাচিত্র। বলাইবাহুল্য জীবন থেকেই কিন্তু গল্প, চিত্রকর্ম ইত্যাদির উন্মেষ ঘটে, তার সাথে যুক্ত হয় কল্পনা, সৃষ্টি হয় সাহিত্য বা শিল্প। অর্থাৎ জীবনকে বাদ দিয়ে শিল্প বা সহিত্যের সৃষ্টি হয় না, জীবনকে সঙ্গে নিয়েই এইসব সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে ইহজগত এবং পরজগত, নিয়ে এসেছে ধর্ম। ধর্মের কাজটা তাই শিল্প-সাহিত্য থেকে অনেকটা ভিন্ন হলেও একটা জায়গায় বেশ মিল দেখা যায়। ধর্ম প্রধানত জীবনের অংশ। জীবনকে বাদ দিয়ে কেউ ধর্মকর্ম করে না। অর্থাৎ জীবনের মধ্যে থেকেই আমরা ধর্মকর্ম করি। ধর্মেও আমরা অনেক ধরণের পৌরাণিক গল্পের সন্ধান পাই। যেগুলি আর দশটা সাধারণ গল্পের মতো হুবহু একরকম না হলেও, জীবনেরই গল্প। তার মানে ধর্মেও আমরা এক ধরণের গল্প বা কাহিনী দেখা পাই। প্রশ্ন হলো ধর্মে যদি গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়, ভিন্ন উপস্থাপনে আমরা সাধারণ গল্প পাবো না কেন?

ধর্মের সাথে শিল্প-সাহিত্যের সংঘর্ষ এখানে থেকে আমরা শুরু করতে পারি। ধর্মকে যদি আমরা একেবারে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দেখি, তাহলে দেখতে পাই ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত একটা জায়গা। ব্যক্তিগত অনুভূতি। যেখানে যে যার ধর্ম ব্যক্তিগত জায়গা থেকে লালন-পালন করে। তারপর সেটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এসে পড়ে। এখানে এসেই ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যের জায়গায় থেমে যায় বা কিছু বিধিনিষেধ আরোপ হতে দেখা যায়। এবং বলাই বাহুল্য ধর্মের সাথে শিল্পের সাংর্ঘষিক জায়গাটা ঠিক এই বিধিনিষেধ থেকেই শুরু হয়। যেহেতু সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসর ব্যক্তিগত পরিসর থেকে অনেক বড় এবং সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে নানা ধরণের, নানা মতের মানুষজন থাকে ফলে সবার পক্ষে এক মতে আসা সম্ভব হয় না। মতের অমিল থেকেই শুরু হয় সংঘর্ষ। এখানে আমরা অন্য ধর্মের কথায় না যেয়ে, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর জায়গা থেকে শুধু ইসলাম ধর্ম নিয়ে কথা বলবো। এখানে ইসলাম ধর্মের সাথে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়, সামাজিক বা রাজনৈতিক যে কারণেই হোক না কেন, ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে স্বাধীন শিল্প ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে একধরণের বিধিনিষেধ বা নিষিদ্ধতার ক্ষেত্র আরোপ করতে দেখা যায়। অর্থাৎ ধর্ম পালন করতে হলে নাচ, গান, নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করা যাবে না। ধর্মকে এমনই একটা বদ্ধ জায়গায় আবদ্ধ করা হয়, যার থেকে বেরিয়ে আসা আর সম্ভব হয় না। অথচ ইসলাম ধর্ম অত্যন্ত সহনশীল, লিবারেল ও শান্তির একটা ধর্ম। যেখানে শান্তি বিরাজ করার কথা সেখানে আমরা কেন এই সংঘর্ষকে আমন্ত্রণ জানাই? একটা ভালো চিত্রকর্ম বা সিনেমা দেখে যদি কারোর মন প্রশান্তি পায়, মন পরিশুদ্ধ হয়, তাহলে এসব কাজে বাধা প্রদান করা হবে কেন? শান্তিই যদি আমাদের ধর্মের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে এবং শিল্পের যেকোনো শাখা যদি সেই শান্তি এনে দিতে পারে, তাহলে অবশ্যই সেসব শাখার চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি। একটা ভালো গল্প বা গান যদি কোনো মানুষকে মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে, ভালো কাজে উৎসাহ যোগায় তাহলে সেই কাজ থেকে বিরত রাখার চেয়ে উৎসাহ যোগানো উচিৎ। যদিও এখানে কিছু কথা থেকে যায়। সব সিনেমা বা নাচ যে ঢালাওভাবে ভালো সেটাও আমরা বলছি না। মন্দ কাজের প্রতিবাদ হবেই এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েকটা মন্দের জন্যে আমরা বৃহৎ ভালোকে ত্যাগ করতে পারি না।

একেক দেশের সংস্কৃতি সেসব দেশের মাটি অর্থাৎ শেকড় থেকেই উঠে আসে। সংস্কৃতি কখনোই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। হতে পারে না। চাপানো সংস্কৃতি বিকৃত হতে বাধ্য। সংস্কৃতির ধারক ও বাহক প্রধানত শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠে। একটা দেশ শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যত উন্নত হতে পারে, তার সংস্কৃতিও সেভাবে উন্নত হতে থাকে। খাবার খেয়ে শরীর রক্ষা করা যায়, কিন্তু আত্মার রক্ষা হয়না। মন বা আত্মার রক্ষার জন্যেই শিল্প-সাহিত্য। অতীতে আমাদের দেশে যে পুঁথি পাঠের চর্চা ছিল সেটা এই সংস্কৃতির অংশ। গ্রামে একদিকে যেমন পুঁথি পাঠ, যাত্রাপালা, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালির মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির চর্চা করা হতো, শহরে তেমনি মঞ্চ নাটক, রেডিও নাটক, গান ইত্যাদি এবং পরে টিভি ও সিনেমার পর্দায় নাচ, গান, নাটক, সিনেমরা মধ্যে দিয়ে এক ধরনের শহুরে সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এখানে গ্রামীণ এবং শহুরে সংস্কৃতির বিতর্কে আমরা যাব না, সেটা একেবাইরেই ভিন্ন প্রসঙ্গ। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্মীয় বিধিনিষেধের মধ্যে দিয়েই আমাদের এখানে গ্রাম এবং শহরে শিল্প ও সাহিত্য চর্চা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্ম ( ইসলাম ধর্ম ) কখনো শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠে নাই। কিছু কবিতা, গল্প, কলাম বা লেখা কখনো কখনো সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেসব লেখার প্রতিবাদও করা হয়েছে। বিরোধিতা কখনো সাহিত্য হতে পারে না। বিরোধিতা বিরোধ ডেকে আনে। সাহিত্যের কাজ অন্যায়ের বিরোধিতা করা, ধর্মের বিরোধিতা নয়।

এই জায়গায় এসে আমরা আরেকটা সংঘর্ষ দেখতে পাই। আমাদের এখানে প্রায়ই দেখা যায়, ধর্মের বিরোধিতাকে প্রগতিশীল হবার একটা মানদণ্ড হিসাবে ধরে নেয়া হয়। ধর্ম যেন একটা প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় কোনো বিষয়, কাজেই সেটাকে সমাজ তথা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। ধর্ম যদি মধ্যযুগীয় কোন বিষয় হতো, তাহলে পৃথিবীর বিশেষ করে মূল ধর্মগুলি যেমন হিন্দু, খ্রিস্টিয়, ইসলাম, ইহুদি ধর্ম এত দিন ধরে টিকে থাকতে পারত না। ধর্মকে সরিয়ে দিয়ে যেমন সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা করা সম্ভব নয়, তেমনি সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্যে ধর্মকে সরানো সম্ভব না। দুটিই হাত ধরাধরি করে চলবে। কারণ ধর্ম এবং শিল্প ও সাহিত্য শেষ পর্যন্ত মানুষের মনের খোরাক যোগায়, মনের তথা মানব সমাজের শান্তি সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব


আরো সংবাদ



premium cement