২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা সংগীত নাচিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে

করোনা সংগীত নাচিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে - ছবি সংগৃহীত

করোনার মরণ আতঙ্কে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। আর এমন দুঃসময়ে শরীর ও মন চাঙ্গা করার টনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার জুলুদের পায়ের তালে ছন্দবদ্ধ একটি নৃত্য সঙ্গীত ‘জেরুসালেমা’। মাত্র পাঁচটি লাইনে খুবই সাধারণ একটি সুরে পায়ের তালে শরীর দোলানোর ছন্দ যে কতটা আকর্ষণীয় হতে পারে তার প্রমাণ এ নৃত্য-গীতটি।

ইতোমধ্যেই বিশ্বের দেশে দেশে এটি ভাইরাল হয়ে পড়েছে। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিস , জার্মান, ইতালিয়ান ও আরো নানা ভাষায় গানটি রূপ নিয়েছে একই ছন্দ ও তালে। ‘জেরুসালেমা’ সংগীতের তালে দলবদ্ধ হয়ে নাচছে আফ্রিকার আনাহারী অর্ধ-উলঙ্গ নগ্নপদ শিশুরা, গরিব বা স্বচ্ছল, কালো ও সাদা, নারী ও পুরুষ সবাই। আফ্রিকার বাইরেও ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা আর উত্তর আমেরিকাতেও নাচছে নানা পেশা আর বয়সের মানুষ। হাসপাতালে নাচছে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী, গির্জার চত্বরে পাদ্রি আর নান; সমুদ্র সৈকতে সূর্যসেবী নারী-পুরুষ, ফসলের ক্ষেতে কৃষক, খেলার মাঠে খেলোয়ার, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী, বিমানবন্দরে বিমানবালা আর ক্রু, রাস্তায় পুলিশের দল, ফায়ার ব্রিগেডের সদস্য, কারারক্ষী, নির্মাণশ্রমিক, হোটেলকর্মী, রেস্তোরাঁর ওয়েটার, সুপারমার্কেটের বিক্রয়কর্মীর দল- কেউ বাদ নেই।

জনসমাবেশপূর্ণ স্থান, পার্ক, ছাদের ওপর বা ঘরের মধ্যে সবজায়গাতেই নাচছে মানুষ এ গানের ছন্দে। করোনার মাঝে মন্দার বাজারে হোটেল রেস্তোরাঁয় ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বা বাজারে নতুন পণ্যের প্রচার বাড়াতেও এ নৃত্যগীতিটি ব্যবহৃত হচ্ছে দারুণ নৈপূণ্যের সাথে। ইতোমধ্যে দেশে দেশে নাচের স্কুলগুলোতে তালিম নিচ্ছে শিশু, কিশোর-কিশোরী আর যুবক-যুবতীর দল। চলছে প্রতিযোগিতা আর চ্যালেঞ্জ। ‘জেরুসালেমা’ নাচের তালে কার দল কত চমৎকার করে নাচতে পারে।

ইহুদি-খ্রিস্টানদের গসপেল থেকে নেয়া ধর্মীয় অনুভূতির প্রেক্ষাপটে রচিত জেরুসালেমা সংগীতটি। এটা ঈশ্বরের কাছে গায়কের প্রার্থনা যেন তাকে পবিত্র জেরুসালেম নগরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ নৃত্য-গীতটিতে ছোট ছোট কয়েকটি বাক্যে বলা হয়েছে “জেরুসালেম আমার বাড়ি; (ঈশ্বর) আমাকে সুরক্ষা দাও; এখান আমাকে ফেলে রেখে যেও না; আমাকে সাথে নিয়ে চলো; আমার স্থান এখানে নয়; এ রাজ্য আমার নয় ; আমার বাড়ি জেরুসালেম।“

এ সংগীতটির অনুভূতির কেন্দ্রে রয়েছে যে জেরুজালেমের নাম সেটি হচ্ছে আব্রাহামিয়, জুডিয়, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন পবিত্র শহর। এ শহরকে বলা হয় বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। এখানেই অবস্থিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ যা ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। এ মসজিদ থেকেই ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স: ) মে’রাজে গমন করেছিলেন। জেরুজালেম তাই সকল কিতাবি ধর্ম (আহলে কিতাব) অনুসারীদের জন্য পবিত্র তীর্থস্থান।

এরকম একটি ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে রচিত সংগীত ‘জেরুজালেমা’ তাই ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে বিশ্বব্যাপী।

ছন্দ-তালের জগতে গসপেল হাউস মিউজিক হিসেবে সংগীতটি রেকর্ড করা হয় এক বছর আগে -২০১৯ সালের ১১ আগষ্ট। এটি সামাজিক মাধ্যমে পোষ্ট করার পর সংগীতপ্রিয়দের কাছ থেকে দারুণ উৎসাহ পেয়ে নভেম্বর নাগাদ এটিকে ইউটিউবে ছেড়ে দেয়া হয়। তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তায় চমকিত হয়ে এক মাসের মধ্যেই গানের ভিডিওটি রিলিজ করা হয়। আর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গানটির স্রষ্টা মাষ্টার কেজি তার দ্বিতীয় এলবামে অন্তর্ভুক্ত করে এটি বাজারে ছাড়ে। গানটি ইতোমধ্যে নানাভাবে রিমিক্স হয়েছে নানা বাদ্যযন্ত্রের সংযোজনের দ্বারা। কোভিড ১৯ সংক্রমণের আগেই আফ্রিকার ক্লাবগুলোতে এটি দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এ যাবৎ আফ্রিকার কোনো সংগীত বিশ্বব্যাপী এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত গানটি ইউটিউব থেকে নামিয়ে শোনা হয়েছে ২০ কোটি বারের বেশি। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়ে বেলজিয়ামের শীর্ষ ৫০টি আলট্রা টপ সংগীতের তালিকায় এ গানটি উঠে যায় এক নম্বরে। একইভাবে ইউরো ডিজিটাল সংস-এর তালিকায় এক নম্বর, ফরাসি ডিজিটাল সংস-এর তালিকায় এক নম্বর, নেদারল্যান্ডসের টপ ৪০ তালিকায় এক নম্বর, হাঙ্গেরির সিঙ্গেল টপ ৪০ তলিকায় এক নম্বর; সুইজারল্যান্ডের এক নম্বর; রোমানিয়ার এক শ' জনপ্রিয় সংগীতের তালিকায় এক নম্বর, আর আমেরিকার ডিজিটাল সংগীতের বিক্রয় তালিকায় এক নম্বর স্থান দখল করে নেয় ‘জেরুজালেমা’ নৃত্যগীতটি। ফেসবুক, টুইটার, টিকটক-এর মাধ্যমে হাজারো সংগীতানুরাগী প্রতিদিন ‘জেরুসালেমা‘ ভিডিও মিউজিকটি শেয়ার করছেন বন্ধু বা অনুসারীদের সাথে।

গত অক্টোবরে (২০২০) আফ্রিকান ঐতিহ্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা তার দেশবাসীকে আহবান করেছেন উৎসবে এ নাচটি নাচতে। এটি এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এ নৃত্যগীতের মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংগীত, নৃত্য ও বাজনার ছন্দ ও তাল বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা একসাথে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ও বিশ্বমহামরী করোনা সংক্রমণে মৃতদেরও স্মরণ করতে পারি।

গানটির স্রষ্টা মাষ্টার কেজি নামে পরিচিত কিগাওগেলো মোয়াগা সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, তার গানটি জনপ্রিতার এতটা তুঙ্গে উঠবে সেটা তার কাছে অকল্পনীয়। বিশ্ব এখন নাচছে। গড ইজ এমেজিং- ঈশ্বর দারুণ ও বিস্ময়কর।

 


আরো সংবাদ



premium cement