‘স্মৃতিময় হতে হলে কৃতিময় হতে হয়’
- অধ্যাপক মো: মসিউল আযম
- ২৪ অক্টোবর ২০২০, ২০:৫৭
যশোর জেলার সদর উপজেলার নওয়াপাড়ায় ১৯২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রায় চৌধুরী বংশে এক শিশু জন্ম নেয়। বাবা সুবেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ও মা অনিলা রায় চৌধুরীর সন্তানই বড় হয়ে দেশ ও সমাজের কাজে হয়ে ওঠেন একজন আলোকিত মানুষ। তিনি ছিলেন মা-বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। পারিবারিক জীবনে এই বিমল রায় চৌধুরী এক ছেলে ও মেয়ের জনক। শৈশবে মা-বাবার আদর্শ ও প্রেরণায় বড় হয়ে তিনি একজন প্রকৃত খাঁটি মানুষ হওয়ার দীক্ষা লাভ করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৪২ সালে এ স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ডাক্তারি পড়ার জন্য কলকাতা যান এবং ক্যাম্বেল হাসপাতালে এলএমএফ কোর্সে ভর্তি হন। বিভিন্ন কারণে ডাক্তারি পড়া শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন এবং যশোর এমএম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে আইএসসি ও ১৯৪৮ সালে সেখান থেকে বিএ পাস করেন। পরবর্তীকালে চাকরি ও ব্যবসায় না গিয়ে রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৪৯ সালে তেভাগা আন্দোলন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৫ দিন পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। এর কয়েক দিন পরই তিনি কেশবপুর থানার মঙ্গলকোট গ্রামে বিমল চন্দ্র ঘোষের মেয়ে শিলা রায় ঘোষকে বিয়ে করেন। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে তিনি কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।
এরপর ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিমল রায় একজন সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বনগা মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি ক্যাম্পে পলিটিক্যাল লিয়াজোঁ হিসেবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাসহ বহু দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন।
আমার কর্মজীবনে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও সমাজ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রায় ৫০-৫৫ বছর ধরে খুব কাছ থেকে বিমল রায় চৌধুরীকে নিবিড়ভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তার মতো বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এমন ত্যাগী নিবেদিত প্রাণ মানুষ এখন সমাজে খুঁজে পাওয়া ভার। একজন মনীষীর ভাষায় বলতে হয় ‘স্মৃতিময় হতে চাইলে, কীর্তিময় হতে হয়’ অর্থাৎ কিছু কীর্তি রেখে যেতে হয়। আরেকজন মনীষীর কথায় ‘স্মৃতি হচ্ছে ডায়েরি, যা আমরা সবাই বয়ে বেড়াই’। আমি সেই প্রিয় মানুষটির ডায়েরি বয়ে বেড়াচ্ছি যুবক বয়স থেকে এখন পর্যন্ত; যার সান্নিধ্য পেয়ে হয়েছি ধন্য।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ পরিচালনা পর্ষদের কলেজের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন অ্যাডভোকেট রওশন আলী, অ্যাডভোকেট গজনবী, শিক্ষানুরাগী সদস্য বিমল রায় চৌধুরী, ডা: কাজী রবিউল হক, সেক্রেটারি আবদুল বারী, আমিরুল ইসলাম রন্টু, ডা: আবু সাঈদ। কলেজের কাজে যেতে হতো তার কাছে। জেলা প্রশাসক, এসডিও, সিও প্রত্যেকের কাছেই নিজের কাজ ফেলে কলেজের কাজে বহু সময় দিয়েছেন তিনি। আমাকে বিভিন্ন কারণে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে অনেক মিটিংয়ে আমার ডায়েরি রেখে দিয়ে তার আসন সংরক্ষিত করে রাখতাম। সভাকক্ষে ঢুকেই তিনি বলতেন, ‘এই আযম, আমার সিট রেখেছ। বর্ণময় যশোরে সার্বিক সহায়তা কর্মসূচির ব্যাপারে জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটিতে আমার একটি দায়িত্ব ছিল, সদস্যদের মধ্যে প্রফেসর শমসের স্যার ও বিমল রায় চৌধুরীকে ডাকা এবং তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে কর্ম এলাকা শার্শা, ঝিকরগাছা বর্ণময় কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বাসায় পৌঁছে দেয়া। এই দায়িত্ব পালনের জন্যে দু’জনই খুব আনন্দিত হতেন।
তিনি ছিলেন পাবনা হেমায়েতপুর সৎ সঙ্ঘের সভাপতি। তিনি বলতেন, ‘আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে সৎ সঙ্ঘে। নিরামিষ ছাড়া তোমাকে আর কিছুই খাওয়াতে পারব না’। দুঃখের বিষয়- তার ও আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি ছিলেন নিরামিষভোজী। ৫০-৬০ বছর ধরে একনাগাড়ে নিরামিষ খেতেন বলেই সারাজীবন সুস্থ ছিলেন তিনি।
জমিদার বংশে জন্মেও তিনি চলনে বলনে জমিদারি ভাব দেখাননি। জমিদারি দেখাশোনা করে তিনি রাজার হালে দিন কাটাতে পারতেন; কিন্তু তা না করে জনসেবক হয়ে সেবার মাঝে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। সারা জীবন বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেরিয়েছেন। হাসপাতালের বারান্দায় রোগীর চিকিৎসার খোঁজ নিতেন। স্টেডিয়ামে খেলার মাঠে, যশোর ইনস্টিটিউট নাট্যকলা, পাবলিক লাইব্রেরি সংগঠনসহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির নির্মাণ, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার বিচরণ। এ জন্যই তিনি হতে পেরেছিলেন একজন নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, সমাজসেবক, দেশদরদী, সামাজিক ব্যক্তিত্ব। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে এই মহান ব্যক্তি জীবনের ঋণ পরিশোধ করে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান। গত বছর ১ ফেব্রুয়ারিতে যশোর রওশন আলী মঞ্চ ও টাউনহল ময়দানে বিমল রায় চৌধুরীর নাগরিক শোকসভা কমিটি আয়োজিত শোকসভায় সর্বস্তরের মানুষের বিশাল উপস্থিতি থেকে প্রমাণ মেলে, তিনি যশোরের মানুষের কত জনপ্রিয়, কত কাছের মানুষ ছিলেন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা