১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


বিচার ব্যবস্থায় ক্যামেরা ট্রায়ালের গুরুত্ব

- ফাইল ছবি

দেশের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আদালতের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কমন ল’ অন্তর্ভুক্ত দেশ হওয়ায় আমাদের দেশে সাধারণত বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে থাকে প্রকাশ্য আদালতে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন।’ অতএব, মানুষের এই অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা জরুরি। এজন্য বিচারব্যবস্থা প্রকাশ্য হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পাবলিক ট্রায়াল বা প্রকাশ্য আদালতে বিচার ছাড়াও অন্য আরেক ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত আছে, যা হলো ক্যামেরা ট্রায়াল বা সিক্রেট ট্রায়াল।

ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে কেবল পাবলিক ট্রায়াল নয়, বিশেষ অবস্থাতে ক্যামেরা ট্রায়ালও আবশ্যক। এর অর্থ ‘গোপনে’। এটি এমন একটি বিচারব্যবস্থা, যেখানে সাধারণ মানুষ বা গণমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ। পাবলিক ট্রায়ালের মতো ক্যামেরা ট্র্যায়ালে উভয় পক্ষ এবং তাদের সাক্ষী জনসমক্ষে জবানবন্দী প্রদান করেন না। এখানে আইনজীবীরা প্রকাশ্যে যুক্তিতর্ক করেন না। অর্থাৎ ক্যামেরা ট্রায়ালে পুরো বিচারকার্য সম্পন্ন হবে উভয় পক্ষ (আসামি ও অভিযুক্ত) ও তাদের সাক্ষী এবং আইনজীবীদের উপস্থিতিতে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সংবিধান যেহেতু পাবলিক ট্রায়ালকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাহলে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচারকার্য সম্পাদন করলে কি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই ‘না’ হবে। কারণ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৬) এ উল্লেখ করা আছে, ‘প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোনো দণ্ড বা বিচার পদ্ধতি সম্পর্কিত কোনো বিধানের প্রয়োগকে এই অনুচ্ছেদের (৩) বা (৫) দফার কোনো কিছুই প্রভাবিত করবে না।’ তাই কোনো আইনে যদি ক্যামেরা ট্রায়ালের উল্লেখ থাকে সেটি সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে না।

বাংলাদেশে বিভিন্ন আইনে, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার পরিচালনার বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০- (সংশোধিত ২০০৩) এ ধর্ষণের মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে। ওই আইনের ধারা ২০(৬) এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা ট্রাইব্যুনাল স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করিলে এই আইনের ধারা ৯ এর অধীনে অপরাধের বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত করিতে পারিবে।’ একটি ধর্ষণের মামলায়, ঢাকার আদালত ভিকটিম ছাত্রীর জবানবন্দী নেয়ার জন্য আদেশ দেন নিজস্ব কক্ষে (ক্যামেরা ট্রায়াল) যে শিক্ষক পরিমল দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। ভিকটিমের আইনজীবী পিটিশনে উল্লেখ করেন, ‘সে একজন ছাত্রী এবং আদালত প্রাঙ্গণে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে।

ফলে জেরা ও জবানবন্দী এর জন্য ক্যামেরা ট্রায়াল আবশ্যক। ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ওই ধারা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ। তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণভাবে এখনো ক্যামেরা ট্রায়ালের অনুকূলে নয়। কারণ বিচারব্যবস্থায়, প্রয়োজনে এবং বিশেষ অবস্থায় গোপনীয়তা রক্ষা করা কতটা জরুরি, এটি এখনো অনেকের উপলব্ধির বাইরে। একজন ধর্ষিতা নারীর জবানবন্দী প্রকাশ্যে নেয়া তাকে ‘দ্বিতীয়বার ধর্ষণ’ করার শামিল। ধর্ষণ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিতে হয়। ধর্ষিতা নারীর জন্য সবার সামনে প্রতিটি বিষয় এভাবে তুলে ধরা অসম্মানজনক। বিশেষত আসামি পক্ষের আইনজীবী জেরা করার সময় ভিক্টিম অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে। উন্মুক্ত আদালতের পরিবেশ তাকে মানসিকভাবে বিষম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কারণ দেখা যায়, ধর্ষণের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে উৎসুক জনগণ আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় জমায় এবং ধর্ষণসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করে। এতে ভিকটিমকে জেরা করা জবাববন্দী নেয়া তার জন্য বিব্রতকর। ফলে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি হয় বাধাগ্রস্ত।

এ ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়াল নির্বিঘেœ জজের খাস কামরায় ভিক্টিমদের জবানবন্দী দেয়া সহজ করে দেয়। এছাড়া পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫তে ক্যামেরা ট্রায়ালের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। ওই আইনের ধারা ১১ তে নিভৃত কক্ষে বিচারের উল্লেখ আছে। (১) পারিবারিক আদালত যথার্থ মনে করিলে এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী সম্পূর্ণ বা আংশিক কার্যক্রম রুদ্ধকক্ষে অনুষ্ঠান করিতে পারেন। (২) যদি মোকদ্দমার উভয় পক্ষ কার্যধারা রুদ্ধকক্ষে অনুষ্ঠানের জন্য আদালতকে অনুরোধ করেন, তবে আদালত অবশ্যই অনুরূপ করিবেন।’

বৈবাহিক সম্পর্ক সংক্রান্ত মামলাগুলোতে যেমন : দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদে, স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলো থাকে। মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯ অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ ও ডিক্রির কারণগুলো পুরুষত্বহীনতা, অপ্রকৃতিস্থ, নিষ্ঠুর আচরণ প্রভৃতি। আর এই বিষয়গুলো সরাসরি ব্যক্তির বা পক্ষদ্বয়ের মর্যাদার সাথে জড়িত। কারণ ওই বিষয়গুলো বৈবাহিক জীবনের গোপনীয়তা প্রকাশ করে, যা দম্পত্তির জন্য অসম্মানজনক। এ ছাড়া, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ ধারা ২৩ এ নিভৃত কক্ষে বিচার কার্যক্রমের উল্লেখ করা আছে। উক্ত ধারায় বলা আছে, ‘সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের সম্মতির ভিত্তিতে অথবা আদালত স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করিলে, এই আইনের অধীন বিচারকার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে করিতে পারিবে।’

এছাড়াও, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রুলস অব প্রসিডিউর ২০১০ বিচারকার্য ক্যামেরা ট্রায়ালে পরিচালনায় উৎসাহিত করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ এর ধারা- ১০, উপধারা- ৪ এ বলা আছে, ‘আদালত যথার্থ মনে করিলে বিচার কার্যক্রম প্রকাশ্য আদালতের পরিবর্তে ক্যামেরা ট্রায়ালে করিতে পারে।’ এ ছাড়াও, ওই আইনের ধারা ১১ উপধারা ৪ ট্রাইব্যুনালকে ক্ষমতা প্রদান করে এমন কোনো ব্যক্তি শাস্তি প্রদান করার জন্য যে, এটির প্রক্রিয়াকে লঙ্ঘন এবং অমান্য করে। এ ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ধারা ৫৮ (ক) ঝঁন-ধৎঃরপষব এ গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি, অর্থাৎ ধারা ১০(৪) অনুযায়ী ক্যামেরা ট্রায়ালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এটি লঙ্ঘন করলে ধারা ১১(৪) অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা হবে।

এ ছাড়াও আদালতের যর্থাথ মনে হলে জাতীয় নিরাপত্তার জড়িত সাথে বিষয়গুলোর বিচারকার্য ক্যামেরা ট্রায়ালে পরিচালনা করতে পারেন। বর্তমানে রাষ্ট্রকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের মতো বিষয়গুলো নিয়ে মামলা পরিচালনা করতে হচ্ছে এবং সেক্ষেত্রে প্রকাশ্য বিচার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘœ ঘটাতে পারে। প্রকাশ্য বিচার জনসম্মুক্ষে নিঃসন্দেহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এটা কি বলা হয় মৌলিক অধিকার; যেটি ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং জনগণ ও গণমাধ্যমকে কোর্টে কী চলছে তা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়। এটি ব্রিটিশ আইনের একটি নীতি যা, ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা স্বাক্ষরের আগেই প্রতিষ্ঠিত। প্রকাশ্য আদালত বহুল প্রচলিত একটি বিচারব্যবস্থা যেখানে সাধারণ জনগণের আদালতের কার্যক্রম এবং রায়ের ওপর আস্থা সৃষ্টি হয়। তবু ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার্থে ক্যামেরা ট্রায়াল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশ্য আদালতের বিপরীত এ বিচার ব্যবস্থা ‘প্রাইভেসি রাইটস’ রক্ষার্থে অত্যন্ত উপযোগী। যৌন হয়রানি, শিশুরা যে মামলায় ভিক্টিম বা অপরাধী কিংবা যে মামলাগুলোতে কিশোর-কিশোরীরা জড়িত, সে মামলাগুলোতে গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরি।

কারণ জনসাধারণের উপস্থিতি পক্ষদ্বয়কে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ‘রাইট টু প্রাইভেসির’ বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ১২ তে উল্লেখ করা আছে। সেখানে বলা আছে, কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশি মতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের আঘাত বা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। এ ছাড়াও আইসিসিপিআর এর ধারা ১৭ও ‘রাইট টু প্রাইভেসি’ উল্লিখিত রয়েছে’। অতএব, এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় স্বার্থ, জনগণের ও ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা নিরসনে ক্যামেরা ট্রায়ালের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশ্য আদালতে ভিকটিমের সম্ভ্রমহানি এবং সাক্ষীর জীবনের ঝুঁকি থাকে। তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যামেরা ট্রায়ালের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন এবং তা প্রয়োগ করা খুব জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কনভেনর, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement
অবসরের আগে ক্রিকেট নিয়ে কোনো অতৃপ্তি রাখতে চান না কোহলি সারাদেশের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত, সিলেট বিভাগে হতে পারে বৃষ্টি ‘চরমপন্থী’ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা কানাডার নাজিরপুরে বাসচাপায় নিহত যুবলীগকর্মী বিশ্বকাপের জন্য পাকিস্তানের ১৫ খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশিত আওয়ামী সরকার দেশে নব্য বাকশালী শাসন কায়েম করেছে : মির্জা ফখরুল শনিবার ১৫ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় অন্যায়ভাবে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে : মান্ডা-জিরানী খালপাড়বাসী র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে : যুক্তরাষ্ট্র কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার বাংলাদেশকে একটি সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে : হামিদুর রহমান আযাদ

সকল