২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


টুইটারের জন্য হুমকি হতে পারে জুকারবার্গের নতুন অ্যাপ ‘থ্রেডস’

টুইটারের জন্য হুমকি হতে পারে জুকারবার্গের নতুন অ্যাপ ‘থ্রেডস’। - ছবি : সংগৃহীত

টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাত্রই চালু হওয়া নতুন অ্যাপ ‘থ্রেডস’ শুরুতেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে বড় সাড়া ফেলেছে। প্রথম সাত ঘণ্টার মধ্যেই এই অ্যাপটি ব্যবহারের জন্য এক কোটি ব্যবহারকারী নাম লিখিয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্ক জুকারবার্গ। তার কোম্পানি মেটা এই নতুন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপটি ছেড়েছে।

জুকারবার্গ এই অ্যাপটিকে টুইটারের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী’ হবে বলে বর্ণনা করেছেন।

প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক গত বছরের অক্টোবরে টুইটার কিনে নেয়ার পর হতে এটি বেশ কিছু বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পরিবর্তনের কারণে যেসব টুইটার ব্যবহারকারী অসন্তুষ্ট, নতুন অ্যাপ থ্রেডস তাদের আকৃষ্ট করতে পারে।

থ্রেডসের অনেক বৈশিষ্ট্য টুইটারের মতোই। যেমন কোনো পোস্ট ৫০০ বর্ণের বেশি হতে পারবে না বলে সীমা বেঁধে দেয়া আছে।

এর আগে জুকারবার্গ বলেছিলেন, এই প্লাটফর্মটি সফল হবে কি-না সেক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটিকে বন্ধুত্বপূর্ণ রাখতে পারা।

তবে টুইটারের মালিক ইলন মাস্ক এর পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘ইনস্টাগ্রামে কষ্ট গোপন করে মিথ্যে সুখের ছল করার চাইতে বরং টুইটারে অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত।’

মার্ক জুকারবার্গকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, থ্রেডস টুইটারের চেয়ে বড় হতে পারবে কি-না। জবাবে তিনি বলেন, ‘এতে সময় লাগবে। কিন্তু আমি মনে করি, জনগণের কথাবার্তা বলার জন্য এমন একটি অ্যাপ দরকার, যেখানে এক শ’ কোটির বেশি মানুষ থাকবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘টুইটারের এই সুযোগ ছিল, কিন্তু তারা তা পারেনি। আশা করছি আমরা পারব।’

তবে থ্রেডস যে পরিমাণে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করবে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্মগুলো তার সমালোচনা করেছে। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, থ্রেডস ডাউনলোড করলে এটি ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্য, আর্থিক ও ব্রাউজিং-সংক্রান্ত তথ্যসহ অনেক ধরনের তথ্য সংগ্রহ করবে।

বিশ্বের শতাধিক দেশে এখন থ্রেডস ব্যবহার করা যাবে। তবে ইউরোপিয় ইউনিয়নে এখনো এটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়নি কিভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে সে সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে।

ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক মেটা তাদের নতুন ছাড়া অ্যাপটিকে একেবারেই ‘প্রাথমিক সংস্করণ’ বলে বর্ণনা করছে। তবে এতে আরো যেসব বিষয় যোগ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার ফলে একজন ব্যবহারকারী অন্য সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ, যেমন মাস্টোডনের ব্যবহারকারীদের সাথে বার্তা বিনিময় করতে পারবেন।

এই অ্যাপটি বাজারে ছাড়ার আগে মেটা বলেছিল, ‘থ্রেডস হবে এমন একটি অ্যাপ যাতে ইনস্টাগ্রামের সব ভালো দিকগুলো থাকবে এবং এটিকে টেক্সটে ব্যবহার করার উপযোগী করে বিস্তৃত করা হবে।’

থ্রেডস যদিও সম্পূর্ণ আলাদা একটি অ্যাপ, এতে লগ-ইন করতে হবে ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট দিয়ে। ইনস্টাগ্রামের একই ইউজারনেম এখানেও থাকবে, তবে কেবলমাত্র থ্রেডসের উপযোগী করে প্রোফাইল বদল করা যাবে।

মেটা বলছে, কোনো ব্যবহারকারী ইনস্টাগ্রামে যাদের ফলো করেন, এখানেও একজন ব্যবহারকারী চাইলে ওই সব অ্যাকাউন্ট ফলো করতে পারবেন। তবে ইনস্টাগ্রামের অ্যাকাউন্টটি প্রাইভেট রাখা যাবে, কিন্তু থ্রেডসের অ্যাকাউন্টটি হবে সবার জন্য উন্মুক্ত।

এই নতুন অ্যাপটি মেটা এমন এক সময় ছাড়ল, যখন তাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ সমালোচনা চলছে। গত বছর মেটার ভেতরের নানা কীর্তি ফাঁস করে দেয়া এক কর্মী ফ্রান্সেস হগেন বলেছিলেন, এই কোম্পানি ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার চেয়ে মুনাফাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। যেভাবে ফেসবুকে মডারেশনের কাজ চলে তার সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

এর আগে মেটা আরেকবার বড় ধাক্কা খেয়েছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর। তখন দেখা যায়, ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্রিটেনের এই রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতো তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল।

টুইটারের কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী এখনই আছে। যেমন ব্লু-স্কাই এবং মাস্টোডন। তবে এগুলো এখনো সেভাবে জনপ্রিয় হতে পারেনি।

থ্রেডসের একটি বড় সুবিধা আছে, কারণ এটি ইনস্টাগ্রামের সাথে যুক্ত এবং ওই প্লাটফর্মে এখনই কোটি কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে।

থ্রেডস কিভাবে কাজ করে?
একজন ব্যবহারকারী থ্রেডস থেকে তার পোস্ট ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করতে পারবেন, আবার ইনস্টাগ্রাম থেকে থ্রেডসে। এসব পোস্টে লিংক, ছবি ও ভিডিও সবই দেয়া যাবে। তবে ভিডিও পাঁচ মিনিটের বেশি হতে পারবে না।

বুধবার প্রথম যারা থ্রেডস ব্যবহার করছিলেন তাদের কেউ কেউ ছবি আপলোড করতে সমস্যায় পড়েছিল। এটি নতুন চালু হওয়া অ্যাপটির শুরুর দিকের সমস্যা বলে মনে হচ্ছে।

এই প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীরা তাদের টাইমলাইনে বিভিন্ন পোস্ট দেখতে পায়, যেটিকে মেটা নাম দিয়েছে ‘থ্রেড’। একজন ব্যবহারকারী যাদের ফলো করে তাদের ও অন্য কিছু ‘রিকমেন্ডেড কনটেন্ট’ তার টাইমলাইনে দেখবে।

একজন ব্যবহারকারীকে অন্য কেউ ‘মেনশন’ বা উল্লেখ করতে পারবে কি-না, তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু শব্দের উল্লেখ আছে, এমন ধরনের পোস্ট চাইলে ফিল্টার করে বাদ দেয়া যাবে।

এছাড়া এই অ্যাপে চাইলে কাউকে ‘আন-ফলো’ বা ব্লক করা যাবে। অন্য প্রোফাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগও করা যাবে। ইনস্টাগ্রামে ব্লক করা কোনো প্রোফাইল স্বয়ংক্রিয়ভাবে থ্রেডসেও ব্লক হয়ে যাবে।

মেটা যদিও থ্রেডসের সাথে ইনস্টাগ্রামের সম্পর্কের বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছে, মিডিয়া কভারেজে অবশ্য এই নতুন অ্যাপটির তুলনা চলছে টুইটারের সাথে। কোনো কোনো বিনিয়োগকারী এই অ্যাপটিকে ‘টুইটার কিলার’ বা ‘টুইটারের মৃত্যু-ঘণ্টা’ বলে বর্ণনা করছেন।

গত শনিবার টুইটারের মালিক ইলন মাস্ক তার প্লাটফর্মে একজন ব্যবহারকারী প্রতিদিন সর্বোচ্চ কত টুইট দেখতে পারবে তার সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। তবে টুইটারে যারা মাসিক চাঁদা দিয়ে ব্লু টিক অ্যাকাউন্ট নিয়েছেন, তাদের বেলায় এই সীমা নেই। মাস্কের এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য ছিল আরো বেশি ব্যবহারকারীকে অর্থের বিনিময়ে ব্লু টিক নিতে উৎসাহিত করা।

ইলন মাস্ক টুইটারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই অনেক ব্যবহারকারী প্রকাশ্যে তার নেতৃত্ব এবং এই প্লাটফর্মের ব্যাপারে তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। তারা বিশেষ করে তার উদ্ভট আচরণ এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছিল।

টুইটারের জন্য সত্যিকারের হুমকি?
বিবিসির উত্তর আমেরিকার প্রযুক্তি-বিষয়ক সংবাদদাতা জেমস ক্লেটন প্রথম দিনেই থ্রেড ব্যবহার করে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

তিনি জানান, ‘প্রথম ব্যবহারের পরই মনে হলো, মেটা কি এটা করতে পারে? এটা কি এক ধরনের প্লেজিয়ারিজম নয়?’

জেমস ক্লেটন বলেন, ‘এই অ্যাপটি দেখতে প্রায় হুবহু টুইটারের মতো। এতেও কত বর্ণ লেখা যাবে তার সীমা বেঁধে দেয়া আছে, এখানে রিপোস্টিং এর অপশন আছে, এটির ফিড দেখতে একই রকম। সবকিছুই অবিশ্বাস্য রকমের চেনা।’

মার্ক জুকারবার্গ যদিও দাবি করছেন যে প্রথম সাত ঘণ্টাতেই এক কোটি মানুষ এই অ্যাপে নাম লিখিয়েছে, সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন জেমস ক্লেটন। কারণ এত বেশি মানুষ যে এই প্লাটফর্মে আছে, তা মনে হচ্ছে না।

এর একটা কারণ, এটি ইনস্টাগ্রামের সাথে যুক্ত। কেউ যদি আগে থেকেই ইনস্টাগ্রামে থাকে, তখন তাকে ইনস্টাগ্রামের সব ফলোয়ারকে এই অ্যাকাউন্টেও ফলো করার অপশন দেয়া হয়। যার মানে কেউ থ্রেডসে নাম লেখানোর সাথে সাথে আগে থেকেই তার অনেক ফলোয়ার সেখানে আছে। কাজেই অন্য ইনস্টাগ্রাম বন্ধুরাও যখন থ্রেডসে অ্যাকাউন্ট খুলবে, তখন তারাও এখানে ফলোয়ার হয়ে যাবে।

মার্ক জুকারবার্গের দিক থেকে এটি বেশ একটি চতুর পদক্ষেপ। বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর যে ছোট কোম্পানিগুলোর তুলনায় বিরাট সুবিধা থাকে, এটা তার একটা উদাহরণ।

মেটা একেবারে শূন্য থেকে এই অ্যাপ তৈরি করছে না। ইনস্টাগ্রামে তাদের যে এক শ’ কোটির বেশি ফলোয়ার আছে, তা তাদের একটা বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে।

ব্লু-স্কাই বা মাস্টোডনের এই সুবিধে নেই। তাদের শুরু করতে হয়েছে শূন্য থেকে।

এটি ন্যায্য কি অন্যায্য, তা নিয়ে ভাবেন না মার্ক জুকারবার্গ। তিনি এর আগেও অন্য অ্যাপ বেশ সাফল্যের সাথেই নকল করেছেন (যেমন রিলস হচ্ছে টিকটকের নকল)। এই কাজ তিনি খুশি মনে আবারো করবেন।

ইনস্টাগ্রামে বড় বড় তারকাদের ক্ষমতাকেও কাজে লাগাচ্ছেন জুকারবার্গ। এরই মধ্যে তিনি শাকিরা এবং গর্ডন রামসের মতো বড় তারকাদের থ্রেডসে আনতে সফল হয়েছেন।

এই অ্যাপটিকে ঘিরে এরই মধ্যে যে হৈ-চৈ শুরু হয়েছে, তাতে জুকারবার্গ নিঃসন্দেহে উৎফুল্ল। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটওয়ার্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত বেশি মানুষ এই অ্যাপ ব্যবহার করবে, ততই ভালো। যখন একজনের বেশিরভাগ বন্ধু বা প্রিয়জন একটি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে যোগ দেয়, তখন তিনিও ভাবে, আমাকেও এখানে থাকতে হবে।

তবে একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মকে এই অবস্থানে নেয়া সহজ নয়। কিন্তু যখন এটি এমন অবস্থানে যায়, তখন এটি সত্যিই কাজ করে। এর উল্টাটাও সত্যি। যখন লোকজন একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ছাড়া শুরু করে, এটা বেশ দ্রুতই ঘটে- এটার ফল হতে পারে বিধ্বংসী। মাইস্পেস বা বিবোর কথা বলা যেতে পারে।

থ্রেডসের কিছু সমস্যা
থ্রেডসের কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করা দরকার। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এটার একটি মাত্র ফিড, দু’টি নয়।

টুইটারে দু’টি ফিড থাকে, একটিতে থাকে রিকমন্ডেড টুইট। আরেকটি থাকে যাদের আপনি ফলো করেন তাদের টুইট।

থ্রেডসে আপনার ফিডে থাকবে আপনার ফলোয়ার এবং আপনি যে ধরনের বিষয় পছন্দ করেন তার সংমিশ্রণ। এটি অনেক সময় বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।

থ্রেডস এখনো ডেস্কটপের উপযোগী নয়, এটি ডেস্কটপে অত ভালো কাজ করে না।

এটিতে ট্রেন্ডিং এর তথ্যও থাকে না, কাজেই কোন জিনিস ভাইরাল হচ্ছে তা জানা কঠিন।

এছাড়া এটিতে কোনো মেসেজ করার অপশন নেই, যেটি টুইটারে আছে।

অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশনের বেলায় টুইটারের মতো এখানেও একজন ব্যবহারকারী অর্থ দিয়ে ব্লু টিক কিনতে পারবে।

যদিও এরই মধ্যে বহু মানুষ মধ্যে থ্রেডসে নাম লিখিয়েছে এবং এটা নিয়ে একটা শোরগোল তৈরি হয়েছে। এটি এখনো টুইটারের তুলনায় অনেক ছোট। এই প্লাটফর্মে কারো পোস্ট খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে না।

তবে তারপরো শুরুতেই যে পরিমাণ ব্যবহারকারী পেয়েছে থ্রেডস, তাতে মার্ক জুকারবার্গ নিশ্চয়ই রোমাঞ্চিত। বহু বছর ধরে নেতিবাচক মিডিয়া কভারেজের পর, তিনি এখন নিজেকে একজন ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। একজন টেক বিলিওনেয়ার, যিনি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম চান।

তার এই অ্যাপ যদি সত্যি ঠিকঠাক কাজ করে, সেটি ইলন মাস্কের জন্য সত্যিকারের বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement