০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্য

-

দেশের আর্থিক খাতে সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে। সময়কে কাজে লাগাচ্ছেন তারা। দেশের ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নানাভাবে বিতর্কিত দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এ জন্য কখনো বড় গলি আবার কখনো সরু গলি দিয়ে হাঁটছেন। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করার চেষ্টায় শুধু দেশের ব্যাংকিং খাত নয়, পুরো অর্থনীতিকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন তারা।
দেশের আর্থিক খাত তথা ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই এ প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যাংক খাতের মুরব্বি বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের অর্থনীতির প্রয়োজনে ব্যাংক খাতের জন্য বিভিন্ন সময় নীতিসহায়তা প্রণয়ন করে থাকে। আবার তার এসব নীতিনির্দেশনা পরিপালনে কোনো ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে কি না তাও দেখভাল করে থাকে। কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সতর্ক করা হয়। প্রয়োজনে নির্দেশনা পরিপালন করার জন্য জরিমানাসহ নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করার হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে। এভাবে যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানতে চায় না, তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দেখে সতর্ক হয়ে যায়। এভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে কি তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারছে ? সাম্প্রতিককালে সুযোগসন্ধানীদের কিছু তৎপরতা উল্লেখ করলে সহজেই এর উত্তর পাবেন পাঠক সমাজ।
সাধারণত দেশের আর্থিক খাতের মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সিআরআর হার কমিয়ে বা বাড়িয়ে থাকে। সিআরআর হলো ব্যাংকগুলো সাধারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করে থাকে তার একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক সংরক্ষণ করে থাকে। এটা মূলত, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও বাজারে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে কাজে লাগে। এ কারণে, বাজারে যখন টাকার প্রবাহ কমে যায়, ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য তহবিলে টান পড়ে তখন মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে সিআরআর হার কমিয়ে দেয়া হয়। আবার বাজারে যখন টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়, তখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সিআরআর হার বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাই সিআরআর হার বাড়ানো বা কমানো সম্পূর্ণ নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতিনির্ধারণী হার বাড়ানো বা কমানোর আগে অনেক বিশ্লেষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। সম্ভাব্য ঝুঁকির দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝিতে এসে শক্তিশালী ব্যাংক পরিচালকরা সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে দিয়ে এটা ১ শতাংশ কমিয়ে নেয়। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, ব্যাংক মালিকদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দেশের একটি পাঁচতারা হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে ডেকে নেয়া হয়। সেখানেই পরিচালকরা অর্থমন্ত্রীকে উপস্থিত রেখে গভর্নরের ওপর সিআরআর হার এক শতাংশ কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। এক শতাংশ সিআরআর হার কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে রাতারাতি ১০ হাজার কোটি টাকা চলে যায়। এতে হতভম্ব হয়ে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। এভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ে ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
ব্যাংক মালিকেরা অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন, সিআরআর হার কমানো হলে ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের নিচে অর্থাৎ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনবেন। কিন্তু তাদের এ ঘোষণা শুধু কাগজে-কলমেই রয়েছে। এ কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মার্চ জাতীয় শিল্পমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, সুদের হার কমালেন না কেন?
এভাবে ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু নির্দেশনা আকারে সেটা জারি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের সিআরআর কমানো, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, পরিচালক সংখ্যা বা পরিচালকদের মেয়াদÑ সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব ঘটনার ফলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পাওয়ার আশায় নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্বল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আবার বড় গ্রুপের ঋণ অনিয়ম বা বেনামি ঋণ ধরতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
বাছবিচার না করে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংক দেয়া নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে আরো তিনটি ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংক না দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়। সর্বশেষ গত বছর দেয়া চিঠিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে অনুমোদিত নতুন ৯টি ব্যাংক বেশির ভাগ শর্ত পালন করতে পারেনি। ব্যাংকগুলো তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসার কথা থাকলেও তা পারেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক দেয়ার বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনা করতে বলা হয়। এর আগে ৯টি ব্যাংক দেয়ার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ব্যাংক দেয়া হবে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায়।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংককে উপেক্ষা করে ঋণখেলাপিদের জন্য নতুন সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এ সুযোগ পাবেন অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি বা অসাধু ঋণখেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
তবে, চলতি মাসের প্রথম দিকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের ঋণ নবায়নের ঢালাও সুবিধা দেয়া হয় ঋণখেলাপিদের। জানা গেছে, এতেও সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্য ছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে রিটের কারণে তা কিছু দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, আরো বেশি কিছু সুবিধা আদায় করে নেয়া হতে পারে। তবে সময় বলে দেবে সুযোগসন্ধানীতের পেট কিসে ভরবে।
ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সরকার। সংশোধিত আইনের আলোকে এক পরিবার থেকে চারজন এবং পরিচালক পদে টানা ৯ বছর থাকার সুযোগ দেয়া হয়। এই সংশোধনীর বিপক্ষে মত দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বলেছিল, এমনটি হলে পরিচালকদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুরূহ হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারা পাঁচবার সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সংশোধিত আইনে দুই মেয়াদে ছয় বছর পরিচালক থাকার বিধান যুক্ত করা হয়। এভাবে প্রভাবশালীরা চাইলেই যেকোনো কিছু পেয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতামতকে পাশ কাটিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেয়ায় দুর্বল হচ্ছে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
এভাবেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। বিনিয়োগ দেয়ার মতো তহবিল ব্যাংকগুলোর হাতে কমে গেছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পূর্ণ প্রতিষ্ঠা জরুরি। সব ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া এখন সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে। সুযোগসন্ধানীদের স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করলে শুধু দেশের ব্যাংকিং খাতই হুমকির মুখে পড়বে না, গোটা অর্থনীতিকেও এর খেসারত দিতে হতে পারে, যা কারো কাছে কাম্য নয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement
কিশোরগঞ্জে কালবৈশাখী ঝড়ে অন্তঃসত্তা মা ও পাঁচ বছরের ছেলের মৃত্যু ঝড়ে পড়ে যাওয়া মাদরাসা ঘর এক মাসেও মেরামত হয়নি গুচ্ছের‘বি' ইউনিটের ফল প্রকাশ, পাশ ৩১ হাজার মানুষের হাত-পা কেটে নিজেই ‘অপারেশন’ করতেন মিল্টন সমাদ্দার : হারুন প্রধানমন্ত্রীর সাথে নারী ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ পরিবেশ রক্ষায় গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আরেক মামলায় ৪ দিনের রিমান্ডে মিল্টন সমাদ্দার জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কারণেই আস্থা অর্জন করেছে সেনাবাহিনী : প্রধানমন্ত্রী ৩ মাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা করে স্বামীর আত্মসমর্পণ ১০ মে’র ডেডলাইনের আগেই সেনা প্রত্যাহার নিয়ে পর্যালোচনা ভারত-মালদ্বীপের রাশিয়ান রকেট হামলায় দোনেৎস্ক অঞ্চলে নিহত ২

সকল