২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পঙ্গুত্ব জয় করে অলিম্পিকের স্বপ্ন

পঙ্গুত্ব জয় করে অলিম্পিকের স্বপ্ন - ছবি : সংগৃহীত

গভীর সাগরের বুকে জাহাজে চড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়াটা খুব প্রিয় ছিল আল আমিন হোসেনের। কিন্তু ছুটিতে বাড়িতে এসে দেয়াল চাপা পড়ে এখন তিনি পঙ্গু। অনলাইন ব্যবসা ছিল রুপালী আক্তারের। অসুস্থ মাকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার সময় রিকশা দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে এখন তার সার্বক্ষণিক সাথী হুইল চেয়ার।

ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে স্ট্রেচার ছাড়া হাঁটতেই পারেন না খোরশেদ আলম। আর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে নিজেদের গাছে ঝুলে থাকা পাকা লিচুর লোভ সামলাতে পারেননি ঝুমা আক্তার। গাছে উঠে সেই লিচু পাড়তে গিয়ে ডাল ভেঙ্গে তারও মেরুদণ্ড ভাঙা। ফলে ঝুমার চলাচলের একমাত্র মাধ্যম এখন হুইল চেয়ার। তবে আকস্মিক পঙ্গু হয়ে যাওয়া এই চার জন হেরে যাননি জীবন যুদ্ধে। সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসার সময় প্যারা আরচারীর সাথে পরিচয়। এরপর এক বছর হলো তারা এখন দেশের প্রতিষ্ঠিত প্যারা আরচার। এই নতুন পরিচয়েই ঝুমা, রূপালী, আল আমিন ও খোরশেদরা ২৯ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক প্যারা আরচারীতে অংশ নিতে। সেখানে ভালো করতে পারলে মিলবে আগস্টে প্যারিসের প্যারা অলিম্পিকে অংশ গ্রহনের ছাড়পত্র। দলটির মধ্যপ্রাচ্য সফরের স্পন্সর কেজিএন মেডিকেয়ার লিমিটেড।

খোরশেদ ও আল আমিন অংশ নেবেন পুরুষদের রিকার্ভে। রূপালী মহিলাদের রিকার্ভে লড়বেন। আর ঝুমা আক্তারের ইভেন্ট কম্পাউন্ড। এই ঝুমাকে ঘিরেই প্যারিস অলিম্পিকে কোটা প্লেসের সুযোগ বাংলাদেশের। সংবাদ সম্মেলনে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্যারা আরচারি অ্যাসোসিয়েশসনের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহসান উল্লাহ।

বাংলাদেশ প্যারা আরচারি অ্যাসোসিয়েশনের এক বছর পূর্তি এবং আরব আমিরাতে যাওয়া উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়।

এটিই ঝুমা-আল আমিনদের প্রথম বিদেশ সফর নয়। গত বছর হ্যাংজু প্যারা এশিয়ান গেমসেও তারা অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে ঝুমা র‌্যাংকিং রাউন্ডে ১৫ তম হলেও পরে নবম হন ২৪ দেশের মধ্যে। রূপালীর অবস্থান ছিল র‌্যাংকিং রাউন্ডে ১৭তম। তার ফাইনাল র‌্যাংকিং ছিল নবম। আর দল গততে সোনিয়া খানমকে নিয়ে হন অষ্টম। সোনিয়া অবশ্য যাচ্ছেন না আমিরাতে। আল আমিন ও খোরশেদের চূড়ান্ত র‌্যাংকিং ছিল ১৭তম।

এবার বাংলাদেশ রিকার্ভ পুরুষ ও মহিলা একক, রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈত এবং কম্পাউণ্ড মহিলা এককে অংশ নেবে।
বাংলাদেশের আরচারির প্রথম দিককার কোচ নিশীথ দাশ। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে তিনি ছিলেন ইমদাদুল হক মিলনের কোচ। এখন তিনি ৯ মাস ধরে প্যারা আরচার দলের কোচ। এই ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কোচের দৃঢ় বিশ্বাস, ঝুমা এখন কম্পাউণ্ডে ৩৬০-এর মধ্যে যে ৩৪৭ স্কোর করছেন তা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাঠে করতে পারলে কোটা প্লেস করতে পারবেন প্যারিস অলিম্পিকের জন্য। ঝুমা শুধু প্যারা আরচারদের মধ্যেই ভালো সেরা নন। দিয়া সিদ্দিকীদের সাথে লড়াই করে র‌্যাংকিং টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ জয় করেন। রিকার্ভে রূপালী ৩১০-৩১৫ পর্যন্ত স্কোর করতে পারছেন। আমিরাতের মাঠ থেকে তিন জনের কোটা প্লেস হওয়ার সুযোগ। সেই সুযোগই কাজে লাগাতে চান ঝুমা, রূপালী, আল আমিন ও খোরশেদরা। অবশ্য এরপর আরো দুটি কোটা প্লেসের সুযোগ আছে চেক রিপাবলিক এবং থাইল্যান্ডে।

চাঁদপুরের ছেলে আল আমিন ছিলেন জাহাজের নাবিক। অস্ট্রেলিয়া, মিসর, ওমান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া ও চীনসহ ১২টি দেশে সফর করেছেন। কিন্তু ২০২২ সালে বাড়িতে ফেরার পর ছাদের সাইড ওয়াল তার শরীরে ভেঙে পড়ায় তার আজ এই দশা। জানান, আমি এখনো জাহাজী জীবনটি খুব মিস করি। বেতনও ভালো পেতাম। জীবন যখন গড়া শুরু করতে যাচ্ছিলাম তখনই দুর্ঘটনা। এখন আমি অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করে ফের নিজেকে প্রমান করতে চাই। যে স্কোর হচ্ছে তাতে আমি আশাবাদী।’ ২০১৮ সালের মার্চে ট্রেনের ছাদে চড়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় বন্ধুকে তারের সাথে ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে খোরশেদ নিজেই সেই তারের ধাক্কা খান। পড়ে যান ট্রেন লাইনের উপর। অবশ্য অন্য লাইনে। তা না হলে ট্রেনেই কাটা পড়তেন। টঙ্গীর একটি ওয়ার্কশপে কাজ করা খোরশেদ এখন আরচারিতে আরো ভালো করে দেশকে কিছু দিতে চান।

২০১৮ সালে লিচু গাছ থেকে পড়ে যান নংরসিংদীর মেয়ে ঝুমা। এরপর মেরুদন্ডের হাঁড় ভেঙে যাওয়ার পর চিকিৎসায় ৮-১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন তার কাছে প্যারা আরচারি ফেডারেশনের যে প্রত্যাশা তা পূরন করতে চান। কোয়ালিফাই করতে চার প্যারিস প্যারা অলিম্পিকে। গাজীপুরে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে মারাত্মক চোট পাওয়া রূপালীর। যে অসুস্থ মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় আহত হন রূপালী তিন মাস সেই মাও মারা যান। আঘাতের পর এই চারজনকেই প্রথমে শুনতে হয়েছিল তোমরা আর দাঁড়াতে পারবে না। আর এখন তারা দেশের সেরা আরচার।

চারজনই জানান, ঘুরে দাঁড়িয়ে আমরা প্রমাণ করেছি আমরাও পারি। বাকিটা প্যারিসের টিকিট নিশ্চিতের অপেক্ষায়।


আরো সংবাদ



premium cement