০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মেজর সিনহা হত্যা

আসামিদের স্বীকারোক্তি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত

সাক্ষ্যে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
-

চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামিরা কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়া সুস্থ দেহে সুস্থ মস্তিষ্কে এবং দীর্ঘক্ষণ চিন্তাভাবনা করে দোষ স্বীকার করেছেন এবং তা যথাযথ আইনি পন্থা অনুসারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ।
ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ গতকাল বুধবার সকালে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে এই মামলার অন্যতম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দেন। তামান্না আরো বলেন, ‘আমি এই মামলার নয়জন আসামিকে পৃথক পৃথকভাবে বলেছি, আমি ম্যাজিস্ট্রেট, আমি পুলিশ অফিসার নই, অর্থাৎ আমি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আসামিদের নিকট আমার পরিচয় দিয়েছি প্রকাশ্যে। আসামিদের প্রত্যেককে সতর্ক করে বলেছি, আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য নন এবং স্বীকারোক্তি দিলে এই স্বীকারোক্তি সাক্ষ্য হিসেবে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে। প্রত্যেক আসামিকে চিন্তাভাবনা করার জন্য তিন ঘণ্টা করে সময় দিয়েছি। অতঃপর আসামিরা সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে স্বীকারোক্তি দিলে আমি তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ এবং ৩৬৪ ধারার বিধান মতে রেকর্ড করি।’ আসামিরা তাদের স্বীকারোক্তিতে একাধিক স্বাক্ষর প্রদান করেন।
তামান্না ফারাহ আরো জানান, ‘প্রতিবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়ার সময় কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আরএমও কর্তৃক আসামিদের শারীরিক পরীক্ষার সনদ আমি দেখেছি এবং উক্ত সনদ মামলার নথিতে আছে।’ অতঃপর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাকে ব্যাপক জেরা করেন এবং তিনি প্রত্যেক প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব দেন। ষষ্ঠ দফায় গতকাল তৃতীয় দিনে সাক্ষী হিসেবে অপর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন শামীমও আদালতে জবানবন্দী দেন এবং তাকেও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ব্যাপক জেরার মুখোমুখি হতে হয়। গতকাল জবানবন্দী দেয়ার জন্য ছয়জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করা হলেও দীর্ঘ জেরার কারণে দুইজন ছাড়া অন্যদের জবানবন্দী নেয়া সম্ভব হয়নি। একটানা সন্ধ্যা ৭টায় আদালতে দিনের কার্যক্রম শেষ হয়।
ইতঃপূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ তার আদালতে এই মামলার নয়জন আসামি ও চারজন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণ করেন এবং প্রত্যেকের জবানবন্দী সঠিক পন্থায়, যথাযথ বিধি ও আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে হাইকোর্টের এম-৮৪ ফরমে লিপিবদ্ধ করেছেন বলে তিনি আদালতে জানান। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আদালতে তিনি জবানবন্দী ও জেরার জবাব দেন। প্রতিবার জেরার জবাবে এ বিষয়ে তিনি অবিচল ও অটল ছিলেন। বিকেল ৫টার পরে তিনজন আসামি এবং দুইজন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণ করা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন শামীমও আদালতে সাক্ষ্য দেন। ইতঃপূর্বে এই দুই ম্যাজিস্ট্রেট সিনহা হত্যা মামলার ১৫ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আসামির এবং ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ছয়জন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী গ্রহণ করেছিলেন। মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন শামীম ও তামান্না ফারাহ কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হিসেবে কর্মরত আছেন। তামান্না ফারাহ এই মামলার ৭৬ এবং দেলোয়ার হোসেন ৭৭ নম্বর সাক্ষী।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটির আইনজীবী এবং পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, সময় স্বল্পতার কারণে গতকাল আদালতে উপস্থিত হওয়া অপর চারজন সাক্ষী তৎকালীন টেকনাফ থানায় এই মামলা রেকর্ডকারী ওসি এস দোহা, তৎকালীন ডিবি পুলিশের ওসি মানস বড়ুয়া, জব্দ তালিকার সাক্ষী পুলিশের এসআই কামাল হোসেন ও কনস্টেবল মোশাররফ হোসেনের জবানবন্দী নেয়া সম্ভব হয়নি। আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৫ নভেম্বর থেকে পরবর্তী তিন দিন ধার্য করেছেন। গতকাল জবানবন্দী গ্রহণের সময় অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী, এপিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদও উপস্থিত ছিলেন।
অন্য দিকে আসামিদের পক্ষে আদালতে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার দাশ, অ্যাডভোকেট শামশুল আলম, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া, অ্যাডভোকেট চন্দন দাশ প্রমুখ আইনজীবী জেরা করেন। বুধবার সকালে মামলার ১৫ জন আসামিকেও কড়া নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করা হয়। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদি হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ আলোচিত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন র্যাব-১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement