২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আরো ৩ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বিদায়

-

সামান্য সময়ের ব্যবধ্যানে চিরবিদায় নিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আরো তিন ব্যক্তিত্ব। তারা হলেনÑ নায়ক ওয়াসিম, অভিনেতা এস এম মহসিন ও সাংবাদিক চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী উপস্থাপক শফিউজ্জামান খান লোদী।
গত শনিবার রাত ১২টা চল্লিশ মিনিটে ইন্তেকাল করেন নায়ক ওয়াসিম। ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়া এ অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। অন্য দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ১৩ দিন পর গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় মারা যান অভিনেতা এস এম মহসিন। তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। এর কয়েক ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টায় করোনা আক্রান্ত শফিউজ্জামান খান লোদী মারা যান।
এ নিয়ে গত ১৮ দিনে সংস্কৃতিক অঙ্গনের ৯ বরেণ্য ব্যক্তির মৃত্যু হলো। অন্যরা হলেন, নির্মাতা সাজেদুল আউয়াল, সঙ্গীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ও নির্মাতা মাসুদ কায়না ও অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। অভিনেতা ওয়াসিম বেশ কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হাঁটতে পারতেন না বলে বিছানায় শুয়ে-বসে দিন কাটত তার। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপ ও চোখের জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন। শনিবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাত ১১টার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ১২টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সবমিলিয়ে ১৫২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন ওয়াসিম। অন্য দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ১৩ দিন পর গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় মারা যান অভিনেতা এস এম মহসিন। তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
গতকাল বাদ জোহর বনানী কবরস্থানে ওয়াসিমের দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করা ওয়াসিমের লাশ রাতেই গোসল দিয়ে ফ্রিজিং গাড়িতে রাখা হয়। এরপর বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বনানী কবরস্থান সংলগ্ন মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় ওয়াসিমের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-বন্ধু স্বজনরা ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানসহ চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
১৯৫০ সালের ২৩ মার্চ চাঁদপুর জেলার আমিরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াসিম। তার পারিবারিক নাম মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ। ওয়াসিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি বডি বিল্ডার হিসেবে নাম করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বডি বিল্ডিংয়ের জন্য মি. ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করেছিলেন।
১৯৭২ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এস এম শফীর সাথে তার পরিচয় হয়। শফীর আগ্রহেই ১৯৭২ সালে তার পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হন তিনি। এতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। ওয়াসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলোÑ দ্য রেইন, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, দোস্ত দুশমন, মানসী, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, ইমান, রাতের পর দিন, আসামি হাজির, মিস লোলিতা, রাজ দুলারী, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন, জীবন সাথী, রাজনন্দিনী, রাজমহল, বিনি সুতার মালা, বানজারান, মিস লোলিতাসহ দেড় শতাধিক সুপার হিট ছবির নায়ক এই কিংবদন্তি অভিনেতা। ১৯৭৪ সালে আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মোহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার। চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান তিনি।
দর্শকনন্দিত এই অভিনেতার নামেই ’৭০ আর ৮০’র দশকে সিনেমা হলে উপচে পড়ত দর্শক। এ দিকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানিয়ে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা এস এম মহসিনকে। গতকাল বেলা ২টা ৪০ মিনিটে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। তারপর পরীবাগ মসজিদে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। সম্প্রতি পাবনায় একটি সিনেমার শুটিং থেকে ফিরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিনেতা এস এম মহসিন। ৫ এপ্রিল তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় তার করোনা ধরা পড়ে। ১০ এপ্রিল শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। টানা সাত দিন তিনি আইসিইউতেই ছিলেন।
এস এম মহসিন প্রায় চার দশক ধরে মঞ্চ ও টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। শিল্পকলায় (অভিনয়) অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এস এম মহসিনের ছেলে রেজওয়ান জানান, তার বাবা টাঙ্গাইল অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে নানা অভিমানে কখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট নিতে চাননি। তবে শেষ বয়সে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দেয়া হয়।
এস এম মহসিন ভারতের দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় (এনএসডি) পড়াশোনা করেছেন। তিনি আতিকুল হক চৌধুরী পরিচালিত ‘রক্তে ভেজা’ ও ‘কবর’ এবং মুনীর চৌধুরী পরিচালিত ‘চিঠি’ ছাড়াও বহু টিভি, মঞ্চ ও রেডিও নাটকে অভিনয় করেছেন। ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলোশিপ লাভ করেন তিনি। কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন শিল্পকলা পদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা।
সাংবাদিক, সংগঠক এবং উপস্থাপক শফিউজ্জামান খান লোদী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে গত সপ্তাহে তাকে জাপান ইস্ট ওয়েস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে প্রথমে তাকে আইসিইউ এবং পরে লাইফ সাপোর্টে দেয়া হয়। এ অবস্থায় গতকাল দুপুরে তিনি ইন্তেকাল করেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাণোচ্ছল লোদী ছিলেন সাংবাদিক, বাচসাসের সদস্য, উপস্থাপক, চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সংগঠক। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পাশাপাশি শফিউজ্জামান খান লোদী বেতার ও টিভির উপস্থাপক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আমার ছবি’র উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। গতকাল বাদ আসর উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে শফিউজ্জামান খান লোদীর দাফন সম্পন্ন হয়।


আরো সংবাদ



premium cement