২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বপ্ন ছোঁয়ার উৎসব নবান্ন

-

... ‘এ দেহ অলস মেয়ে/ পুরুষের সোহাগে অবশ/ চুমে লয় রৌদ্রের রস/ হেমন্ত বৈকালে/ উড়ো পাখপাখালির পালে/ উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ/ অঘ্রাণের মাঝরাতে।’ ...
জীবনানন্দ দাশের ‘পিপাসার গান’ কবিতার সেই অগ্রহায়ণ বিরাজ করছে বাংলার প্রকৃতিতে। গ্রামবাংলায় নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দ ছড়িয়ে দিতেই পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বাংলাদেশে প্রচলিত উৎসবগুলোর মধ্যে নবান্ন অন্যতম। নবান্ন উৎসবের সাথে মিশে আছে এদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ‘শস্য কর্তন’ ‘আমন পার্বণ’ ‘নবান্ন উৎসব’ একই সুতায় গাঁথা। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব। নবান্ন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আছে অনেক অনুষ্ঠান। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। হেমন্তের শিশিরস্নাত ভোরে ধানগাছের ডগায় জমে থাকে শিশিরবিন্দু। মাঠে মাঠে রবি শস্যের সমাহার যেমন প্রকৃতির রূপ শোভা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি মানুষের স্বপ্ন পূরণেরও প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলার আবহমান ষড়ঋতুর হিসাবে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দু’মাস হেমন্ত। হালকা শীতের হাওয়ায় দোলায় বন, বনানীর চিরলপাতায় মৃদু কাঁপন নিয়ে আসে হেমন্ত। এ এমন এক চমৎকার ঋতু; না শীত, না গরম। হেমন্তের রুপালি শিশির বিন্দুর সমাহার চোখে পড়তে শুরু করেছে গাছের চিরলপাতায়, মাঠভরা সবুজ ধানের শীষে। আমাদের প্রধান ফসল ধান পেকে মাঠের পর মাঠ যেন সোনালি-হলুদ রঙে সেজে ওঠে হেমন্তে। কৃষকের মুখে দেখা দেয় এক অনাবিল হাসি।
হেমন্ত যেন রূপের মাঝে অপরূপ। বৃষ্টিহীন আকাশে সকালের সোনালি সূর্য। আর সে শোভাকে আরো রূপ লাবণ্যে মোহনীয় করে অগ্রহায়ণের সোনালি ধানের রঙে। পাকা সোনালি ধানের হিমেল দোলায় চার দিকে ঢেউয়ের তরঙ্গ। ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি’। কৃষকদের ধানের মাঠে চোখ পড়লেই মনে পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এই জাতীয় সঙ্গীতের কথা। এ হাসি অন্তরের, এ হাসি প্রাণের। দেশের খেটে খাওয়া কৃষকের মুখে ফোটে সে অনাবিল হাসি। প্রতি ঘরে ঘরে আনন্দের সাথে চলে ধান মাড়াইয়ের কাজ। কৃষাণী মায়েরা কুলোতে ওড়ায় সোনালি ধান। আর তাদের হাতেই তৈরি হয় নবান্নের পিঠা, পায়েস, পুলি। বাংলার এসব জীবনগ্রাহী ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ করেছে এ বঙ্গকে।
মানিকগঞ্জে উৎসবমুখর পরিবেশে মাঠে মাঠে চলছে রোপা আমন ধান কাটা। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় সোনালি ধান মাড়িয়ে গোলায় ভরতে শুরু করেছেন কৃষকরা। জেলার সাতটি উপজেলার মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়ায় কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বসে নেই কৃষাণীরাও। সেই সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবাই। এ বছর বাম্পার ফলন হওয়ায় তাদের চোখে-মুখে এখন তাই তৃপ্তির হাসি। যদিও আগের দিনের মতো এখন আর শীতের সকালে পিঠা আর রকমারি আয়োজন করে নবান্ন উৎসব পালিত হয় না। তারপরও এ বছরে অগ্রহায়ণের সেই ঐতিহ্য কিছুটা হলেও কৃষকের ঘরে লক্ষ করা যাচ্ছে। আবহমান বাংলার শাশ্বত অগ্রহায়ণ মাসকে বরণ করতে কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। প্রতিটি কৃষকের ঘরে চলছে অগ্রহায়ণের ধান কাটার পূর্ণ প্রস্তুতি।
ঘিওর উপজেলার কেল্লাই এলাকার কৃষক মনোরঞ্জন মণ্ডল জানান, এ বছর তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে রোপা আমনের চাষ করেছেন। জমি তৈরি, সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষিশ্রমিক সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। তবে বাজার ভালো থাকলে খরচ বাদে বিঘাপ্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা লাভ করা যাবে। একই উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের আরেক চাষি মুন্নাফ মিয়া জানান, এ বছর বন্যায় ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। তবে কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেশি থাকায় এ বছর খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
কৃষি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিক’র মানিকগঞ্জ জেলা সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, এককালের আবহমান গ্রামবাংলায় হেমন্তই ছিল উৎসব-আনন্দের প্রধান মৌসুম। ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ আর ধান ভানার গান ভেসে বেড়াতো বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখর হতো বাড়ির আঙিনা। এখন তো প্রযুক্তির কল্যাণে নানা যন্ত্রপাতির আবির্ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব।
বিশিষ্ট পরিবেশ আন্দোলন নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জি বলেন, নবান্ন আর পিঠাপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হতো সবাই। রুটি পিঠা বা শিরনির প্রচলন ছিল একসময় গ্রামবাংলায়। নতুন ধানের চালের গুঁড়ি দিয়ে গোলায় তোলা ধানশূন্য ক্ষেতে নাড়ার আগুনে পুড়ে বিশেষ পদ্ধতিতে এই পিঠা তৈরি করা হতো। পিঠা তৈরির পর সবার মধ্যে বিতরণ করা হতো শিরনি আকারে।
জানা গেছে, সম্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকা তৈরির সময় অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ‘অগ্র’ এবং ‘হায়ণ’Ñ এ দুই অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুুম’। বর্ষার শেষদিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে পরিপক্ব হয় ধান। অগ্রহায়ণে ফসল ঘরে তোলা হয়। বলা হয়ে থাকে, মরা কার্তিকের পর আসে সার্বজনীন লৌকিক উৎসব ‘নবান্ন’। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘শস্যোৎসব’।
প্রসঙ্গত, মানিকগঞ্জ জেলায় পাঁচটি মূল পরীক্ষণ প্লটে কৃষক নেতৃত্বে মাঠ গবেষণা চলছে। বর্তমানে গবেষণায় মোট জাত ২১৫টি, তন্মধ্যে আমন মৌসুমের ১৪৯টি এবং বোরো মৌসুমের ৬৬টি। বর্তমানে ২৪টি ধানজাত নির্বাচন গবেষণায়, ১৩টি জাত বর্ধন গবেষণায় এবং ১৭৮টি জাত সংরক্ষণে রয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমন মৌসুমের জাতগুলো হলোÑ আমশাইল, লক্ষ্মীদিঘা, কাঁচকলম, নোয়াটি, আজলদিঘা, মোল্লাদিঘা ও হিজলদিঘা ইত্যাদি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহ-পরিচালক মো: আশরাফ উজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে ১৩ হাজার ২১২ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের চাষ হয়েছে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৭৮৬ হেক্টর। দ্বিতীয় দফা বন্যার কারণে কৃষকদের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে এ বছর ফলন কিছুটা ভালো হওয়ায় কৃষকরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু সুলতান মাহমুদকে বাঁচাতে সাহায্যের আবেদন গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় নিহত ১৫ মুজিবনগরে ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১৩ বাগেরহাটের রামপালে ট্রাকের চাপায় নিহত ৩ ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব আফ্রিকায় প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা, কমপক্ষে ১৫৫ জনের প্রাণহানি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন উগ্র ইসরাইলি মন্ত্রী শেরে বাংলার সমাধিতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন হাত কাটা বন্দীর নেতানিয়াহুর সমালোচনা ইসরাইলের আলটিমেটাম, যা বলল হামাস

সকল