রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করে এতে স্বচ্ছতা চায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ ছাড়াও এদের প্রত্যাবাসনে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুষ্ঠানে সংস্থাটি এ সুপারিশ করে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম এবং আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহনুর রহমান এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
গবেষণায় বলা হয়, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। সরকারি অংশীজনের মধ্যে এনজিও কার্যক্রমের তদারকিতে জেলা প্রশাসন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং (রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন কাউন্সিল) আরআরআরসি কার্যালয় একই ভূমিকা পালন করে। এর ফলে এনজিওগুলোর প্রকল্প কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন ও ছাড়পত্র পেতে এবং ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে দীর্ঘসূত্রতা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ক্যাম্প পর্যায়ে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কাজের পুনরাবৃত্তি ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত একবারও প্রয়োজনের বিপরীতে সম্পূর্ণ অর্থ পাওয়া যায়নি। এ তিন বছরে প্রয়োজনের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ যথাক্রমে ৭৩, ৬৯ ও ৫৫ শতাংশ। ফলে খাতভিত্তিক মৌলিক চাহিদা পূরণে (বিশেষত খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, পানি ও স্যানিটেশন, আশ্রয় ও সাইট ব্যবস্থাপনা) সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর মধ্যেই আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সঙ্কটের গুরুত্ব কমে আসছে, ফলে অর্থসহায়তা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে মানবিক ত্রাণ কর্মসূচি সঙ্কুচিত হয়ে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বিদ্যমান। ৩৪টি ক্যাম্পের মধ্যে দু’টি নিবন্ধিত ক্যাম্প ছাড়া বাকিগুলোতে সিআইসির অধীনে নিরাপত্তা কর্মী নেই। বিভিন্ন ক্যাম্পে কমপক্ষে সাতটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। দালাল চক্রের সহায়তায় টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অন্য দিকে ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আর্থিকভাবে সচ্ছলদের একাংশকে স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় জনগণের সাথে মূল স্রোতে মেশার সুযোগ করে দেয়া এবং তাদের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অংশীজন কর্তৃক নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদনে (এফডি-৭) দীর্ঘসূত্রতা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ ও উপঢৌকন দাবির অভিযোগ রয়েছে। ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ভিন্ন ভিন্ন যাচাই ব্যবস্থার কারণে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ সময়ক্ষেপণেরও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্প পর্যায়ে এফডি-৭ এবং জাতিসঙ্ঘের অনুদানে কার্যক্রম পরিচালনায় স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর একাংশের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাগত জানানো হলেও এর ফলে বাংলাদেশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বাংলাদেশ সরাসরিভাবে আর্থিক বোঝার পাশাপাশি বহুমুখী আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তাই সরকারের উচিত হবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে এ সমস্যার বহুমুখী সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন প্রাক্কলন করা এবং তার ওপর ভিত্তি করে পর্যাপ্ত সম্পদ ও সক্ষমতা অর্জনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য ১৩ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় এফডি-৭ এর আওতায় প্রকল্পগুলোকে বিশেষ ও জরুরি হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরুর অনুমতি ও ছাড়পত্র প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তে আরআরআরসির মাধ্যমে করতে হবে; ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় আরআরআরসির জনবল বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতিটি সিআইসির আওতায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে; মানবিক সহায়তায় খাতভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিতে জাতিসঙ্ঘের অঙ্গসংগঠনসহ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যয়সহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব নিরূপণ করে তা মোকাবেলায় কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তার অর্থায়নসহ বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে; মানবিক সহায়তায় প্রকল্প, অর্র্থ ব্যয়ের বিভিন্ন খাত, বাস্তবায়নের স্থান ও অগ্রগতিবিষয়ক তথ্য একটি সমন্বিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে এবং তা হালনাগাদ করতে হবে; কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে; মানবিক সহায়তায় কার্যক্রম ও কর্মসূচি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত অভিযোগ নিরসনে আরআরআরসি কার্যালয়ে কাঠামোবদ্ধ ‘অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন ব্যবস্থা’ চালু করতে হবে; রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র, জাতিসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিশ্চিত করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।