সৌদি আরবে পাড়ি জমানো নারী শ্রমিকদের অভিযোগের যেন অন্ত নেই। নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ আর অভিযোগ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো বেশ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি, বিদেশে নারী শ্রমিকদের নিয়োগকর্তা ও তার লোকদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই ওই দেশে থাকা নারী কর্মীদের দ্রুত নিয়োগকর্তার হাত থেকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বলা হচ্ছে। পরে দূতাবাস থেকেও তদন্ত করে অনুরোধ করা হচ্ছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দূতাবাস কর্মকর্তারা জানতে পারছেন, ঢাকা থেকে যে ধরনের অভিযোগ দেয়া হচ্ছে তার কোনো সত্যতা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনটাই দাবি করা হচ্ছে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইং থেকে পাঠানো একাধিক প্রতিবেদনে। তবে এমন ঘটনা হাতেগোনা বলে মনে করছে জনশক্তি রফতানিবিষয়ক অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
গত ১২ জুলাই প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও উন্নয়ন) উপসচিব মো: জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সৌদি আরবে নির্যাতিত ৮ বাংলাদেশী নারী কর্মীকে দেশে ফেরত আনতে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন। ওই ৮ জনের অভিযোগের সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হলে একাধিক এজেন্সির মালিক অভিযোগকে মিথ্যা বলে দাবি করছেন। আবার কেউ বলছেন, তারা সৌদি আরব থেকে নারী কর্মীকে নিজ খরচে দেশে ফেরত আনতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
এর আগে জেদ্দার শ্রম উইং থেকে পাঠানো ইমেইল বার্তায় বলা হয়েছে, মেসার্স মিথিলা ওভারসীজ এবং মেসার্স নগর ওভারসীসের মাধ্যমে ঢাকার কাশেম বেপারীর মেয়ে মিসেস সাগরিকা সৌদি আরবের আসির প্রদেশের আবহা শহরে সৌদি নিযোগকর্তার অধীনে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগদান করেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর নিয়োগকর্তা মিসেস খাদরা হোসাইন নাসেরের ছেলে নাসেরের মোবাইলের মাধ্যমে ২৫ জুন কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে গৃহকর্মীর সাথে কথা বলে তার খোঁজখবর জানা যায়। গৃহকর্মী সাগরিকা জানান, তিনি প্রায় এক বছর ধরে নিয়োগকর্তার বাসায় কাজ করছেন। নিয়োগকর্তা নিয়মিত বেতন পরিশোধ করেন না এবং কাজের অত্যধিক চাপের কারণে তিনি দেশে ফেরত আসতে চান।
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োগকর্তাকে জানালে তিনি দ্বিমত পোষণ করে বলেন, গৃহকর্মীর অভিযোগ সত্য নয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বাংলাদেশে যেতে হলে ভিসা ও ভিসার আনুষঙ্গিক খরচ পরিশোধ করে তাকে যেতে হবে মর্মে নিয়োগকর্তা দাবি করেন। গৃহকর্মী সাগরিকাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স ফোর নাস অফিসের স্বত্বাধিকারী মি. আলী সাইদ আলশাহরানীকে অনুরোধ জানানো হলে তিনি নিয়োগকর্তার সাথে সমঝোতা করে ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তারপরও ঢাকার মিথিলা ও নগর ওভারসীজকে সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সি অফিসের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেদ্দার কাউন্সিলর (স্থানীয়) মো: আলতাফ হোসেন তার চিঠিতে উল্লেখ করেন।
একইভাবে তিনি অপর অভিযোগকারী বাংলাদেশী গৃহকর্মী বিলকিস বেগমের দেশে ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন এভিয়েট ইন্টারন্যাশনাল থেকে পাঠানো নারী শ্রমিক বিলকিস বেগমকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ সংবলিত পত্রের আলোকে যোগাযোগ করে জানা যায়, বিলকিস বেগম দেড় বছর আগে সৌদি আরবের তাঁবুতে যান। পত্রে উল্লিখিত নারী গৃহকর্মীর মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি নিয়োগকর্তার বাসায় কাজ করছেন। নিয়মিত মাসিক ৮০০ রিয়াল করে বেতন পাচ্ছেন এবং খাওয়া-দাওয়াসহ অন্য কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তার স্বামীর মৃত্যুর কারণে তিনি বাংলাদেশে ফেরত আসতে চান বলে তাকে জানান।
এ প্রসঙ্গে এভিয়েট ইন্টারন্যাশনালের মালিক নুরুল আমিন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবে থাকা গৃহকর্মী বিলকিস বেগম নির্যাতিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। যার কারণে তিনি দেশে চলে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু দূতাবাস থেকে যে রিপোর্ট প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এসেছে সেটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সে ভালো আছে, বেতনও পাচ্ছে। এখন বলেন, এর জন্য আমি কী করতে পারি? তার স্বামী মারা গেছে এমনটি জানালে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা কথা।
একইভাবে ৮ নারী অভিযোগকারীর মধ্যে সৌদিয়া রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক গোলাম নবী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা নারী শ্রমিক পাঠিয়ে দেশে রেমিট্যান্স আনছি। তারপরও যখন তখন আমাদের বিরুদ্ধে বিদেশে যাওয়া নারী এবং তাদের স্বজনরা মনগড়া অভিযোগ দিচ্ছেন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, যে মহিলা দেশে ফেরত আসতে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন তিনি তো ইতোমধ্যে ছুটিতে দেশেই এসে পড়েছেন। এখন এর উত্তর কে দেবে? তবে আল আমানা এস্টাব্লিস্টমেন্ট , আল জুবাইলি ইন্টারন্যাশনাল, আল ফাতিন ইন্টারন্যাশনাল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ওভারসীজ ও মোহনা ওভারসীজ থেকে পাঠানো নারী শ্রমিকদের দেশে ফেরত আনা হয়েছে কি না সে প্রসঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সর্বশেষ অবস্থা জানাতে পারেননি। তবে আল আমানা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলছেন, তাদের সাথে দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট ও গৃহকর্মীর স্বজনদের যোগাযোগ হয়েছে। এ নিয়ে কোনো কিছু লেখার দরকার নেই। গতকাল জনশক্তি রফতানির সাথে জড়িত বায়রার সাবেক নেতা নয়া দিগন্তকে নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, আসলে নারী শ্রমিকরা বিদেশে যাচ্ছে স্বেচ্ছায়।
এরপর সেখানে যাওয়ার পর কী হচ্ছে সেটি অবশ্যই দেখার দায়িত্ব ওই দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর। কিন্তু তারা এই বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না দেয়ার কারণে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় সৌদি আরবে গৃহকর্মী বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন বলে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন। তবে প্রতিটি অভিযোগই দূতাবাস, মন্ত্রণালয় ও ব্যুরোর খতিয়ে দেখা উচিত এবং আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। উল্লেখ্য বাংলাদেশ থেকে ৫৩০টি রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে শুধু নারী শ্রমিক পাঠানোর ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে।