০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ইলন মাস্কের স্বপ্নের মহাকাশযান স্টারশিপ যে কারণে উড়তে পারেনি

ইলন মাস্কের স্বপ্নের মহাকাশযান স্টারশিপ যে কারণে উড়তে পারেনি। - ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীতে তৈরি হওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট ‘স্টারশিপ’ প্রথম মনুষ্যবিহীন যাত্রা শুরু করতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করেছে।

কথা ছিল এটি স্থানীয় সময় সোমবার সকালে মেক্সিকো উপসাগরের তীরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের বোকা চিকা থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে । তারপর এটির ওপরের অংশটি পূর্ব দিকে যাবে এবং পৃথিবীর প্রায় পুরো চারপাশ জুড়ে একবার প্রদক্ষিণ করে সাগরে নেমে আসবে।

প্রায় ১২০ মিটার বা ৪০০ ফুট উঁচু এই বিশালকায় রকেটটি তৈরি করেছে মার্কিন উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি।

মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী এ রকেট উৎক্ষেপণের সময় যে উর্ধমুখী চাপ বা ‘থ্রাস্ট’ তৈরি হবে, তার পরিমাণ এ পর্যন্ত যত রকেট তৈরি হয়েছে- তার প্রায় দ্বিগুণ।

কিন্তু উৎক্ষেপণের কয়েক মিনিট আগে জানানো হয়, রকেটটি তরল গ্যাসের জ্বালানির সঠিক চাপ রক্ষা করে এমন একটি ভালভ জমে গিয়েছে এবং ঠিকমত কাজ করছিল না।

তাই কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে উৎক্ষেপণ পিছিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ইলন মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে জানিয়েছেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এটি আবার উৎক্ষেপণের চেষ্টা করা হবে।

কেন এত সাবধানতা?
বিশ্বের এখন পর্যন্ত বৃহত্তম রকেট উৎক্ষেপণ দেখতে বোকা চিকায় কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। আরো লাখ লাখ মানুষ বসেছিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে, টিভির সামনে।

কিন্তু এটি শুধু বৃহত্তম রকেটই নয়, প্রথম পুনর্ব্যবহারযোগ রকেটের প্রথম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণও বটে। এটি ব্যর্থ হলে মানুষের অন্য গ্রহে যাওয়া ও বসতি স্থাপনের একটি বাহন তৈরির এই উদ্যোগ এক বড় ধাক্কা খেত।

তাই স্পেসএক্স এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

সম্ভবত তাই উৎক্ষেপণের আগেই ইলন মাস্ক সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, লোকে যেন এই প্রথম উৎক্ষেপণ থেকে খুব বেশি কিছু আশা না করে। কারণ এসব রকেটের প্রথম যাত্রায় কিছু না কিছু একটা সমস্যা দেখা দেয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

টুইটারে ইলন মাস্ক বলেন, ‘এটি হচ্ছে একটি বিশালকায় এবং বেশ জটিল রকেটের প্রথম উৎক্ষেপণ, তাই এটি হয়ত না-ও সফল হতে পারে। আমরা খুব সতর্ক থাকব। যদি কোনো কিছু নিয়ে আমাদের উদ্বেগ থাকে, আমরা এই উৎক্ষেপণ স্থগিত করে দেব।’

সোমবারের এ যাত্রায় রকেটটিতে কোনো মানুষ আরোহী বা ক্রু হিসেবে ছিল না।

পুনর্ব্যবহারযোগ্য এক ‘বৈপ্লবিক’ রকেট
ইলন মাস্ক আশা করছেন, স্টারশিপের মাধ্যমে রকেট ব্যবসাকে তিনি সম্পূর্ণ পাল্টে দেবেন। কারণ, এ রকেট তৈরি হয়েছে এমনভাবে যে তা পুরোপুরি এবং দ্রুত আবার ব্যবহার করা যাবে।

ইলন মাস্কের স্বপ্ন, অন্য গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন করতে যাওয়ার উপযোগী রকেট তৈরি করা। যা বার বার ব্যবহার করা যাবে এবং একেকবারে ১০০ জনের বেশি মানুষকে মঙ্গলগ্রহে নিয়ে যেতে পারবে। এর উপযোগী করেই বানানো হয়েছে এই স্টারশিপ রকেটযানকে।

এই রকেট এখন তৈরি এবং এর পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ যদি সফল হয়, তাহলে তা হবে এক বিরাট অগ্রগতি।

রকেটটির দু’টি অংশ- একটি হচ্ছে ‘সুপার হেভি’ নামে তরল গ্যাসের জ্বালানিচালিত রকেট। আর অপরটি হলো ‘স্টারশিপ’ নামের মহাকাশযানটি- যা এই ‘সুপার হেভি’এর ওপর বসানো থাকবে।

কেন মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন করতে চান ইলন মাস্ক?
ইলন মাস্ক মনে করেন, এই যানের মাধ্যমে এমন এক যুগ শুরু হতে পারে যখন সাধারণ মানুষের পক্ষে এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে ভ্রমণ করা সম্ভব হবে।

তিনি মনে করেন, মঙ্গলের মতো অন্য গ্রহে যদি মানুষের বসতি স্থাপন করা যায়, তাহলে পৃথিবীতে কোনো গ্রহাণুর আঘাতের মতো বিপর্যয় দেখা দিলেও মানুষের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা যাবে।

তিনি বলেন, ‘তখন মানুষের ইতিহাস দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। একটা হলে আমরা চিরকাল পৃথিবীতে বাস করতে থাকলাম এবং তারপর কোনো একদিন সবকিছু ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মতো একটা ঘটনা ঘটে গেল। আরেকটা বিকল্প হলো, আমরা একটা মহাশূন্যে ভ্রমণরত সভ্যতা ও একাধিক গ্রহে বসবাসরত প্রজাতিতে পরিণত হলাম। আমার মনে হয় আপনি একমত হবেন যে এটাই সঠিক পথ।’

পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট মানে কী?
ইলন মাস্ক মনে করছেন, তিনি এমন রকেট তৈরি করাচ্ছেন যা মানুষ ও উপগ্রহকে প্রতিদিন কয়েকবার করে কক্ষপথে নিয়ে যাবে- ঠিক যেভাবে একটি জেট বিমান আটলান্টিকের এপারে-ওপারে প্রতিদিন যাত্রী আনা-নেয়া করে।

এই রকেট সিস্টেমকে বলা হচ্ছে সম্পূর্ণ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এর অর্থ হলো- এই সিস্টেমের প্রধান হার্ডওয়্যার অংশগুলো ফেলে দেয়া হবে না বা রকেটের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুড়ে ছাই হয়ে যেতেও দেয়া হবে না। যেমনটা সাধারণ রকেটের বেলায় হয়ে থাকে।

এই স্পেসএক্সের এই রকেটের সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য হবে এমন যে এর প্রধান হার্ডওয়্যারগুলো মাটিতে ফিরে আসবে এবং তাদেরকে আবার ওড়ানো যাবে।

শুধু তাই নয় এই পুনর্ব্যবহার হবে ‘র‍্যাপিড’ বা দ্রুত।

স্টারশিপে আবার রকেট জ্বালানি ভরা যাবে এবং অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তা আবার উৎক্ষেপণের জন্য তৈরি হয়ে যাবে- ঠিক একটা উড়োজাহাজের মতো। এর ফলে এই পুরো প্রকল্পের খরচও কমে যাবে।

নতুন রকেট জ্বালানি মেথালক্স
স্টারশিপ মহাকাশযান ও তার রকেট সুপার হেভি- এই দু’টি যখন একটি আরেকটির ওপর বসবে তখন তার মোট উচ্চতা হবে ১২০ মিটার বা ৩৯৪ ফুট। উচ্চতার দিক থেকে এটি পৃথিবীর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রকেট।

স্যাটার্ন ফাইভ- যে রকেট দিয়ে মানুষ চাঁদে গিয়েছিল, তার উচ্চতাও এর চেয়ে কম।

স্টারশিপ মহাকাশযানটির দিকে তাকালে দেখা যায়, এটির কৌণিক অংশটির ডিজাইন ও তাতে ফিন বা পাখনা যোগ করায় এটির চেহারা অনেকটা কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর স্বর্ণযুগের রকেটশিপের সাথে মিলে যাচ্ছে। এতে করে বেশি মালপত্র বা অনেক মানুষকে এক সাথে মহাশূন্য নিয়ে যাওয়া যাবে।

এটি ৫০ মিটার বা ১৬০ ফিট লম্বা, আর সাথে যুক্ত হয়েছে ছয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী র‍্যাপ্টর ইঞ্জিন।

এক দশক ধরে বহু গবেষণার পর এটি তৈরি করেছে স্পেসএক্স।

এতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তরল মিথেন, যা তরল অক্সিজেনের সহায়তায় জ্বলে। এক সাথে এ দুটিকে বলা হচ্ছে মেথালক্স।

সুপার হেভি নামের ৭০ মিটার বা ২৩০ ফিট লম্বা রকেটটিতে অতি শীতল অবস্থায় ভরা হবে এই মেথালক্স।

উৎক্ষেপণের পর যা ঘটবে
স্টারশিপের ওপরের অংশটি ইতোমধ্যে ছোট আকারে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে নিচের অংশ অর্থাৎ সুপার হেভি-সহ উৎক্ষেপণের প্রয়াস এবারই প্রথম।

যদি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি উৎক্ষেপণের চেষ্টা করা হয়, তাহলে যা ঘটবে তা হলো এ রকম :

স্পেসএক্স আশা করছে সবকিছু ঠিক থাকলে ৯০ ভাগ থ্রাস্ট পাওয়া যাবে এবং এতে ৭০ মেগানিউটন শক্তি সৃষ্টি হবে। এ শক্তি ১০০টি কনকর্ড সুপারসনিক বিমান আকাশে ওড়াতে যতটা শক্তি লাগবে তার সমতুল্য।

সবকিছু ঠিকঠাক চললে স্টারশিপ ওপর দিকে উঠবে এবং তারপর মেক্সিকো উপসাগরের ওপর দিয়ে উড়বে। এর বুস্টার রকেটের ৩৩টি ইঞ্জিন জ্বলবে দুই মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে জন্য।

এরপর রকেটটি দু’ভাগে আলাদা হয়ে যাবে এবং ওপরের অংশটি অর্থাৎ স্টারশিপ তার নিজের ইঞ্জিনের শক্তিতে ছয় মিনিট ২৩ সেকেণ্ড ধরে চলবে। ততক্ষণে এটি পৃথিবীর ১০০ কিলোমিটার ওপর দিয়ে উড়তে থাকবে।

এরপর স্টারশিপটি পৃথিবীর চারদিকে প্রায় সম্পূর্ণ এক পাক ঘুরে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উত্তরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করবে। পুরো যাত্রাটি শেষ হবে ৮৫ মিনিটের মধ্যে।

অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সুপার হেভি বুস্টারটি যদিও পুনর্ব্যবহারযোগ্য হওয়ার কথা, তবে এ যাত্রায় এটিকে টেক্সাসের উপসাগরের পানিতে নেমে ডুবে যেতে দেয়া হবে।

ভবিষ্যতে স্পেসএক্স প্রত্যাশা করছে যে স্টারশিপ ও বুস্টার রকেট নিয়ন্ত্রিত অবতরণ করতে পারবে এবং এতে পুনরায় জ্বালানি ভরা ও আবার উৎক্ষেপণ করা হবে।

মঙ্গলগ্রহে মানুষের শহর প্রতিষ্ঠা করতে চান ইলন মাস্ক
ইলন মাস্ক চান মঙ্গলগ্রহে একসময় মানুষের একটা ‘শহর’ গড়ে উঠবে। স্টারশিপে করে মঙ্গলগ্রহে যেতে নয় মাস লাগবে, ফিরে আসতেও লাগবে নয় মাস। এ কারণে এই রকেটে এমনভাবে কেবিন সংযুক্ত হবে যাতে প্রায় ১০০ লোক যেতে পারে।

অবশ্য চাঁদে যাবার জন্য নাসার আর্টেমিস কর্মসূচির জন্য যে রকেট তৈরি করবে স্পেসএক্স- তা হবে কিছুটা ভিন্ন ধরনের।

২০১৯ থেকে শুরু করে গত কয়েক বছরে স্পেসএক্স বেশ কয়েকটি প্রোটোটাইপ পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি মাটিতে নেমে আসার সময় বিস্ফোরণ ঘটে ধ্বংস হয়।

তবে ২০২১ সালে স্টারশিপ এসএন-ওয়ান-ফাইভ সফলভাবে উৎক্ষেপণ এবং সফট ল্যান্ডিং খাড়া অবস্থায় নিরাপদে অবতরণ-এই দুটিই করতে সক্ষম হয়।

এরপর তাদের রকেটের নিচের দিকের ৩৩টি ইঞ্জিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ একটি টেস্ট ফ্লাইটের অনুমতি দেয়, যা সোমবার হওয়ার কথা ছিল, তবে এটি স্থগিত হলেও আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা আবার চেষ্টা করা হবে বলে ইলন মাস্ক আশ্বাস দিচ্ছেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement