২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আলঝেইমার্স : যত্ন নিলে সুস্থ থাকে

-

আলঝেইমার্স রোগীদের শুরুতে স্মৃতি কমে যেতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি মনে রাখতে পারেন কম। কোনো জিনিস খুঁজে পেতে কষ্ট হয়, টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারেন না

আলঝেইমার্স রোগটি প্রথম ১৯০৬ সালে জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট এবং নিউরোপ্যাথোলজিস্ট ডা: আলঝেইমার্স আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি একজন নারীর মস্তিষ্কের টিস্যুতে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন যিনি অস্বাভাবিক মানসিক রোগে মারা গিয়েছিলেন। ডব্লিউএইচওর সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, আলঝেইমার্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সপ্তম মৃত্যুর প্রধান রোগ।
বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস প্রথম ২০১২ সালে পালন করা হয়েছিল। সেই থেকে প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস পালন করা হয়। আলঝেইমার্স রোগের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে।
আলঝেইমার্স একটি নিউরোলজিক্যাল রোগ। এ রোগের মস্তিষ্কের কোষে এক ধরনের কেমিক্যাল জমা হয়। এতে করে কোষটি মারা যায়। এতে করে দেখা দেয় স্মৃতিক্ষয়। এর সাথে যুক্ত হয় কথা বলার সমস্যা, মানসিক সমস্যা। স্বাভাবিক জীবনযাপন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
ডিমেনশিয়া ইংলিশ শব্দ। বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় বুদ্ধিবৈকল্য বা স্মৃতিলোপ। জন্মের পর একটি শিশু বিভিন্ন কিছু শিখতে শুরু করে। নানান বিষয় তার মস্তিষ্কে জমা হতে থাকে। যত বয়স বাড়ে তত তার জ্ঞান বাড়তে থাকে। একটা সময় পরিপক্বতা আসে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তার মেধা কমতে শুরু করে। স্মৃতি থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারে। এমন একটা সময় আসে যখন নিজের দৈনন্দিন কাজ অন্য কারো সাহায্য ছাড়া করতে পারে না তাকে ডিমেনশিয়া বলে।
ডিমেনশিয়া নিউরোলজিক্যাল একটি রোগ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতিলোপ পায়। শুধু স্মৃতিলোপই না সাথে কথা বলার সমস্যা, মনোসংযোগ, এক্সিকিউটিভ ফাংশন বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এ সমস্যাগুলো অল্পমাত্রায় কমলে কিন্তু ডিমেনশিয়া বলে না। এগুলো এমন পর্যায়ে কমতে হবে যে আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজকর্ম যেমন চাকরি বাজার, ব্যবস্যা ইত্যাদি ব্যাহত হবে।

পরিসংখ্যান
বিশ্বব্যাপী ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কিন্তু অনেক। প্রায় ৫০ মিলিয়ন লোক ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। এর বেশির ভাগ প্রায় ৬০ শতাংশ কিন্তু নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ।
এক গবেষণায় দেখা গেছে ৬৫ বছরের পর প্রতি ৮ জনে ১ জন স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত হন।
প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে ডিমেনশিয়ায় নাম লেখায়। গবেষণায় দেখা গেছে ২০২৫ সালের মধ্যে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের সংখ্যা ৮৫ মিলিয়ন ও ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন হতে পারে।
ডিমেনশিয়া নিয়ে বাংলাদেশে ২০১৯ সালের আগে জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে সম্প্রতি জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (নিনস) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বা ব্যাপকতা ৮ দশমিক ১ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে যা ১১ লাখ। সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী ২০৪১ সালে দেশে এসব রোগীর সংখ্যা হবে প্রায় ২৪ লাখ। অর্থাৎ বর্তমান সংখ্যার চেয়েও প্রায় তিন গুণ বেশি। কাজেই আমাদের দেশেও কিন্তু ডিমেনশিয়ার অনেক রোগী আছে।

আলঝেইমার্স ডিমেনশিয়ার মূল কারণ
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপ বলতে আমরা বৃদ্ধদের চিন্তা করি। তা ঠিক। কিন্তু শুধু বেশি বয়সীদের হয় তা কিন্তু না। তরুণদেরও হতে পারে এটি। সাধারণত ৬০ বছরের বেশি বয়স্করা ডিমেনশিয়ায় বেশি ভুগেন। বয়স বাড়লে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেখা গেছে ৮৫ বছরের বেশি বয়সীদের ২০-৪০ শতাংশ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। ডিমেনশিয়ার অনেক কারণ আছে। আলঝেইমার্স ডিজিজ নামে রোগটি ডিমেনশিয়ার মূল কারণ। ডিমেনশিয়ার ৬০-৭০ ভাগ জায়গা নিয়ে আছে এটি। এছাড়া স্ট্রোককেন্দ্রিক ডিমেনশিয়া, ডিএলবি, পারকিনসন্স ডিজিজ ডিমেনশিয়াতে স্মৃতিলোপ হতে পারে।
এছাড়া মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ইনফেকশন, নরমাল প্রেসার হাইড্রোকেফালাস, হাইপোথাইরয়েড, ভিটামিন বি১২ স্বল্পতা, মস্তিষ্কের টিউমার, অ্যালকোহল সেবন নানাবিধ কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে।

আলঝেইমার্স রোগের লক্ষণ
আলঝেইমার্স রোগীদের শুরুতে স্মৃতি কমে যেতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি মনে রাখতে পারেন কম। কোনো জিনিস খুঁজে পেতে কষ্ট হয়, টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারেন না। অফিসের কাজ আগে ঠিকমতো করতে পারলেও এখন পারছেন না। ড্রাইভিং করতে গেলে এক্সিডেন্ট করা বা পথ ভুলে যাওয়া। এসব লক্ষণ নিয়ে শুরু হয় আলঝেইমার্স রোগের। ধীরে ধীরে বাড়তে থেকে স্মৃতিলোপ। এর সাথে যুক্ত হয় কথা বলার সমস্যা, সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতা।
আচরণগত সমস্যা : শুরুতে খুব পরিচিত জায়গা ভুলে যান। স্টাইলিশ কেউ হঠাৎ করে ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরা শুরু করেন। যিনি সব সময় চুল পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতেন তার চুল থাকে উষ্কখুষ্ক। মুড খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। নিজের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন থাকেন।
মানসিক সমস্যা : শুরুতে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সমস্যা বুঝতে তাই তিনি দুশ্চিন্তা করেন। পরিচিত কাউকে চিনতে না পারার কারণে লজ্জিত হন। ডিপ্রেশন তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু পরে তিনি বেশ এগ্রেসিভ হয়ে যান। যে কাউকে মারধর করতে চান। তার মধ্যে নানান মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি পরিচিতদের অপছন্দ করেন, মনে করেন তারা তাকে মেরে ফেলবেন। যে জীবনসঙ্গীকে ভালবেসেছেন নিজের থেকেও বেশি শেষ বয়সে এসে তাকে সন্দেহ করা শুরু করেন।
রোগ বাড়তে থাকলে যেখানে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ করেন। খাবার গিলতেও ভুলে যান। এক লোকমা খাবার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। এভাবেই এক সময় মৃত্যুর মুখে পতিত হন।

রোগ নির্ণয় :
এ রোগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় চিকিৎসাযোগ্য কারণে ডিমেনশিয়া হয় তা খুঁজে বের করার জন্য। ডিমেনশিয়ার মাত্রা বের করার জন্য মেন্টাল স্টেট পরীক্ষা করা হয়। নিউরোলজিস্ট এ পরীক্ষা করবেন। ডিমেনশিয়ার সব রোগীর নিউরোইমেজিং যেমন সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করতে হবে। এছাড়া রক্ত, হরমোনসহ নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। পেট সিটিস্ক্যান এ রোগ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে।

চিকিৎসা
আলঝেইমার্স রোগ নির্মূলের কোনো ওষুধ নেই। তার মানে কি এ রোগের চিকিৎসা নেই? আচ্ছা বলুন তো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কি নির্মূল হয়? হয় না। ওষুধ খেয়ে রোগগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আলঝেইমার্স রোগটিও এমন। ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এ রোগের চিকিৎসা করা হয় ৪ প্রকারের ওষুধের মাধ্যমে। আমাদের দেশে এ রোগের চিকিৎসার সব ওষুধ পাওয়া যায়। নিউরোলজিস্ট রোগটি কতটা মারাত্মক তা নির্ণয় করে সঠিক ওষুধ শুরু করবেন। শুরুতে কম ডোজের ওষুধ দিতে হয়। এরপর রোগের উন্নতি দেখে ওষুধের ডোজ বাড়াতে হয়। এ রোগের উন্নতি হয় খুব ধীরে। তাই অনেকেই আছেন রোগীর উন্নতি না হলে অস্থির হয়ে যান। একের পর এক চিকিৎসক পরিবর্তন করেন। এতে কিন্তু চিকিৎসা ব্যাহত হয়। ওষুধগুলো দাম একটু বেশি তবে তা নাগালের মধ্যেই।

পরিবারে আলঝেইমার্সের রোগী থাকলে করণীয়
আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখাশুনা করা জরুরি। এরা শিশুর মতো হয়ে যান তাই তাদেরকে শিশুর মতোই টেককেয়ার করতে হবে। আমরা মনে করি বুড়ো বয়সে ভিমরতি করছেন। শিশুদের ব্যাপারগুলো খুব সহজে মানতে পারলেও বয়স্কদেরটা পারি না। তাই অহেতুক খারাপ ব্যবহার করি। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি আরো মানসিক চাপে পড়েন। তাই এ রোগে আক্রান্তদের সেবা করতে হবে খুব যতœ নিয়ে একেবারেই শিশুর মতো করে। পরিবারে খুব হাসিখুশি পরিবেশ রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আলঝেইমার্স আক্রান্তদের শারীরিকভাবে কর্মক্ষম রাখলে রোগ আস্তে চলা নীতি মেনে চলে। তাই তাদেরকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে যান।
এ রোগে আক্রান্তরা সূর্য ডোবার সময় খুব আপসেট হন যা সারারাত ধরে চলতে থাকে। তাই সূর্য ডোবার আগেই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে লাইট জ্বালিয়ে দিন।
আলঝেইমার্স রোগ খুব খারাপ হওয়ার আগেই তার জমিজমা, সম্পদের ব্যবস্থা করতে পারেন। না হলে পরে ঝামেলায় পরতে পারেন।
যাদের পরিবারে এ রোগী আছেন বা যারা তাদের সেবাযতœ করেন তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভালোবাসার মানুষটির এমন অবস্থা সহজে মেনে নিতে পারেন না। এমনটি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিজেকে সময় দিন।

প্রতিরোধ কি করা যায়?
আলঝেইমার্স রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই জানতে চান। এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তা হলো শাকসবজি, মাছ, বাদাম বেশি করে খেলে ও শারীরিক পরিশ্রম করলে এ রোগের আক্রান্তের সম্ভাবনা কমে। এছাড়া ধূমপান, মদপান না করলে ঝুঁঁকি কমে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখলে প্রতিরোধের সম্ভাবনা থাকে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স (নিনস)


আরো সংবাদ



premium cement
গাজা নিয়ে আলোচনার জন্য সৌদি আরব যাচ্ছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিরসরাই প্রেস ক্লাবের নতুন সভাপতি মিঠু, সম্পাদক মাঈন আইসিসির সিদ্ধান্ত ইসরাইলকে প্রভাবিত করবে না : নেতানিয়াহু শনিবার বন্ধই থাকছে প্রাথমিক বিদ্যালয় মে মাসে দেশে সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হতে পারে ডাসারে শিশু খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে নিখোঁজ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের শরবত বিতরণ কর্মসূচি ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের শতাধিক স্পটে জামায়াতের খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক বাধা দূর করতে সম্মত ভুটান ও বাংলাদেশ চরমোনাই পীরের অসুস্থ ভাইকে দেখতে গেল জামায়াতের প্রতিনিধি দল ব্যাঙ্কিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করতে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা

সকল