০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাড়ছে ডেঙ্গু, সাবধান হোন

-

দেশে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে ডেঙ্গুতে ৫৬ জনের মৃত্যু হলো। এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো ৪৩৬ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৭৪ জন ও ঢাকার বাইরে ২৬২ জন।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি হওয়ার পাশাপাশি নিম্নের ২টি লক্ষণ দেখা দিলে ডেঙ্গু সন্দেহে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- তীব্র মাথাব্যথা
- চোখের পেছনে ব্যথা
- শরীরের পেশি ও জয়েন্টসমূহে ব্যথা
- বারবার বমি করার প্রবণতা
- নাসিয়া গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া
- শরীরে র্যাশ ওঠা।
তীব্র ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গু হওয়ার ৩ থেকে ৭ দিন পর হতে পারে;
শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, তীব্র পেট ব্যথা;
ক্রমাগত বমি করা, বমির সাথে রক্ত যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেয়া; শরীরে অবসাদ বোধ করা, অস্থিরতা বোধ করা।
ডেঙ্গু হলে করণীয়
ডাক্তারের পরামর্শ নিন : ভাইরাস জ্বর স্বাভাবিকভাবে বোঝা যায় না। জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ে বাংলাদেশের সব ডাক্তারই কম-বেশি জানেন। ডেঙ্গু হলেই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। জেনারেল ফিজিশিয়ান বা প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার- যে কারো থেকেই পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
বিশেষ কোনো জটিলতা থাকলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়া যেতে পারে। ডেঙ্গুর কোনো বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অল্প কয়েক দিনেই সুস্থ হওয়া যায়।
পরিপূর্ণ বিশ্রাম করুন : ডেঙ্গুজ্বর শরীরকে অনেক কাহিল করে ফেলে। ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত জ্বর উঠতে পারে। শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, জয়েন্টগুলোয় ব্যথা অনুভূত হবে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর ব্রেকবোন ফিভার বা হাড়ভাঙা জ্বরও হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর হিমোরোজিক ফিভারের কারণে অনেক সময় রক্তক্ষরণও হয়। ৪-৫ দিন পর শরীরে র্যাশ বের হয়। দাঁত ব্রাশ করলে রক্তক্ষরণ হয়, নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়, প্রস্রাব-পায়খানার সঙ্গেও রক্ত যেতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রে পিরিয়ডকালীন রক্তক্ষরণ স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে হয়। এ সময় বিশ্রামের কোনো বিকল্প নেই। রেস্ট ছাড়া ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। এ ছাড়া ভারী কাজ থেকেও রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে পারে।
খাবার ও পানীয় নিয়ে সচেতন হন : ডেঙ্গু হলে খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই। তবে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। ডেঙ্গু হলে রোগীর প্লাজমা লিকেজ হয়ে শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। নিয়মিত ফলের রস, পানি, ওরাল স্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি ইলেকট্রোলাইট সমৃদ্ধ তরল পান করলে প্লাজমা লিকেজ কম হবে। শর্করা, প্রোটিন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সাধারণ খাবার বন্ধ করা যাবে না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ঘরে বানানো খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। পানি পানের বিষয়ে অবহেলা করলে কিডনির জটিল রোগও হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর স্ট্রিট ফুড, তৈলাক্ত বা মসলাদার ভাজাপোড়া ধরনের খাবার এবং ক্যাফিনযুক্ত পানীয় একেবারে রুটিন করে এড়িয়ে চলুন।
জ্বর কমাতে কী করবেন : ডেঙ্গুজ্বর অনেক হাই টেম্পারেচারের হয়। জ্বর বাড়লে কিছু সময় পরপর পানি দিয়ে শরীর মুছে নেবেন। মুখে খাওয়ার প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট ও বাচ্চাদের জন্য সিরাপ চলতে থাকবে। মুখে খাওয়ার অবস্থা না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সাপোজিটরি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যথার উপশম করতে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ কোনোভাবেই গ্রহণ করা যাবে না ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া। প্যারাসিটামলের বাইরে অন্য কোনো পেইন কিলারও নেয়া যাবে না। দিনে ৪ গ্রামের বেশি প্যারাসিটামল না খাওয়াই ভালো। যাদের আগে থেকে হার্ট, লিভার বা কিডনিতে সমস্যা আছে, তারা ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
জ্বর নামার পর করণীয় কী : কোনো রকম চিকিৎসা না নিয়েও অনেক সময় জ্বর ছেড়ে যেতে পারে। ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে জ্বর নেমে গেলে অনেকেই নিজেকে সুস্থ ভাবেন। এটা একেবারেই করা যাবে না। জ্বর কমার পরও অসুবিধা হতে পারে। জ্বর ছাড়ার ৪ থেকে ৫ দিনের মাথায় শরীরে র্যাশ, এলার্জি বা ঘামাচির মতো হতে পারে। এ সময় ব্লাড টেস্ট করে রক্তে প্লেটলেটের অবস্থা জেনে নেবেন। ডেঙ্গু হিমোরোজিক ফিভার হলে এ পরীক্ষাটা অবশ্যই করাবেন। জ্বর ছাড়ার পরের সময়টা অনেক ক্রিটিক্যাল। জ্বর কমে আসার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তীব্র পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি, নাক বা দাঁতের মাড়িতে রক্তক্ষরণ হলে, যকৃত বড় হয়ে গেলে, রক্তবমি হলে, মল কালো হলে কিংবা প্রসাব কমে গেলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। এ সময় বিন্দুমাত্র অবহেলা করা চলবে না। হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করলে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা দিতে পারে।
সংক্রমণ প্রতিরোধে মশারি ব্যবহার করুন : ডেঙ্গু কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কেবল ভাইরাসবাহী এডিস মশার কামড়েই ডেঙ্গু হতে পারে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশারির বাইরে বের হলে ফুল হাতা পোশাক পরতে হবে। সুরক্ষার জন্য মশা মারার ¯েপ্র বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
পুনরায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের বিশেষ সতর্কতা : সুস্থ হয়ে গেলেন মানেই রোগী যে ঝুঁকিমুক্ত, তা কিন্তু নয়। কেউ যখন ডেঙ্গুর একটি ধরনে আক্রান্ত হয়, সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে রোগী আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে না। বরং তিনি এবার ডেঙ্গুর শক্তিশালী ধরনগুলোতে আক্রান্ত হতে পারেন। তখন হেমোরেজিক ফিভার বা শক সিন্ড্রমের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনকি দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ বারের সময় ডেঙ্গুর শক্তিশালী অন্য কোনো ভ্যারিয়্যান্ট থেকেও পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে।
ব্যক্তিগত সতর্কতা : ঘরের বা অফিসের বা কর্মস্থলের জানালা সব সময় বন্ধ রাখতে হবে; মশার কামড় থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব শরীর ঢেকে রাখতে পারে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।
কমিউনিটির সচেতনতা বৃদ্ধি : পরিবার, প্রতিবেশী ও কমিউনিটির মধ্যে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে; পরিচ্ছন্নতা অভিযানে সবাইকে সরাসরি যুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
মশার প্রজনন রোধে নিন্মলিখিত কাজগুলো করতে হবে : ঘরে ও আশপাশে যেকোনো পাত্রে বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিন দিন পর পর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মরে যাবে; ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে; ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা বা নারিকেলের মালা, কনটেইনার, মটকা, ব্যাটারি সেল ইত্যাদিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে বিধায় এগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে; পানি যাতে না জমে সে জন্য অব্যবহৃত পানির পাত্র ধ্বংস করতে হবে অথবা উল্টে রাখতে হবে; দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে; ডেঙ্গু হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে।
লেখক : নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল ( নিনস)


আরো সংবাদ



premium cement