১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫
`


শুচিবায়ু রোগ : একটি মানসিক সমস্যা

-

শুচিবায়ু রোগের কথা আমরা অনেকেই জানি, যাদের এ রোগ হয় তারা সাধারণত একই কাজ বারবার করে অথবা তাদের একই ধরনের চিন্তা ক্রমাগত আসে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে যে তার এই কাজ ও চিন্তা অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয়। এ ধরনের চিন্তা থেকে সে মুক্তি চায়, অস্থিরতায় ভোগে। কিন্তু চিন্তার স্রোতধারাকে বাধা দিতে সে অক্ষম।
এটি আসলে একটি মানসিক রোগ। গ্রামে বা শহরে রোগটি শুচিবায়ু রোগ নামে সমধিক পরিচিত। যেকোনো কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি ধারণা করে যে, কাজটি মনমতো হয়নি। তাই অনেক সময় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কাজ করেই চলেছে। যেমন-হাতে ময়লা লেগেছে বলে বারবার হাত ধোয়া, বেশি সময় ধরে গোসল করা, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে গ্যাসের চুলার সুইচ বন্ধ করেছে কি না একাধিকবার পরীক্ষা করা। এমনকি অনেকে কাপড়ে নোংরা লেগে যাওয়ার ভয়ে অথবা নাপাক হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাথরুমে যেতে চান না। এর ফলে প্রস্রাবের প্রদাহে ভোগেন। যেকোনো ব্যাপারেই রোগীর সন্দেহ আসতে পারে। সে না চাইলেও কতকটা বাধ্য হয়ে তার একই চিন্তা বা কাজ করতে হয়। মন থেকে এই চিন্তা সরাতে না পেরে অশান্তিতে ভুগতে থাকেন। বাড়ির অন্য লোকজন এতে বিরক্ত হয়। এ নিয়ে তারা তাকে তিরস্কার করে, এমনকি একপর্যায়ে রাগারাগি বা গালমন্দ করে। কিন্তু সে নিরুপায়। ধীরে ধীরে বিষণœতা, হতাশা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা তাকে গ্রাস করে। জীবনযাপনের মান কমে যেতে থাকে। রোগীর পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কর্মদক্ষতা কমে যায়। চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে চাকরি টিকিয়ে রাখা অসাধ্য হয়ে পড়ে।
এ রোগটি এত বেশি ক্ষতিকারক যে, ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ তা অনুধাবন করতে পারে না। মেডিক্যালের পরিভাষায় এ রোগটিকে বলা হয় অবসেশিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ড়নংবংংরাব পড়সঢ়ঁষংরাব ফরংড়ৎফবৎ). অনেকের চিন্তার ধরন ধর্মীয় বিষয় নিয়েও হতে পারে। যেমন নামাজে দাঁড়ালে তাৎক্ষণিক মনে হয় আল্লাহ নেই অথবা নাস্তিক্যবাদী চিন্তা। কখনো সন্দেহ হয় নামাজে কোনো ফরজ বাদ পড়েছে বা নামাজের সূরা পড়তে গিয়ে কোনো আয়াত বাদ পড়েছে। এই চিন্তাগুলো বারে বারে আসার কারণে নামাজ ভেঙে রোগী পুনরায় নামাজ আদায় করতে যায়। এভাবে চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত নামাজের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়।
অবসেশন রোগে যারা ভোগেন তারা সাধারণত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন। যেকোনো কাজ ধীর গতিতে করেন, মেজাজ প্রায়ই খারাপ থাকে এবং সর্বদা টেনশনে ভোগেন। প্রথম দশটি ক্ষতিকারক মানসিক রোগের মধ্যে এ রোগের স্থান চতুর্থ।
এ রোগের সূচনা
সাধারণত এ রোগ ২৫ বছর বয়সের আগে শুরু হয় এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ রোগের নারীদের তুলনায় পুরুষ কম বয়সে আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে ৯-১১ বছর বয়সের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে।
কারণ
একাধিক কারণে এ রোগ হতে পারে। যেমন সাংসারিক বিভিন্ন অশান্তি, বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়ে যাওয়াÑ পারিবারিক বা অর্থনৈতিক, আপনজনের মৃত্যু, চাকরিচ্যুত হওয়া, শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন এ ধরনের মানসিক চাপে বিপর্যস্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে অবসেশন রোগে আক্রান্ত হন।
অবসেশনের প্রকারভেদ
১. কাজকর্মে ২. চিন্তাচেতনায়
কোনো রোগীর একটি চিন্তা বারবার এলে, সে চিন্তা অনুযায়ী কাজটি করে অথবা চিন্তাটি বাধা দিতে চায়। পরবর্তীকালে অস্থিরতা বোধ করে। এই যে একই ধরনের চিন্তাÑ এটাই হচ্ছে অবসেশনার থট ডিসঅর্ডার। আর চিন্তা অনুযায়ী যে কাজটি বারবার করতে হয়Ñ তা হচ্ছে ঈড়সঢ়ঁষংরাব ধপঃ.এভাবে বারে বারে একই চিন্তা আসা ও সে অনুযায়ী একই কাজের পুনরাবৃত্তি এ প্রবণতাকে ঈড়সঢ়ঁষংরড়হ বলা হয়।
অবসেশিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সময়মতো আহার নিদ্রা, সময়মতো নির্দিষ্ট কাজটি সম্পন্ন করা, সাংসারিক অথবা পারিবারিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। দিনের শুরুতে একটি চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলে, বারবার তা নিয়ে চলতে থাকে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ; কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন না। মাঝে মাঝে রোগীর মনে হয় কোনো কাজ তিরবার বা পাঁচবার না করলে শুদ্ধ হবে না, কোনো একটি বিশেষ বাক্য উচ্চারণ না করলে অন্যায় হবে, মসজিদে দাঁড়িয়ে ধর্মবিরোধী নোংরা কথা উচ্চারণ করার চিন্তা আসে। রোগী নিজেকে পাপী, অপরাধী মনে করে এবং ধীরে ধীরে হতাশায় ভুগতে থাকে।
প্রিয় পাঠক, অবসেশনাল চিন্তাও কাজের হাজারও উদাহরণ টেনে আনা যায়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। এর কারণ হচ্ছে এটি যেকোনো রোগ আক্রান্ত ব্যক্তি তা বুঝতে পারেন না। নিজের সমস্যা লুকিয়ে রাখেন এবং এ নিয়ে আলোচনা করতে লজ্জাবোধ করেন। দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন- যেমন অতিরিক্ত ধোয়া মোছার ফলে হাতের চামড়া খসখসে হওয়া, চর্মরোগ, ঘুমের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, খাবারে অনীহা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে যখন মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন, তখনই রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে তা বেরিয়ে আসে।
গ্রামাঞ্চলে অনেকের ধারণা অবসেশনাল থট ডিসঅর্ডারের কারণ হচ্ছে শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা জিনের আসর। তাই তারা ছুটে যান ফকির কবিরাজের কাজে দাওয়াইর জন্য। রোগটির ভালো বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধৈর্যসহকারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করতে হবে এবং এর পাশাপাশি রয়েছে বিহেভিয়ার থেরাপি।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রিয় পাঠক, অবসেশন একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকা ব্যক্তি জীবনে অনেক সুফল বয়ে আনে এবং এ ধরনের ব্যক্তিত্বের লোক বেশ গোছানো স্বভাবের হন। যে কোনো ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল হয়ে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেন, দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন এবং প্রতিটি কাজ সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করেন। এককথায় বলা যায়, তারা ঢ়বৎভবপঃরড়হরংঃ. তাই নির্দিষ্ট মাত্রায় অবসেশন একটি গুণও বটে। তবে যদি সেই অবসেশন মাত্রাতিরিক্ত, অসহনীয় হয় এবং তা সুস্থ জীবনযাপনের পরিপন্থী হয় তবে তা হচ্ছে গবহঃধষ ফরংড়ৎফবৎ বা মানসিক রোগ।

লেখক : সহকারী অধ্যাপিকা, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, কল্যাণপুর, ঢাকা।

 


আরো সংবাদ



premium cement
পিএসজি অধ্যায় শেষ করলেন এমবাপ্পে ফরিদপুরে হত্যা মামলায় কিশোরের ৮ বছরের কারাদণ্ড তাসকিনের জন্যে বেড়েছে বিশ্বকাপ দল ঘোষণার অপেক্ষা যে দ্বীপের মানুষ ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে! বাবার লাশ কবরে রেখে পরীক্ষা, জিপিএ ৫ পেলেন সেই শিক্ষার্থী ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫০০ ফিলিস্তিনি ডাক্তার-চিকিৎসাকর্মী নিহত স্পেনের কাতালোনিয়ায় সমাজবাদীদের জয় ‘বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার মহান স্বপ্ন নিয়ে জামায়াত কাজ করছে’ : ডা. শফিকুর রহমান হজযাত্রীদের ভিসা প্রক্রিয়ায় সহায়তার প্রতিশ্রুতি সৌদি রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে রাখা বেআইনি : হাইকোর্ট বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা উচিত : মির্জা ফখরুল

সকল