০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


এল নিনো এবং লা নিনার প্রভাব দেখবে বিশ্ববাসী

চলতি বছর প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়বে বাংলাদেশ

-

- ড. মো: রেদওয়ানুর রহমান, অধ্যাপক পরিবেশ
- বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জলবায়ুর পরিবর্তন আমরা অহরহ শুনছি। এর প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ এবং মানবজীবনের জন্য কতটা মারাত্মক হুমকি তা হয়তো বিশ্ব দেখবে চলতি বছর। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এ বছর ভয়াবহ এল নিনোর প্রভাব ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, ভারত, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া। ১৯৮২ সালে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল বিশ্ব। সে বছর পৃথিবীর একপ্রান্ত ডুবেছিল পানিতে, আর এক প্রান্তে হয়েছিল ভয়াবহ দাবানল, খরা আর প্রচণ্ড ঝড়। সে বছর দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়েছিল শূন্য দশমিক শূন্য দুই মিলি সেকেন্ড।

'এল নিনো' হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সমুদ্রের পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন। এটি একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার মানে 'বালক'। যা 'যিশুর ছেলে' হিসেবে নির্দেশ করা হয়। কারণ এই পর্যায়বৃত্ত উষ্ণ সামুদ্রিক জলস্রোতের পরিবর্তন সাধারণত উত্তর আমেরিকার ক্রিসমাসের সময়ই দেখা যায়। আর স্প্যানিশ শব্দ 'লা নিনা' মানে হচ্ছে 'ছোট বালিকা'। এটির সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যেতে পারে, যখন তাহিতি এবং অস্ট্রেলিয়ায় বায়ুমণ্ডলে চাপের পরিবর্তন সংঘটিত হয় তখন এবং যখন পেরু ও ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল থেকে অস্বাভাবিক গরম অথবা ঠান্ডা সামুদ্রিক অবস্থা বিরাজ করে তখন। এল নিনো হচ্ছে পর্যায়বৃত্তের উষ্য পর্যায়, আর লা নিনা হচ্ছে শীতল পর্যায়। পর্যায়বৃত্ত এই পরিবর্তনের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, তবে প্রতি দুই থেকে আট বছরের মাঝে দেখা যায়। এই পর্যায়বৃত্ত কার্যপ্রণালী এখনো একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। এটি 'এল নিনো দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন' নামেই বেশি পরিচিত। নাসার টোপেক্স/পোসেইডন উপগ্রহের মাধ্যমে গৃহীত ১৯৯৭ সালের এল নিনোর চিত্র ধরা পড়ে। চিত্রের সাদা অংশটি দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উপকূলে প্রবাহিত উষ্ণ স্রোতকে নির্দেশ করছে। এল নিনো বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

উন্নয়নশীল যেসব দেশ কৃষিকাজ এবং মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল, তারাই এল নিনো দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এল নিনোর ধারণা সর্বপ্রথম পেরুর সাগরের জেলেদের কাছ থেকে পাওয়া। তারা লক্ষ্য করেন যে, সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট অংশের পানি গরম থেকে ঠাণ্ডা এবং ঠাণ্ডা থেকে গরম হচ্ছে। শুধু যে তাপমাত্রা বাড়ছে আর কমছে তা নয়, হচ্ছে অসময়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি। পেরুর জনগণের ধারণা ছিল যে এটা শুধু তাদের দেশেই ঘটছে। তাদের বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না যে, ১৫ হাজার কিমি, দূরের ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় চলছিল বিপরীত ঘটনা, অর্থাৎ তীব্র খরা।
ভারতীয় মহাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ১৮৯৫ ও ১৮৯৬ সালে এই অঞ্চলে দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ খরা। ফলশ্রুতিতে ৫০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল।
সে সময়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এল নিনো সম্পর্কে কোনো বাস্তব ধারণা ছিল না। ছিল কেবল তত্ত্বীয় ধারণা। দৃশ্যপট পাল্টে যায় ১৮৮২ সালে, তখন এক সাথে পাঁচটি মহাদেশের আবহাওয়ার ওপর পড়ে বিরূপ প্রভাব। এরপরে বেশ কয়েকবার আবহাওয়ার ওপর অশুভ লক্ষণ দেখা গেছে। তবে, চলতি বছর আসছে এল নিনোর এক ভয়াবহ রূপ। এবার কয়েক মাস আগেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন এল নিনো আসছে ভয়াবহ রূপ নিয়ে। এবার এল নিনো একা আসছে না, সাথে থাকছে লা নিনাও।

গবেষকেরা বলছেন, ২০২৪ সাল হবে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে যাবে, ফলে পৃথিবীর একপ্রান্তে দেখা দিবে অনাবৃষ্টি, প্রচণ্ড খরা ও বাড়; আর অপর প্রান্তে প্রবল বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢল এবং ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে। ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চলবে প্রচণ্ড তাপদাহ। এমনো হতে পারে সামনে শীতে আমাদের ফ্যান ছেড়ে ঘুমাতে হতে পারে। এল নিনো যে শুধু প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতি করবে তা নয়, এর প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতেও।
১৯৯৭ থেকে ১৯৯৮ সালে ঘটে যাওয়া এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৫.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৮২ সালে ক্ষতি হয়েছিল ৪.১ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০২৪ সালে পৃথিবী জুড়ে ক্ষতি ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যার প্রভাব ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ২০২৪ সালে কী হতে পারে, তা এখনে ধারণা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা- সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

 


আরো সংবাদ



premium cement