২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাজী সেলিম কারাগারে

-

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী মোহাম্মদ সেলিমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলাম এ আদেশ দেন। আদেশের পর রোববার বিকেল ৫টায় আদালত থেকে তাকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। দেশে তিনি হাজী সেলিম নামে অধিক পরিচিত।
আত্মসমর্পণের পর গতকাল সকালে হাজী সেলিমের পক্ষে আদালতে তিনটি আবেদন করা হয়। তার একটিতে আপিলের শর্তে জামিন আবেদন করা হয়। আরেকটি আবেদনে বলা হয়, তাকে যদি কারাগারে পাঠানো হয়, তাহলে যেন প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়। আর তৃতীয় আবেদনে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার সুযোগ চাওয়া হয়।
আদালতে আত্মসমর্পণের আগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার পরও বিদেশে যাওয়ার কারণে এ মাসে আলোচনায় উঠে আসেন হাজী সেলিম। দণ্ড পাওয়া আসামি হলেও জরুরি চিকিৎসার জন্য গত ৩০ এপ্রিল হাজী সেলিম বিদেশে গিয়েছিলেন এবং চার দিন পরে ফিরেও আসেন। তিনি বিদেশে যাওয়ার পর অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, দুর্নীতির মামলায় হাইকোর্ট সাজা বহাল রাখার পরও তিনি কিভাবে বিদেশে গেলেন?
গতকাল দেয়া আদেশে আদালত বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাজী মোহাম্মদ সেলিম হাইকোর্টের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করেছেন। যেহেতু আসামি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত, সেহেতু আসামিকে জামিন প্রদান সঙ্গত মনে করি না। ফলে আসামির জামিনের প্রার্থনা নামঞ্জুর করা হলো। সাজা ভোগের জন্য সাজা পরোয়ানা মূলে আসামিকে কারাগারে প্রেরণ করা হোক।’
আদালত আরো বলেন, ‘আসামিকে কারাগারে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান ও কারাগারের তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নতমানের হাসপাতালে বেটার ট্রিটমেন্ট প্রদানের দরখাস্ত বিষয়ে পক্ষে বিজ্ঞ কৌঁসুলি ও বিপক্ষে বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটরের বক্তব্য শ্রবণ করলাম। তার সামাজিক মর্যাদা, আসামি যে অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন তার ধরন ইত্যাদি বিবেচনায় তাকে জেলকোড অনুযায়ী ডিভিশন প্রদান কিংবা উন্নতমানের চিকিৎসা প্রদানের প্রয়োজন থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’ গতকাল রোববার বেলা ৩টা ৫ মিনিটে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলামের আদালতে উপস্থিত হন হাজী সেলিম। পরে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় নেয়া হয়। আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন হাজী সেলিম। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। প্রায় ২০ মিনিটের মতো শুনানি নিয়ে আদালত আদেশ দেন। এ দিকে হাজী সেলিমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়ার পর আদালতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
হাজী সেলিমের পক্ষে তার আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা জামিন চেয়ে শুনানি করেন। এ ছাড়া কারাগারে উন্নত চিকিৎসা ও প্রথম শ্রেণীর ডিভিশন চেয়েও শুনানি করেন আইনজীবী। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালে ওপেন হার্ট সার্জারির সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাকশক্তিহীন অবস্থায় রয়েছেন হাজী সেলিম। তিনি দেশ ও বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। জেলে থাকলে চিকিৎসার অভাবে ও বাকশক্তি না থাকায় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে যেকোনো শর্তে তার জামিন আবেদন করছি। জামিন পেলে তিনি পলাতক হবেন না। তাই আপিল শর্তে আত্মসমর্পণপূর্বক তার জামিন আবেদন করছি। অন্য দিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জামিনের বিরোধিতা করেন।
হাজী সেলিমের আদালতে আত্মসমর্পণ করা উপলক্ষে রোববার ঢাকা এজলাস কক্ষের বাইরে ও আদালতের প্রবেশমুখে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ সময় নেতাকর্মীরা আদালতের বাইরে ভিড় করেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় গত ২৫ এপ্রিল হাজী সেলিমের ১০ বছরের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এরপর তাকে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী বিচারিক আদালতে রোববার সকালে হাজী সেলিমের আইনজীবী প্রাণনাথ আত্মসমর্পণ করে যেকোনো শর্তে জামিনের এ আবেদন করেন।
গত ২৫ এপ্রিল দুদকের মামলায় এমপি হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেয়া ১০ বছর কারাদণ্ড বহালের রায় হাইকোর্ট থেকে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ওই দিন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেছিলেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। গত বছরের ৯ মার্চ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেয়া ১০ বছর কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তবে তিন বছরের দণ্ড থেকে খালাস পান তিনি। রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।
২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে তাকে মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত। দণ্ড হয়েছিল তার স্ত্রীরও। পরে তারা আপিল করলে সে প্রেক্ষাপটে আদালত ২০১১ সালে ওই দণ্ড বাতিল করলে দুদক আবার উচ্চ আদালতে আপিল করে। এই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ আবারো হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী শুনানি শেষে গত বছরের ৯ মার্চ হাইকোর্ট ১০ বছরের সাজা বহাল রাখেন ও অন্য ধারায় তিন বছরের দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেন। অন্য দিকে আপিল চলাকালে হাজী সেলিমের স্ত্রী মারা যাওয়ায় তার আপিল বাতিল করা হয়। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী রায় নিম্ন আদালতে পৌঁছানোর পর ৩০ দিনের মধ্যে তার আত্মসমর্পণের কথা। তার আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেছেন, গত ২৫ এপ্রিল ওই নথি আদালত পেয়েছেন এবং সে কারণে ২৫ মে পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সময় আছে। তবে এর মধ্যে হাজী সেলিমের ব্যাংকক যাওয়ার খবর এলে তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়।
কারাগার থেকে হাসপাতালে স্থানান্তর আজ
ঢাকা-৭ আসনের দণ্ডপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে আজ সোমবার সকালে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হতে পারে। কারাগার সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টায় তাকে ঢাকার আদালত থেকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। কারাগারে যাওয়ার পর তিনি সরাসরি সিনিয়র জেল সুপারের অফিস কক্ষে প্রবেশ করেন।
দায়িত্বশীলরা জানান, আজ সোমবার সকাল ৮টায় পুলিশের দু’টি এস্কট দল আসবে। সকাল ১০টার দিকে হাজী সেলিমকে কারাগার থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এ সময় পুলিশের একটি দল কেরানীগঞ্জ সীমানা পর্যন্ত এবং অপর পুলিশের দল নিরাপত্তা দিয়ে পিজি (সাবেক) হাসপাতালের প্রিজন সেল পর্যন্ত নিয়ে যাবে। এ নিয়ে কারাগারের ডেপুটি জেলার তৌহিদ, ঢাকা জেলার এসপিসহ দু’টি দফতরে রাতে পত্র প্রেরণ করেন বলে জানা গেছে।
কারা সূত্র জানায়, হাজী সেলিম দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। ঠিক মতো কথাও বলতে পারেন না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালের প্রিজন সেলে পাঠাতে পুলিশ এস্কট প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়।
অন্য দিকে জেল কোডে যদি বিধান থাকে, তাহলে দণ্ডপ্রাপ্ত হাজী সেলিমকে কারাগারে প্রথম শ্রেণীর বন্দীর মর্যাদা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আদালত থেকে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কারা কর্মকর্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাতে হাজী সেলিমকে কারা ডাক্তারের পরামর্শে কারা হাসপাতালে রাখা হতে পারে। আবার ডিভিশনপ্রাপ্ত সেলেও রাখা হতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement