২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজউকের প্ল্যানিং ব্যর্থতার নজির হয়ে দাঁড়াল পূর্বাচল

অতিরিক্ত ব্যয় ৭ হাজার কোটি টাকা
-

রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প প্ল্যানিং ব্যর্থতার একটি উজ্জ্বল নজির। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ব্যয় করা হবে সাত হাজার সাত কোটি টাকা। শুরুতে শহরটির জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল এখন নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে আগের পরিকল্পনার অনেক কিছুই বাদ দেয়া হয়েছে এবং সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে ব্যয়ের হিসাবও। পাল্টে গেছে প্রকল্প শেষ হওয়ার সময়সীমাও। এরই মধ্যে প্রকল্পটির নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে পাঁচবার।
সর্বশেষ প্রকল্পটির সময়সীমা ২০২৫ সাল নির্ধারণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে তা সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল সন্দেহ পোষণ করছেন। কারণ এর আগে কয়েক দফা প্রকল্পটি শেষ করার সময় নির্ধারণ করেও তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। বারবার নতুন নতুন প্রকল্প যুক্ত করে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ১০ লাখ মানুষের বসবাস উপযোগী শহর বলা হলেও এখন সর্বশেষ নকশা অনুসারে এ প্রকল্পে ২৭ লাখ মানুষ বাস করবে। এতে শেষ পর্যন্ত তা বাসযোগ্য থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
তবে রাজউক বলছে, প্রকল্পটির ৭০ শতাংশ অবকাঠামোগত এবং ৬৫ শতাংশ আর্থিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে তারা প্রকল্প শেষ করতে সক্ষম হবেন। প্রথম দিকে তিন হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। বর্তমানে এ ব্যয় ১০ হাজার ৩১৯ কোটিতে উন্নীত করা হয়েছে। তবে ব্যয় বাড়ালেও নতুন নতুন প্রকল্প যুক্ত হওয়ায় পূর্বাচল আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে। যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উপাদানও।
২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত চার লেনে সম্পন্ন করা ৩০০ ফুট রাস্তার পুরোটাই ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জ্বল মল্লিক বলছেন, নতুন পরিকল্পনায় আট লেনের রাস্তাটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চলাচলের জন্য উপযোগী হবে। এটি হবে একটি দৃষ্টিনন্দন রাস্তা। ইন্টারসেকশনগুলোতে এমনভাবে রাস্তা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে তাতে রাস্তাগুলো মনে হবে দোতলা। কোথাও যানজট হবে না, যানজট হওয়ার যেসব বাধা থাকে- এই রাস্তায় তা থাকবে না।
১৯৯৫ সালে পূর্বাচল প্রকল্প শুরু হয় ছয় হাজার ২২৭ একর জায়গা নিয়ে। ভূমি অধিগ্রহণ করতেই ব্যয় হয় কয়েক বছর। বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তি করতে চলে যায় দু’টি সরকারের মেয়াদ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ অংশে প্রায় সাড়ে চার হাজার এবং গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলাধীন এ প্রকল্পে এখন কিছু দালানকোঠা উঠলে পুরোপুরি বসবাসের উপযোগী হতে আরো লাগবে অনেক সময়।
পূর্বাচল প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো ও প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন হয়েছে বারবার। এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, নিউ টাউনের রুলস অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহর ও নতুন শহরের মধ্যে অনেকটা বাফার জোন থাকে; যেখানে সবুজ বনায়ন থাকে এবং খোলা প্রান্তর থাকে। কিন্তু পূর্বাচলে এর কিছুই নেই। পূর্বাচল প্রকল্প হাতে নেয়ার পরপরই ঢাকা শহর ও পূর্বাচলের মাঝখানের জায়গাগুলো দখল হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে মধ্যে এ জায়গা ডেভেলপাররা দখল করে বাড়িঘর তুলে ফেলেছে। সবুজ বনায়নের কোনো সুযোগই নেই। অন্য দিকে এই দখলের কারণে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বালু নদী পর্যন্ত ৩০০ ফুট রাস্তার দুই পাশে ১০০ ফুট খাল তৈরি করার জন্য রাজউককে ডেভেলপারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। অন্য দিকে পূর্বাচলের মাঝখান দিয়ে বালু নদী থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত যে ৩০০ ফুট রাস্তা গেছে তা চার লেনের পরিবর্তে এখন আট লেন করা হচ্ছে। ওই ৩০০ ফুট রাস্তা তো ২০১৮ সালে শেষ করা হয়েছে আগের পরিকল্পনা অনুসারে। এত টাকা খরচ করে এই রাস্তা আরো বেশি লেনবিশিষ্ট করা হলেও রাজউকের গচ্চা গেছে ২৭৫ কোটি টাকা। এটি রাজউকের ‘প্ল্যানিং ফেইলিউর’ (পরিকল্পনার ব্যর্থতা)। এটি ছাড়াও পূর্বাচল প্রকল্পে রাজউকের অনেক প্ল্যানিং ফেইলিউর রয়েছে। কোনো একটি প্রকল্প হাতে নিলে তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সাথে পরামর্শ করতে হয় যেন কোনো খুঁত না থাকে। সব দিক বিবেচনা করে এবং সম্ভাব্য সব প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ রেখেই একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেয়া এবং অর্থ বরাদ্দ করা হয় যেন অর্থের অপচয় না হয়। এদিক থেকে রাজউক পুরোপুরিই ব্যর্থ।
প্রসঙ্গত পূর্বাচলের মোট ভূমির মধ্যে প্লটে ব্যয় হবে ৩৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ, রোড নেটওয়ার্কে ব্যয় হবে ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ, সামাজিক অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় হবে ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ, লেক তৈরিতে ব্যয় হবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিকে প্লট তৈরিতে ব্যয় হবে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণে রাজউকের মোট ভূমির ৬ শতাংশ ব্যয় হবে এবং প্রতিবেশী আড্ডা ও খেলার মাঠের জন্য ব্যয় হবে পূর্বাচলের ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ ভূমি সংরক্ষিত আছে অথবা অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হবে বলে রাজউক সূত্রে জানা গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement