২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জলবায়ু পরিবর্তনে বেড়েছে সংক্রামক ও মানসিক রোগ

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ
-

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে বেড়েছে তাপমাত্রা, সংক্রামক ও মানসিক রোগ। একই কারণে আবহমানকাল ধরে চলা বাংলাদেশের ঋতুতেও এসেছে পরিবর্তন। ফলে গ্রীষ্মকাল আগের তুলনায় দীর্ঘ ও গরম হচ্ছে এবং শীতকালে তেমন শীত পড়ছে না, তুলনামূলক উষ্ণ হয়ে গেছে। প্রায় প্রতি বছরই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বাড়ছে এবং সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফেব্রুয়ারি, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের তাপমাত্রা।
বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে করা এ গবেষণার ফলাফল গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওয়েবিনারের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের গবেষণাটি করা হয় ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণার এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বায়ুর ব্যাপ্তি জুন থেকে অক্টোবরের পরিবর্তে এখন ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিরাজমান। গড় বৃষ্টিপাত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বেশি হচ্ছে জুন থেকে আগস্টের পরিবর্তে।
তাপমাত্রার গবেষণাটি করা হয়েছে ১৯০১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে ১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপরই নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে যথাক্রমে ১.৮ থেকে ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা সবচেয়ে কম বেড়েছে জানুয়ারি মাসে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯০১ থেকে ২০১৯ সময়ের মধ্যে গত ১২০ বছরে সবেচেয়ে বৃষ্টিপাত বেড়েছে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যথাক্রমে ৪৩.৮ মিলিমিটার ও ৪২.২ মিলিমিটার। অন্য দিকে মৌসুমি বায়ুর ভরা সময় জুন মাসে গড় বৃষ্টিপাত কমেছে মাইনাস ৬৩.২ মিলিমিটার। আগস্ট মাসেও কমেছে মাইনাস ৪৯.৯ মিলিমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ২০১৯ সালে ঢাকায় গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভারী বর্ষণ হয়েছে অনুকূল তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সময় ৫১ শতাংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ঢাকায় এবং জীবাণুবাহী এই জ্বরে ৭৭ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে ঢাকায়।
১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত ড্যাটা বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে ঢাকায় হ্রাস পেয়েছে আর্দ্রতা, বৃদ্ধি পেয়েছে তাপমাত্রা এবং গ্রীষ্মকালে বেড়েছে বৃষ্টিপাত। এই কারণে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় আগামী দিনে ঢাকায় ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণের আশঙ্কা করা হয়েছে গবেষণায়।
বিশ্বব্যাংকের এই গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবে ২০১৯ ও ২০২০ সালে সমীক্ষায় বাংলাদেশের মানুষের ৬ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা রয়েছে এবং ১৬ শতাংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিষণœতা। এ ধরনের মানসিক রোগে যারা ভুগছেন এদের বেশির ভাগই বয়স্ক, দরিদ্র এবং নানা ধরনের প্রতিবন্ধী। গ্রামীণ মানুষের চেয়ে শহুরে মানুষের মধ্যে এ ধরনের মানসিক রোগের সংখ্যা বেশি। বিষণœতা সবচেয়ে বেশি ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সী মানুষের মধ্যে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩৪ শতাংশ মানুষের মধ্যে জীবাণুবাহী রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যেখানে জীবাণু রোগের জাতীয় গড় ২৫ শতাংশ এবং গ্রামীণ জনপদের মধ্যে ২২ শতাংশ। শুষ্ক মৌসুমের চেয়ে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সময় জীবাণুবাহী রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
জলবাযু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল আরো বেশি দীর্ঘ ও গরম হচ্ছে এবং বিপরীতে শীতকাল হচ্ছে উষ্ণতর। ১২০ বছরে প্রায় সবচেয়ে মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে ১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মৌসুমির বায়ুর ঋতুর চেয়ে শুষ্ক মৌসুমে ১৯.৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে সংক্রামক রোগের পরিমাণ। অন্য দিকে শুষ্ক মৌসুমে পানিবাহিত রোগ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ মৌসুমি বায়ুর ঋতুর চেয়ে বেড়েছে অনেক বেশি। বাতাসে আর্দ্রতা ও গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়েছে ৪.২ শতাংশ।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সালে আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই কারণে ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরেই গড় বৃষ্টিপাত বাড়বে ৭৪ মিলিমিটার পর্যন্ত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মৌসুমি বায়ুর ঋতুতে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে এবং ফলে বিপর্যয়কর ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করতে পারে। একই কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বাড়বে ৩৫ মিলিয়ন থেকে ১২২ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন ১০ লাখ) মানুষের মধ্যে। ২০৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১৭ থেকে ১৪৭ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকবে, যদিও তা নির্ভর করবে দূষণের ওপর। বিশ্বব্যাপী ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানুষের মধ্যে দেখা দেবে নজিরবিহীন উদ্বেগ। ফলে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দেখা দেবে বিপর্যয়কর অবস্থা এবং খাপখাইয়ে নেয়ার ধারণা তেমন কাজ করবে না।
বিশ্বব্যাংক জলবায়ুর এ ধরনের পূর্বাভাস সামনে রেখেই প্রতিবেদনে চার ধরনের সুপারিশ করেছে। এগুলো হলোÑ স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহে আরো মনোযোগ দিতে হবে, সেই সাথে বাড়াতে হবে মৌসুমি রোগের বিস্তারের ওপর নজরদারি। আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আবহাওয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি বা পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রজননস্থল ধ্বংসের মতো কাজে স্থানীয়দের আরো বেশিমাত্রায় সম্পৃক্ত করতে হবে। সর্বশেষ সুপারিশে বিশ্বব্যাংক বলেছে, নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এমনিতে হতাশা, উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ কারণে এ বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement