১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫
`


মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে মোড় পরিবর্তন

আনোয়ারের নেতৃত্বে পদযাত্রা : প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি

-

মালয়েশিয়ায় গতকাল সোমবার বিরোধী দলগুলোর ১০৭ জন এমপি সংসদ ভবনে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। সংসদ ভবনে প্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে বিরোধী এমপিরা দাতারান মারদেকায় সমাবেশ করে সরকারের অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। সেখানে বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদও বক্তব্য রেখেছেন। সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও ওয়ারিশান প্রধান শফি আবদালও এই প্রতিবাদে অংশ নেন। খবর ডেইলি স্টার, ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে ও মালয়েশিয়া ইনসাইট-এর।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিরোধী সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন এবং তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সোমবার সকাল সোয়া ১০ টায় পার্লামেন্টের দিকে যাত্রা শুরু করতে দাতরান মেরদেকাতে জড়ো হন এবং দাঙ্গা অস্ত্রে সজ্জিত ফেডারেল রিজার্ভ ইউনিটের কর্মীদের বাধায় তাদেও পদযাত্রা প্রতিবাদ সমাবেশে রূপ নেয়। পুলিশের বাধার মুখে প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল স্বল্পস্থায়ী।
সম্মিলিত বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ এমপিদের মিছিলটি এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার পুলিশের সাথে কথা বলেন। কিন্তু পুলিশ দাতরান মারদেকা থেকে জালান পার্লিমেনের প্রবেশ পথ অবরোধ করে রাখায় তারা পার্লামেন্ট চত্বরে প্রবেশ করতে পারেননি। উপস্থিত এমপি এবং জনতাকে সম্বোধন করে বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, সংসদ সদস্যরা তাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট করেছেন। সকল বিরোধি দলের ১০৭ জন এমপি মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, (দেওয়ান রাকিয়াত) স্পিকার তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছেন এবং তিনি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। স্পিকার বৈধতা হারানো প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য যে পদ্ধতি নিয়েছেন তা তার জন্য সবচেয়ে অসম্মানজনক।
আনোয়ার বলেন, আমরা এখানে মালয়েশিয়ান হিসেবে যারা আছি তারা রাজার অনুগত এবং আমরা সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে চাই। সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনগণ এখন মারাত্মক ধরনের সংকটে ভুগছে। সরকার তার সমর্থন হারিয়েছে এবং দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারা মরিয়া হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ সংসদ সদস্য এবং বিরোধী দলীয় সমর্থকরা বেলা ১১টার মধ্যে এলাকাটি ছেড়ে যান। পদযাত্রায় অংশ নেয়া অন্যদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ, ওয়ারিসানের প্রেসিডেন্ট শফি আপদাল, ড্যাপ মহাসচিব লিম গুয়ান য়েং, মুডার সৈয়দ সাদিক সৈয়দ আবদুল রহমান এবং আমানাহ সভাপতি মোহাম্মদ সাবু।
সমাবেশে বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদও বক্তব্য রাখেন। তারা প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ও তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি জানান।
গতকাল সোমবার ছিল সংসদের পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশনের শেষ দিন যা পেরিকাতান ন্যাশনাল সরকার জরুরি অবস্থা সত্ত্বেও অনুষ্ঠিত করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এক দিন আগেই অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
বিরোধী সংসদ সদস্যরা চেয়েছিলেন, শেষ দিনের অধিবেশনে সরকার গত সপ্তাহে জরুরি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তার ব্যাপারে ভোটাভুটি করতে। এতে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যেত। জরুরি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে রাজা (ইয়াং ডি-পার্টুয়ান আগং) বলেছিলেন এই ব্যাপারে তার সম্মতি নেই। এর ফলে বৃহস্পতিবার দেওয়ান রাকিয়তে হইচই পড়ে যায়। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার নিয়ে মালয়েশিয়ার রাজার সাথে সরকারের দূরত্ব নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সরকারের ডিফেক্টো আইনমন্ত্রী তকিউদ্দিন জানিয়েছেন, রাজার অনুমোদনক্রমে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হলো। অন্যদিকে এর পর রাজপ্রাসাদের মুখপাত্র জানিয়েছেন রাজা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দেননি। এ নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনাকর অবস্থায় চলতি সপ্তাহে মালয়েশিয়ার সুলতানরা বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বলে দেশটির পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এই বৈঠকে মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে।
মেরুকারণে আভাস : মালয়েশিয়ার রাজনীতির প্রতি যারা নজর রাখেন তারা জানেন দেশটির রাজনৈতিক গতি নির্ণয়ের প্রচেষ্টা সত্যি বেশ কঠিন। মাস সপ্তাহ এমনকি রাতারাতিও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায় দেশটিতে। এর মধ্যে আমনুর প্রেসিডেন্ট জাহেদ হামিদী মুহিউদ্দিনের সরকারের উপর সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন সরকারের সাথে যুক্ত আমনু সদস্যদের সমর্থন নিশ্চিত করে সরকারকে সামনে এগিয়ে নিতে। এ উদ্দেশ্যে উপপ্রধানমন্ত্রী ও আমনু নেতা ইসমাইল সাবরি এক নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমনু এমপিদের। সেখানে ৪০ জন আমনু এমপির মধ্যে অংশ গ্রহণ করেন ১৯ জন। এদিকে প্রবীণ আমনু নেতা রেজালাহ হামজাহ (কু লি) এবং তার নিজস্ব রাজ্য কেলানতানের আমনু মহিউদ্দিন ইয়াসিনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এতে স্পষ্ট হয় যে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে যে কোনো আস্থা ভোটের আয়োজন করা হলে মহিউদ্দিন ইয়াসিন তাতে হেরে যাবেন। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব সংসদ অধিবেশন শেষ করার দিকে মনোনিবেশ করে সরকার। এর আগে সংসদ সদস্যদের সংসদে কোনো আস্থা ভোট ছাড়াই মাহাথির মোহাম্মদের পদত্যাগের পর মহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন রাজা। কোভিড১৯ নিয়ন্ত্রণে চরম ধরনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরির বর্তমান পরিস্থিতিতে ইয়াসিনের জনপ্রিয়তা যেমন তলানিতে নেমে আসে। কোনোভাবেই এখন তিনি আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন নেই। এই অবস্থায় সংসদে অনাস্থা ভোট ছাড়াই রাজা ইচ্ছা করলে মহিউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় করে নতুন সরকার গঠন করতে পারেন। অথবা তিনি সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণাও দিতে পারেন। আর এই অন্তবর্তী সময়ের জন্য কোন জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকারো গঠন করতে পারেন রাজা। এক ধরনের রাজনৈতিক ঝড়োহাওয়ার এই অবস্থায় মালয়েশিয়ায় কি হতে যাচ্ছে সেটি বলা কঠিন। তবে বিশ্লেষকরা নতুন কিছু সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন। এর মধ্যে প্রথম সম্ভাবনাটি হলো, বিরোধী পক্ষের নেতা হিসাবে সংসদের বাকি মেয়াদের জন্য আনোয়ার ইব্রাহিমকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো। সেই ক্ষেত্রে আনোয়ার ইব্রাহিম হতে পারেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। এতদিন তিনি মূলত পাকাতান হারাপানের পিকেআর ডিএপি ও আমানাহ দলের নেতা ছিলেন। সোমবারের সমাবেশের পর বোঝা যাচ্ছে ড. মাহাথির মোহাম্মদ ও শফি আবদালের সাথে তার একটি সমঝোতা হয়েছে।
প্রাপ্ত আভাস অনুসারে, রাজা আনোয়ারকে সরকার গঠনের আহ্বান জানালে তাতে এই সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী হবেন শফি আবদাল এবং মুখরিজ মাহাথিরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেয়া হতে পারে। এখন ১০৭ জন এমপির সমর্থন দেখানো হলেও তাদের সাথে কম করে হলেও আরো ৮ থেকে ১০ জন এমপির সমর্থন যুক্ত হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, মহিউদ্দিন ইয়াসিনকে বাদ দিয়ে উপপ্রধানমন্ত্রী ও আমনু নেতা ইসমাইল সাবরিকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হতে পারে অথবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক বা প্রবীণ আমনু নেতা রেজালাহ হামজাহকে প্রধানমন্ত্রী করে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বারিসানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হতে পারে। ত্রিধাবিভক্ত আমনুুকে এই ফর্মুলায় কতটা ঐক্যবদ্ধ করা যাবে আর সেই সরকারের ১১২ জন এমপির সমর্থন সংগ্রহ করা যাবে সেটি বেশ কঠিন এক হিসাব হতে পারে।
তৃতীয় বিকল্পের যে কথা শুনা যায় সেটি হলো, পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে রাজার নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জরুরি জাতীয় সরকার গঠন করা। ১৯৬৪ সালে জাতীয় জরুরি মুহূর্তে এই ধরনের সরকার একবার গঠন হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে। তবে মালয়েশিয়ার সংসদে সব দলের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব থাকা অবস্থায় এটি কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন অনেকে।
মালয়েশিয়ার জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেখানে কি হবে তা নিশ্চিত করে বলা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয়ের সম্মতি ছাড়া কেউ মালয়েশিয়ায় সরকারে যেতে পারে না। আনোয়ারের বারবার ক্ষমতার কাছে গিয়েও ছিটকে পড়ার মূল কারণ এটি বলে অনেকে মনে করেন। মালয়েশিয়ার সুলতানরা, সেনা নেতৃত্ব, পুলিশ নেতৃত্ব এবং শীর্ষ শিল্পপতিরা এই গভীর ক্ষমতাবলয়ে রয়েছে বলে মনে করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement