০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অ্যাজেন্টের কাজ কী

- ছবি - বিবিসি

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৪২ হাজারের ভোটকেন্দ্রে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে পোলিং অফিসার পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক নির্বাচনী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন।

এদের মধ্যে আছেন ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার, ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং ৪২ হাজার ১৪৯ জন প্রিজাইডিং অফিসার।

কিন্তু নির্বাচনে তাদের কাজ কী? নির্বাচনের দিন তাদের কে কী দায়িত্ব পালন করবেন?

নির্বাচনী কর্মকর্তা
বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচন আয়োজন ও নীতি-নির্ধারণের দায়িত্বে থাকে নির্বাচন কমিশন। তবে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেশ কিছু পর্যায়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়।

নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি অর্গানোগ্রাম অনুসরণ করা হয়।

এতে সবার উপরে থাকে রিটার্নিং অফিসার। রিটার্নিং অফিসারদের তত্ত্বাবধানেই সার্বিক ভোট প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়।

তার পরেই থাকেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার। তিনি মূলত রিটার্নিং কর্মকর্তার সহায়ক হিসেবে কাজ করেন।

অর্গানোগ্রামের তৃতীয় অবস্থানে থাকেন প্রিজাইডিং অফিসার। ভোটকেন্দ্রের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন তিনি।

আর প্রিজাইডিং অফিসারের অধীনে থাকেন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, যার অধীনে থাকেন দুজন করে পোলিং অফিসার।

রিটার্নিং অফিসার কে?
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক নির্বাচনী এলাকার জন্য একজন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করতে পারেন।

বাংলাদেশে কিছু উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করা হলেও ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী সব জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ছিলেন জেলা প্রশাসকরা।

এবারের জাতীয় নির্বাচনে ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে।

এরমধ্যে আছেন ৬৪টি জেলার ৬৪ জন জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের দু’জন বিভাগীয় কমিশনার।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে আসন সংখ্যা বেশি হওয়ায় দু’জন করে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হয় বলে জানান নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম।

রিটার্নিং অফিসারকে ‘নির্বাচন পরিচালনায় সাংবিধানিভাবে সর্বেসর্বা’ বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি।

নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন বাছাই, মনোনয়ন বাতিল, প্রার্থীর বৈধতা কিংবা প্রতীক বরাদ্দ –পুরো ভোট প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করেন রিটার্নিং অফিসাররারা।

অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যেসব নীতিনির্ধারনী সিদ্ধান্ত নেন, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে রিটার্নিং অফিসারদের ওপর।

এছাড়া প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের তালিকা তৈরি ও ভোটকেন্দ্র নির্বাচনের দায়িত্বও থাকে তাদের ওপর।

আইন অনুযায়ী, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা বা ভোটার বা নির্বাচনী ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তার করার প্রমাণ পেলে কারণ দর্শিয়ে ওই ব্যক্তি যেই হোক না কেন- তাকে প্রত্যাহার করা এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে শৃঙ্খলা ভাঙ্গার অভিযোগ এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করার এখতিয়ার থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তার।

এছাড়া নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে যে ফলাফল আসে, তা একসাথে করে রিটার্নিং অফিসার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন।

সহকারী রিটার্নিং অফিসার
রিটার্নিং অফিসারের সহায়ক হিসেবে কাজ করেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার।

সাধারণত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা ইউএনও’দের সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়।

এছাড়াও নির্বাচন কর্মকর্তা এবং সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

দ্বাদশ নির্বাচনে মোট ৫৯০ জন সহকারি রিটার্নিং অফিসারের মধ্যে ৪৯৩ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াও ৫৬ জন উপজেলা নির্বাচন অফিসার, ১৪ জন স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক, আটজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১১ জন জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার, পাঁচজন ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার, দু’জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং একজন সার্কেল অফিসার উন্নয়নকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

একজন রিটার্নিং অফিসারকে যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয়, তা এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার।

প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগ, প্রিজাইডিং অফিসার কারা হবে, ভোটের দায়িত্ব কারা পালন করবে- এ ধরনের তালিকা প্রস্তুত করতে রিটার্নিং অফিসারকে সাহায্য করেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার।

প্রিজাইডিং অফিসার
‘প্রতিটি নির্বাচনের কেন্দ্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন প্রিজাইডিং অফিসার’, বলেন নির্বাচন কমিশনার মো: জাহাংগীর আলম।

অর্থাৎ দ্বাদশ নির্বাচনে মোট ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্রের জন্য ৪২ হাজার ২৪ জন প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন।

সাধারণত প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বে পান সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত/আধা স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তারা। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তারাও প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

নির্বাচনের আগেই প্রিজাইডিং অফিসারদের জন্য আলাদা করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

এতে নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ এবং অন্যান্য বিষয়ে আচরণবিধি সম্পর্কে সার্বিক প্রশিক্ষণে দেয়া হয়।

যেহেতু প্রিজাইডিং অফিসার কেন্দ্রের মূল দায়িত্বে থাকেন, নির্বাচনের আগের রাত বা নির্বাচনের দিন ভোর থেকেই তার কাজ শুরু হয়।

ব্যালট বাক্স, কাগজ, কালি, সিলসহ নানা নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহ করে কেন্দ্রে আনার দায়িত্ব থাকে প্রিজাইডিং অফিসারের ওপর।

তিনি কোনো ভোটকক্ষে উপস্থিত থাকেন না। সার্বিক কেন্দ্রের দায়িত্ব থাকে তার ওপর।

পরদিন ভোটের সময় আলাদা কক্ষের জন্য সরঞ্জাম বণ্টন এবং প্রস্তুতির নেতৃত্ব দেন তিনি।

সাধারণত সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ নির্বিঘ্ন করতে এবং একইসাথে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন তিনি।

নির্বাচন বিষয়ক বিশ্লেষক ও বেসরকারি সংস্থা সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রিজাইডিং অফিসারের অনেক দায়িত্ব। ভোটগ্রহণে কোনো অনিয়ম, অসঙ্গতি দেখলে তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং নির্বাচন বন্ধ করার ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারেন।’

এছাড়া নির্বাচন শেষে ব্যালট বাক্স, কাগজ, সিল, কালিসহ সব নির্বাচনী সরঞ্জাম নিরাপত্তার সাথে সিলগালা করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেন প্রিজাইডিং অফিসার।

তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ৯(১খ) অনুসারে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চাকুরিতে নিয়োজিত থাকেন বা অতীতে ছিলেন এমন হয়- তবে তাকে প্রিজাইডিং অফিসার বা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বা পোলিং অফিসার নিয়োগ করা যাবে না।

এমনকি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগদান করার পরও কাউকে পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী তার নিয়োগ বাতিল করতে হবে।

সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার
একটি কেন্দ্রে একাধিক বুথ বা ভোটকক্ষ থাকে। আর প্রতিটি ভোটকক্ষের দায়িত্বে থাকেন একজন করে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার।

সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মূলত প্রিজাইডিং অফিসারের অধীনে কাজ করেন এবং তাকে সাহায্য করে থাকেন।

বরাদ্দকৃত কক্ষে পোলিং অফিসারসহ সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বসেন এবং কোনো ভোটার কেন্দ্রে ঢুকলে তার পরিচয় শনাক্ত করেন।

এছাড়া ভোটগ্রহণ শেষ হলে সব ব্যালট বক্স নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে ভোট গোনার কাজও করেন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসাররা।

পোলিং অফিসার
প্রত্যেক ভোটকক্ষে একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে দু’জন করে পোলিং অফিসার থাকেন।

সাধারণত ভোটকক্ষে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের সহায়তার জন্যই তারা নিয়োজিত থাকেন।

পোলিং অফিসারদের কাজই থাকে ভোটার তালিকা দেখে ভোট দিতে আসা ভোটারদের শনাক্ত করা।

এসময় উচ্চস্বরে ভোট দিতে আসা ব্যক্তির নাম বলেন পোলিং অফিসার।

যদি কোনো পোলিং অ্যাজেন্ট আপত্তি না করেন তবে পোলিং অফিসার ওই ব্যক্তির হাতে অমোচনীয় কালি দিয়ে দাগ দিয়ে দেন। যাতে করে সহজে ভোট দাতাকারীদের চিহ্নিত করা যায়।

পোলিং অ্যাজেন্ট
পোলিং অ্যাজেন্ট বলতে প্রার্থীর প্রতিনিধিকে বোঝায়।

নির্বাচনের সময় ভোট পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিটি ভোটকক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীর একজন করে প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন, যাকে বলা হয় পোলিং অ্যাজেন্ট।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ২২ অনুচ্ছেদের (১) দফার বিধান অনুসারে প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অথবা তার নির্বাচনী অ্যাজেন্ট ভোটগ্রহণের পূর্বে প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রের জন্য পোলিং অ্যাজেন্ট নিয়োগ করতে পারবেন।

পোলিং অ্যাজেন্টদের অবশ্যই স্থানীয় হতে হয়।

তারা পোলিং অফিসারদের ভোটার শনাক্তে এক প্রকার সাহায্য করে থাকেন।

আগে থেকেই প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে পোলিং অ্যাজেন্টদের নাম ইস্যু করিয়ে রাখতে হয়।

ভোটের দিন সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসার নির্দিষ্ট ফর্মে পোলিং অ্যাজেন্টের নাম লিপিবদ্ধ করেন এবং ভোটগ্রহণের পুরো সময় তিনি ভোটকক্ষে উপস্থিত থাকেন।

আর ভোটগ্রহণের আগে ব্যালট বাক্স যে খালি আছে, সেটাও পোলিং অ্যাজেন্টেদের দেখাতে হয়।

আবার ভোটগ্রহণ শেষে ভোট গোনার সময়ও পোলিং অ্যাজেন্ট উপস্থিত থাকেন।

‘প্রার্থীর প্রতিনিধি ওই নির্বাচনী বুথে থেকে পর্যবেক্ষণ করে যে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না। কেউ জালভোট দিচ্ছে দেখলে তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন, বলেন বদিউল আলম মজুমদার’।

তবে একটি কেন্দ্রের সব ভোট যেহেতু একসাথে গোনা হয়, তাই প্রত্যেক প্রতিনিধির কেবল একজন করে পোলিং অ্যাজেন্টই এসময় উপস্থিত থাকতে পারেন।

আর ভোট গোনা শেষ হলে কোনো প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন সেই ফলাফল বিবরণীতে পোলিং অ্যাজেন্টদের স্বাক্ষরের পরই তা টাঙিয়ে দেয়া হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকেন।

নির্বাচনে যে অনিয়ম হয়, সেগুলোর আইনগত দিক দেখার দায়িত্ব থাকে ম্যাজিস্ট্রেটদের।

কেউ জালভোট দিতে এলে বা কোনো অনিয়মে ধরা পড়লে আইন অনুযায়ী তাৎক্ষণিক বিচার করে শাস্তি বা জরিমানা করেন।

অন্যান্য তথ্য
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনারের তথ্য অনুযায়ী, আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ১৯৭ জন, নারী ভোটার পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮৮৯ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার মোট ৮৪৮ জন।

তিন শ’ আসনের নির্বাচনের জন্য মোট প্রার্থী সংখ্যা এক হাজার ৯৭০ জন।

এছাড়া ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষ আছে দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬ টি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement