২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আজ ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি

সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার এখনো নেই

-

ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠায় আত্মবিসর্জন বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। আমাদের পূর্বসূরি তরুণদের একটি অংশ অকাতরে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয় রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার, অহিউল্লাহ প্রমুখের তাজা রক্তে। তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা পায় তার যথাযোগ্য মর্যাদা। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশেই আজ গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দিনটি উদযাপন করা হচ্ছে। তবে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহারে আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। এমনটি কোনোভাবেই মানা যায় না।
সাত দশক আগের সেই উজ্জ্বল ঘটনার স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখতে পাই, তমদ্দুন মজলিস নামে একটি নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিরলস চেষ্টায় ভাষার মর্যাদার দাবি জনগণের মনে তিলে তিলে জায়গা করে নিচ্ছে। মানুষ সংগঠিত হচ্ছে, সোচ্চার হচ্ছে। সংগঠনটি কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকেও মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে। এ দাবির পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ প্রথম কাতারের বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই তারা রাষ্ট্রভাষার দাবি জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হন। ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে তমদ্দুন মজলিসের এই দাবি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ছাত্র-জনতার প্রধান দাবিতে পরিণত হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবির গভীরতা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। তাই তারা বিষয়টিকে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে শুরু করে এবং গণমানুষের প্রাণের দাবি অস্ত্রের ভাষায় দাবিয়ে রাখার হঠকারিতা দেখায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিলে বাধা দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে একপর্যায়ে ছাত্রমিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। দিনটি ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, তখনকার বাংলা বর্ষপঞ্জি মোতাবেক ৮ ফাল্গুন।
কেন্দ্রীয় শাসকরা উর্দুকে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এটি ছিল এক অবাস্তব সিদ্ধান্ত। কারণ, উর্দু দেশের কোনো প্রদেশের ভাষা ছিল না। অন্য দিকে, বাংলা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা। তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে প্রায় সব বিবেচনায় বাংলাই ছিল এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। তাই বাংলার রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পাওয়ার দাবি ছিল সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।
একুশে মূলত বাংলাদেশের জনগণকে একটি সংগ্রামী চেতনা উপহার দিয়েছে। সেই পথ ধরেই জাতির স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে ওঠে। চূড়ান্ত পর্যায়ে, স্বাধীনতার দাবি জোরদার হয়। পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এটি ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করার মধ্য দিয়ে সরকারের ঔপনিবেশিক মানসিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। তারই পরিণামে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়।
বাংলা আজ স্বমহিমায় শুধু রাষ্ট্রভাষা নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এর প্রতিষ্ঠা যে হয়নি, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ভাষার মূল চেতনা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে আমাদের ঘরে ঘরে শিশুরা বাংলার বদলে হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। চলছে ইংরেজির অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন। এর মধ্যে, বাংলার মর্যাদা কীভাবে রক্ষা পাবে সেটি চিন্তার বিষয়। বিদেশী ভাষা শেখারও প্রয়োজন আছে। সময়ের সেই প্রয়োজন আর মাতৃভাষার মর্যাদার মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাবা দরকার। শুধু বাগাড়ম্বর করে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখানোর সুযোগ নেই। মাতৃভাষাকে জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের উচ্চশিক্ষায় বাংলা কার্যকর নেই। ছাত্রদের অন্য ভাষা রপ্ত করে উচ্চতর জ্ঞান নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের বিচারাঙ্গনেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ কারণে জাতীয় জীবনে এক বন্ধ্যত্ব বিরাজ করছে। এটি কাটিয়ে উঠতে হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বড় ধরনের উদ্যোগ দরকার। এখনো সেটি দৃশ্যমান হচ্ছে না।


আরো সংবাদ



premium cement