২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
‘এত ওষুধ যায় কোথায়?’

স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতির নজির

-

জনমনে সৃষ্ট একটি দীর্ঘকালীন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উচ্চারিত হলো এই শিরোনামে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা এবং চলমান করোনা মহামারী থেকে কোনো শিক্ষা না নেয়ায় নগ্ন নজির চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য খাতের এই দশা। বিশেষত সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের ভয়াবহ দুর্নীতি এবং মারাত্মক অনিয়ম প্রসঙ্গে সবারই জানা। তবুও এর প্রতিকার করা হচ্ছে না। নয়া দিগন্তের চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতার পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরেছে হাসপাতালের করুণ দশাও। এসবের ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া যে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ কথাটা নেহাত স্লোগান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আলোচ্য প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেøখ করা হয়, হাসপাতালে প্রতিটি চিকিৎসকের কক্ষে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির অবাধ বিচরণ। অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লিখছেন সেখানকার ডাক্তাররা। এই প্রতিনিধিরা নজরও রাখছেন প্রেসক্রিপশনে। হাসপাতালে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী আর দালালদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে রোগীদের পকেট কাটা হচ্ছে। প্রতিটি রোগীকে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ দেয়ার কথা থাকলেও রোগীদের বেশির ভাগ ওষুধ কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকেই। চুয়াডাঙ্গা সরকারি সদর হাসপাতালের নিত্যকার দৃশ্য এটি।
অভিযোগের শেষ নেই; আবার কোনো প্রতিকারও নেই। অনেকে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে বাড়িভিটা ও জমিজমা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। এই হাসপাতালে বহির্বিভাগের রোগী ও স্বজনরা বললেন, ‘গরিব মানুষ আমরা, চিকিৎসার্থে হাসপাতালে এসেছি। ধারণা ছিল, এখানে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সরকারি ওষুধ পাবো। অনেক দূর থেকে, বহু কষ্ট করে এসেছি। কিন্তু কোনো ফায়দা হলো না। এখানে টিকিট পেতেও দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হলো। এর ডাবল সময় অপেক্ষা করতে হলো ডাক্তারের জন্য। তিনি অনেক ওষুধ দিলেন। কিন্তু হাসপাতালে একটাও নেই। এখানে কেবল ব্যথা আর গ্যাসের টেবলেট মেলে। অন্য সব ওষুধ কিনতে হলে হাসপাতালের এত ওষুধ যায় কোথায়?’ মহিলাদের মেডিসিন বিভাগের এক স্বজন বলেন, ‘অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতালে চার দিন কেটে গেছে। এই ক’দিনে আড়াই হাজার টাকার কেবল ওষুধই কিনতে হলো। প্রেসক্রিপশনে অনেক ওষুধ থাকলেও তা এখানে দেয়া হচ্ছে না। সরকার নাকি কোটি কোটি টাকার ওষুধ হাসপাতালে দিচ্ছে; সে ওষুধ কারা খায়?’ পুরুষের সার্জারি বিভাগের জনৈক রোগীর স্ত্রীর অভিযোগ, ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনের দু’পাতা ভরে লিখছেন ওষুধের নাম। কিন্তু হাসপাতালে ওষুধ বেশির ভাগই নেই। বহু ওষুধ কিনে আনতে হচ্ছে। যদি বাইরের দোকান থেকেই ওষুধ আনতে হয়, তা হলে সরকারের হাসপাতালে থেকে কী লাভ? বাড়িতে থেকেও বাইরের ওষুধ কেনা যায়।’
অন্য দিকে কর্তৃপক্ষের দাবি, “৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ ‘ফ্রি’ দেয়া হচ্ছে। কখনোবা সব ওষুধ সরকারই দেয় রোগীদের।” সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকের মতে, ‘ওষুধের সরবরাহ রয়েছে। তাই রোগীদের ওষুধ পাওয়ার কথা। ডাক্তাররাও এখানকার ওষুধই লেখার কথা। দরকারবশত দু-একটা ওষুধ বাইরে থেকে আনতে হতে পারে। সব চিকিৎসককে বলা হয়, সরবরাহ থাকলে যেন তারা হাসপাতালের ওষুধের নামই লেখেন। রোগীদের ছুটি-পরবর্তী প্রেসক্রিপশনেও এখানকার ওষুধই যেন দেয়া হয়।’ এ কর্মকর্তা জানান, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা শুধু দু’দিন রোব ও বুধবার বেলা ১টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারদের সাথে সাক্ষাৎ করাই নিয়ম। হাসপাতালের গায়ে লেখা আছে কার সাথে কখন দেখা করা যাবে।’
স্মর্তব্য, গত ২২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির প্রধানের এক গবেষণায় জানা গেছে, এ দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ এবং ১৪.৯ শতাংশ রোগী পরীক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এর অর্থ, ৯৭ শতাংশকেই সরকারের হাসপাতালে সেবা না পেয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি থেকে সেবা নিতে হচ্ছে। এতে কেবল ব্যয়ই বাড়ে না, বরং অনেকের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়। চুয়াডাঙ্গাসহ সারা বাংলাদেশই এই ব্যবস্থা চলছে।
আমাদের আশা, উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দেয়া হবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে। এটি তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং সরকারের একটি মৌলিক দায়িত্ব। এ জন্য সর্বাগ্রে দুর্নীতি দূর করতে হবে, যাতে সবাই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন।


আরো সংবাদ



premium cement