২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
এক শিল্পীর আত্মধ্বংসের ঘোষণা

এ কি নিছকই অভিমান!

-

অনেকে তাকে বলেন, মোড় ঘোরানো আধুনিক বাংলা গানের পথপ্রদর্শক। জীবনঘনিষ্ঠ তার গান। মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, ধ্বংস, ক্ষয় যখন আধুনিক নন্দনকলার অবিকল্প বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে তখনো ইতিবাচকতাই তার চেতনার মূল প্রবণতা। তার গান জীবনের সদর্থের কথা বলে, আনন্দ ও সামনে চলার কথা বলে। তিনি কবির সুমন। খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক, সাংবাদিক, লেখক ও সাবেক সংসদ সদস্য। করোনাভাইরাস নিয়ে সবশেষ গানে লিখেছেন, ‘যতই বিপদ আসুক লুকিয়ে লুকিয়ে/এখনো সবুজ ঘাস যায়নি শুকিয়ে; যতই ভাবি না সব শেষ হলো বুঝি/ভোর এসে বলে আমি তোমাকেই খুঁজি।’
সমকালীন বাংলা সঙ্গীতের জগতে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেই কবির সুমন গত শুক্রবার হঠাৎ ঘোষণা করেছেন, মৃত্যুর পর তার সব সৃষ্টিকর্ম যেন ধ্বংস করে ফেলা হয়। এ বিষয়ে স্বহস্তে লেখা একটি উইল বা ইচ্ছাপত্র প্রকাশ করেছেন। ‘সকলের অবগতির জন্য’ শিরোনামের ইচ্ছাপত্রে তিনি লেখেন, ‘আমার মৃত্যুর পর যেন কোনো স্মরণসভা, শোকসভা, প্রার্থনাসভা না হয়। আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি, গান, রচনা, স্বরলিপি, রেকর্ডিং, হার্ডডিস্ক, পেনড্রাইভ, লেখার খাতা, প্রিন্ট আউট যেন কলকাতার পুরসভার গাড়ি ডেকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়, সেগুলো ধ্বংস করার জন্য। তার মৃতদেহ যেন দান করে দেয়া হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে।’
কবির সুমন লিখেছেন, তার সৃষ্টির ‘কোনো কিছুই যেন মৃত্যুর পর পড়ে না থাকে।’ তার ব্যবহার করা যন্ত্র, বাজনা সরঞ্জাম যেন ধ্বংস করা হয়; এর অন্যথা হবে তার জন্য অপমানকর। লিখেছেন, এটা এক প্রবীণ মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি। অনেক অভিজ্ঞতার পর, অনেক ভেবেচিন্তে লিখছি।
নিজের হাতে লেখা ইচ্ছাপত্রের ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন; যাতে অনেকেই এটা জানতে পারেন। জেনেছেনও। কারণ, বাংলা ভাষার দৈনিক এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে এ নিয়ে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু কেন এই ঘোষণা সে ব্যাখ্যা দেননি সুমন। ৭২ বছরের জীবনপথের বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা বা কোন উপলব্ধির কারণে এ সিদ্ধান্ত তা-ও জানাননি। তার ভক্ত শ্রোতারা এ ঘোষণায় মর্মাহত নিশ্চয়ই।
সৃজনশীল মানুষমাত্রেই সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন একটি সত্তা। সংবেদনশীল। তাদের মনে অনেক সময় অভিমান পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে। কারণটা হয়তো নিজেও জানেন না। আমরা জানি, লেখক, শিল্পীরা এ ধরনের কাজ প্রায়ই করেন। হয়তো মনে করেন এতে তার সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং সেগুলোর সংরক্ষণের বিষয়টি আরো নিশ্চিত হবে। এটি স্টান্টবাজি। কখনো নিজের কাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে, ধর্মীয় গোঁড়ামির পথে গিয়ে, জীবনের উদ্দেশ্য বা গতিপথ পাল্টে যাওয়ায় এমনকি ব্যক্তিগত শোক সইতে না পেরেও কেউ নিজের সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করেন বা করার নির্দেশ দিয়ে যান। অনেক লেখক, কবি ও শিল্পী নিজেই নিজের সৃষ্টি ধ্বংস করেছেন। কেউ পরে ভুলের জন্য আফসোসও করেছেন।
খ্যাতনামা রুশ সাহিত্যিক নিকোলাই গোগোল, ফরাসি চিত্রশিল্পী ক্লদ মনে, বিংশ শতাব্দীর এক ইংরেজ শিল্পী ফ্রান্সির বেকন, কালজয়ী আইরিশ লেখক জেমস জয়েস নিজের সৃষ্টিকর্ম পুড়িয়েছেন। ফ্রাঞ্জ কাফকা তার সব পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে যান এক বন্ধুকে। সেই বন্ধু নির্দেশ মানতে পারেননি। বরং লেখাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ঔপন্যাসিক ভøাদিমির নভোকভও স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন তার একটি পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার। স্ত্রী এবং পরে ছেলে তা করতে পারেননি।
স্ত্রীর মৃত্যুশোকেও নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি বিসর্জন দিয়েছেন একজন লেখক। তিনি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটি। সেটি বেশ মজার ঘটনা। যাই হোক, মোট কথা কবির সুমন যেটা করেছেন এটি অভূতপূর্ব বা অভিনব কিছু নয়। তবে বাংলাভাষী মানুষের অধিকার আছে সুমনের সৃষ্টির স্বাদ আস্বাদনের। তার সব সৃষ্টি ধ্বংসের দায়িত্ব পালনে সত্যনিষ্ঠ থাকতেই হবে এমন নয়। কারণ কেউ অন্যায়ভাবে কাউকে খুন করার নির্দেশ দিলে তা অস্বীকার করাই বাঞ্ছিত। সুমনের সব শিল্পকর্ম ধ্বংস করা হলে নিঃসন্দেহে বাংলাভাষী মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও সেগুলোর শিল্পরস থেকে বঞ্চিত হবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement