৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ঢাকা : মোকাবেলায় পরিকল্পনা আছে, বাস্তবায়ন নেই

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি এলাকা। ঘনবসতির এই শহরটির ঝুঁকি কমাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তার বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি।

আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা - এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। যার ফলে এখানে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের ভূমিকম্প।

এখানে বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার পর ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়, তবে আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত সেসবের বাস্তবায়ন নিয়ে তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না।

অল্প জমিতে বহুতল ভবন
পুরানো ঢাকার সরু অলিগলির দুই পাশে গেলে দেখা যাবে এখনও গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ভবন। যে ভবনের গাঁথুনি সর্বোচ্চ ৩ তলা, সেখানে নির্দ্বিধায় তোলা হচ্ছে ৫ বা ৬ তলা।

জগন্নাথ কলেজের পাশের এলাকায় ৩০০ থেকে ৪০০ বর্গফুট জায়গায় একটি ৫ তলা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এর বিভিন্ন তলায় বসবাস করছেন এক পরিবারের অন্তত ১৫ জন সদস্য।

শুক্রবার ভোররাতের ভূমিকম্পে এই পুরো ভবনটি কেঁপে উঠলে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এই এলাকার মানুষ। কিন্তু তাদের কারোই ভবনের নীচে রাস্তায় ঠাঁই নেয়ার জায়গাটুকু নেই।

পুরানো ঢাকার বাসিন্দারা তাই ভূমিকম্পের সময় ভয়ে থাকেন, কখন না ভবনটি তাদের ওপরেই ধসে পড়ে।

এতো অল্প জায়গায় এমন বহুতল ভবন ভূমিকম্প বা অন্য যেকোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আক্তার জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে।

সবশেষ ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসেবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকা রয়েছে মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

পুরানো ঢাকায় শত বছরের পুরানো ভবনে এখনও মানুষ বাস করছে।

২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে ও এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে ৭ কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানাচ্ছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে।

এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় এই অপরিকল্পিত ভবনগুলো সাথে সাথে ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেইসাথে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

ভূমিকম্প অসহনশীল ভবন
সেক্ষেত্রে ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হলেও এটি বাস্তবায়িত হয়নি।

২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো।

সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার। সেই সিদ্ধান্তটিও এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

এছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। এটিও আলোর মুখ দেখেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা হলো বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ না করা এবং সেগুলো মনিটর করে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া।

এ ব্যাপারে প্রকৌশলী মেহেদী আহমেদ আনসারি জানান, ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভূমিকম্পে দুর্যোগের ঝুঁকি। তিনি ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে শুরু করে অনেক অভিজাত এলাকার বহুতল ভবন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, বেশিরভাগই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয়। কারণ এগুলোতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি।

এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো গুড়িয়ে ফেলা কিংবা ভূমিকম্প সহনশীল করে সংস্কার করা প্রয়োজন হলেও এ কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।

অগ্রগতি সামান্য
বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে এখনো পর্যন্ত কিছু কাজ হয়েছে। যেমন - সরকারী অর্থায়নে অন্তত ১০০ কোটি টাকা খরচ করে ফায়ার সার্ভিসের জন্য নানা উপকরণ কেনা।

সেইসাথে রাজউকের অধীনে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প চালু করা, যাতে তারা ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতার বিষয়টি নজরদারি করে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

সেই প্রকল্প হাতেগোনা কয়েকটি সরকারী গুরুত্বপূর্ণ দফতর, স্কুল ও হাসপাতালের ভূমিকম্প সহনশীলতা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।

এর বাইরে অন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করা, সংস্কার করা বা ভেঙে ফেলায় কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমদ খান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কোড মেনে বিল্ডিং করা হয় না। এটা কারা নজরদারি করবে সে ব্যাপারেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তৎপর হওয়া খুব প্রয়োজন।’

তবে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মাহফুজা আক্তার জানিয়েছেন, ‘কোনো ভবন ভূমিকম্প সহনশীল কিনা সেটা খতিয়ে দেখার কোনো সক্ষমতা তাদের নেই।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement