২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা : টেলিমেডিসিন সেবা কতটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে

-

দেশে করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার সুযোগে সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও নানা ধরণের অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানই টেলিমেডিসিন সেবা দানের কার্যক্রম শুরু করেছে, যা নিয়ে নানামূখী প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে সেবা গ্রহীতাদের অনেকের কাছ থেকে।

অনেক প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ক্রমশ বেড়েই চলেছে টেলিমেডিসিন কার্যক্রম।

এমনকি এখন মোবাইল ফোনেও অনেকে বার্তা পান যাতে টেলিমেডিসিন সেবা নেয়ার সুযোগের কথা বলা হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে।

গত মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ঢাকাসহ দেশজুড়ে হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকদের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সঙ্কট তৈরি হয় এবং বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম।

এমন পরিস্থিতিতে করোনা রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন সেবা চালু করে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।

এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ কিছু সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি দেশের সুপরিচিত বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রায় সবাই এ সেবা চালু করে।

মূলত ফোনে বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীদের সাথে চিকিৎসকরা কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়াটাই টেলিমেডিসিন সেবা।

এখন ঢাকা ছাড়াও জেলা উপজেলা পর্যায়েও টেলিমেডিসিন দেয়া শুরু করেছে হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো।

সোমবার স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন যে, তারা এ পর্যন্ত এক কোটি ৮৫ লাখ ফোন কল পেয়েছেন তাদের হটলাইনসহ নির্ধারিত টেলিফোন নাম্বারগুলোর মাধ্যমে।

অন্যদিকে শুধু আগের ২৪ ঘণ্টায় টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করেছেন ৪৩৭৩ জন এবং এ পর্যন্ত টেলিমেডিসিন সেবা পেয়েছেন ১লাখ ৮৬ হাজার ৭১৪ জন।

টেলিমেডিসিন : যত উদ্যোগ

মূলত স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইইডিসিআরের যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা কল সেন্টারের মাধ্যমেই ফোনগুলো আসছে।

এসব কল সেন্টারের সাথে যুক্ত থেকে কাজ করছেন বিপুল পরিমাণ চিকিৎসক।

এর বাইরেও সরকারিভাবে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে যে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র আছে সেগুলোতেও কম্পিউটার, প্রিন্টার, ডিজিটাল ক্যামেরা, স্ক্যানার এবং ইন্টারনেট মডেম দেয়া হয়েছে।

তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, প্রাথমিকভাবে ২২টি ইউনিয়ন ও তথ্য সেবা কেন্দ্রে স্কাইপে ব্যবহার করে টেলিমেডিসিনসেবা প্রদান করা হচ্ছে। চিকিৎসকগণ এসব অফিসে বসে প্রতি কর্ম দিবসে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত আঠারটি হাসপাতালে উন্নত মানের টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে।

এছাড়া প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ ও ইন্সটিটিউট হাসপাতালে ওয়েব ক্যামেরা প্রদান করা হয়েছে যাতে করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন।

পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকেও টেলিমেডিসিন কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে।

আবার বেসরকারি উদ্যোগে টেলিমেডিসিন সেবার উদ্যোগ নিয়েছিলো, এর সাথে বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মেডিসিন যাতে বিএমএসহ চিকিৎসকদের তিনটি সংগঠন জড়িত আছে।

এর বাইরে কয়েকটি ব্যাংক, এমনকি কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশনও টেলিমেডিসিন সেবায় কাজ করছে রোগীদের সাথে মোবাইল ফোন, ভিডিও বা স্কাইপে চিকিৎসকের সাথে সংযোগ করিয়ে দিয়ে।

কিন্তু আস্থা এসেছে কতটা?

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকার একটি সুপরিচিত বেসরকারি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা নেয়ার জন্য অগ্রিম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন ও তাকে জানানো হয়েছিলো যে পরদিন ভোরে তাকে ফোন করা হবে।

"কিন্তু নির্ধারিত দিন সারাদিন অপেক্ষা করেও কারো ফোন পেলাম না। পরে কয়েক দফা যোগাযোগের পর বিকাশে এক হাজার টাকা দিতে বলা হলো। কিন্তু টাকা পরিশোধের পরেও দীর্ঘসময়ে ফোন এলো না। সেই ফোন এলো দিন শেষে সন্ধ্যায়। তাও হোয়াটসঅ্যাপে। মনে হলো ডাক্তার বাসায় আর তার
সহকারী হাসপাতালে। কথাবার্তা তেমন কিছুই বোঝা গেল না বারবার লাইন কেটে যাওয়ায়। ডাক্তারের সহকারী প্রেসক্রিপশন দিয়ে পনের দিন পর যোগাযোগ করতে বললেন। পনের দিন শেষে যোগাযোগ করলে এবার আরো পাঁচশ টাকা বেশি দিতে বলা হলো। এই হলো টেলিমেডিসিন সেবা," বলছিলেন তিনি।

রোজিনা ইসলাম বলেন, "আমি যা বুঝেছি তা হলো সিরিয়াস দরকারে টেলিমেডিসিনে ভরসার সময় বাংলাদেশে এখনো আসেনি"।

আবার বিবিসি বাংলার একজন কর্মী সম্প্রতি টেলিমেডিসিন সেবা নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

তিনি বলেছেন, টেলিমেডিসিন বিষয়ে হাসপাতালগুলোতে ফোন করলে রেকর্ড করা কথা বাজতে থাকে এবং কথা বলার জন্য কাউকে পেতে অনেক সময় লেগে যায়। কিছু হাসপাতাল নির্ধারিত একটা সময়ের মধ্যে সেবা দেয়ার কথা জানায়। সব মিলিয়ে তথ্য পাওয়াই মুশকিল।

"শেষ পর্যন্ত অনলাইনে ভিডিও কলে একজন গাইনী বিশেষজ্ঞকে সংযুক্ত করে দেয় একটি অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। পরে দেখা যায় সমস্যা আসলে গ্যাসট্রোলজির। অর্থাৎ যাদের কল সেন্টারে বসানো হয়েছে তারা প্রশিক্ষিত নন। ফলে তারা ভুল করে একজন রোগীকে অন্য ধরণের ডাক্তারের সাথে সংযুক্ত করছেন"।

তিনি বলেন, "আবার ডাক্তারের সরাসরি রোগীর শরীরের অনেক কিছু পরীক্ষা করার থাকে। সেটা টেলিমেডিসিনে সম্ভব না। সে কারণে রোগীর মধ্যে অতৃপ্তি কাজ করে। সে কারণে আবার হাসপাতালেই গিয়েছি আমি"।

চুয়াডাঙ্গা সদরের অধিবাসী রেহানা আক্তার ঢাকার একটি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালুর বিজ্ঞাপন দেখে বড় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পাবেন মনে করে দুই দিন চেষ্টা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলেন।

"কিন্তু যার সাথে কথা বললাম তিনি কি বললেন আমি বুঝিনি। আবার যে ওষুধগুলোর নাম আমাকে এসএমএস করে পাঠালেন সেগুলো খাওয়া ঠিক হবে কিনা- এ নিয়ে চিন্তা করে আর খাইনি"।

তবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কিংবা করোনা উপসর্গ দেখা দেয়ার পর টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন এমন অনেকেও আছেন।

রফিক চৌধুরী নামে একজন বেসরকারি চাকুরীজীবী বলেছেন, তিনি তার সন্তানের জন্য ঢাকার একটি হাসপাতালে নির্ধারিত ডাক্তার না পেয়ে টেলিমেডিসিনের সহায়তা নিয়েছেন।

"আমি কাঙ্ক্ষিত বিশেষজ্ঞকে পেয়েছিলাম এবং তার পরামর্শে আমি উপকৃত হয়েছি"।

চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা কেমন?

স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইইডিসিআরের যে যৌথ টেলিমেডিসিন সেবা সেখানে কাজ করছেন ডা: আমেনা সুলতানা চৌধুরী।

তিনি বলছেন, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সাধারণত প্রাথমিক সেবাটাই দিয়ে থাকেন তারা।

"উপসর্গ শুনে প্রাথমিক করণীয় সম্পর্কে বলি। রোগীরাও তাতে উপকৃত হন। আর যদি মনে হয় প্রাথমিক চিকিৎসায় হবেনা তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা রিপোর্টগুলো হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে পাঠাতে বলি। সেগুলো দেখে পরামর্শ দিয়ে থাকি," বলছিলেন তিনি।

কিন্তু রোগীকে সামনে না দেখে চিকিৎসা দেয়াটা কতটা স্বস্তি দায়ক কিংবা রোগীরাই বা কতটা আস্থা পাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যেহেতু প্রাথমিক সেবা তাই মানুষ উপকৃত হয়েছে অনেক। অনেকেই হাসপাতালে যেতে পারছিলনা নানা কারণে। ফলে টেলিমেডিসিন তাদের ক্ষেত্রে দারুণ সহায়ক
হয়েছে"।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement