০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশীরা কারা?

সিটওয়ে বন্দর থেকে বাংলাদেশীদের তুলে দেয়া হয় মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজে - ছবি : বিবিসি

দীর্ঘদিন আটক থাকার পর মিয়ানমার থেকে ফেরত আসছে ১৭৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক। তারা সবাই ছিলেন সে দেশের কারাগারে বন্দী। তারা যে জাহাজে ফেরত আসছেন মিয়ানমার নৌ বাহিনীর সেই জাহাজেই বৃহস্পতিবার ফেরত যাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৮৫ জন মিয়ানমার বিজিপি সদস্যকে।

মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে বন্দর থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিয়ে রওনা দিয়েছে মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ চিন ডুইন। বুধবার জাহাজটি বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর এ এস এম সায়েম বলেছেন, ‘যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা বিভিন্ন সময় অবৈধ মিয়ানমারে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক হয়েছিল। যাচাই বাছাই শেষে বাংলাদেশের নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে’।

বাংলাদেশী নাগরিকদের নিয়ে জাহাজটি বুধবার কক্সবাজার সীমানায় বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর, ওই জাহাজেই মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২৮৫ সদস্যকে সে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সোমবার প্রধানমন্ত্রীর থাইল্যান্ড সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, বুধবার আটকে পড়া বাংলাদেশীদের নিয়ে জাহাজটি দেশে পৌঁছালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের ওই জাহাজেই তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

এই ফেরত আসা ১৭৩ জনের মধ্যে ১৪৪ জন বাংলাদেশী নাগরিক বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বন্দি ছিলেন মিয়ানমারের কারাগারে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘ফেরত আসা বাংলাদেশীরা যখন আসবে তখন সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ থাকবে, ইমিগ্রেশনের লোক থাকবে, তারাই মূলত বিষয়গুলো দেখভাল করবে।’

যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশে
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিয়ানমার নৌ বাহিনীর জাহাজটি দেশটির সিটওয়ে বন্দর থেকে বাংলাদেশে রওনা দেয়। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের তোলা হয় মিয়ানমার নেভাল শিপ চিন ডুইংয়ে।

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে ফেরত পাঠানো ওই ১৭৩ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাগরিক কক্সবাজার জেলার। তাদের মধ্যে ১২৯ জনের বাড়িই কক্সবাজারে।

বাকিদের মধ্যে ৩০ জন বান্দরবানের, সাতজন রাঙামাটির এবং খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার রয়েছে একজন করে।

মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, এই ১৭৩ জনের মধ্যে ১৪৪ জন বাংলাদেশী দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাদের সবার সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে আগেই।

বাকি ২৯ জনের সাজার মেয়াদ শেষ না হলেও এই ফেরত পাঠানোর উদ্যোগের সময় তাদেরকে বিশেষ ক্ষমার আওতায় আনা হয়।

বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আগে তাদেরকে রাখা হয় সিটওয়ের কারাগারে। বুধবার সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তোলা হয় দেশটির নৌ বাহিনীর জাহাজে।

মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর এ এস এম সায়েম বলেন, ‘সবার আগে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাই করে দেখেছে আটককৃত ওইসব নাগরিকরা বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক কী না। সেটি নিশ্চিত হওয়ার পরই ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।’

মিয়ানমারে কেন আটক হয়েছিলো বাংলাদেশীরা?
মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় ওই বাংলাদেশীরা এই সীমানা পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মিয়ানমারে প্রবেশ করেছিল বলে জানাচ্ছে মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস।

দূতাবাস কর্মকর্তা সায়েম বলেন, ‘বাংলাদেশের যে সব নাগরিক এদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে তাদের কারো কাছে কোনো ধরনের ডকুমেন্টস ছিলও না। যখন আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গা থেকে জানানো হল তারা বাংলাদেশের নাগরিক, তখন আমরা যাচাই বাছাই শুরু করলাম।’

দূতাবাস বলছে, এই বাংলাদেশীদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কেউ মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কেউ কেউ আবার সে দেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের পর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়।

বিভিন্ন সময় আটক হওয়া ব্যক্তিদের দেশটির আইন অনুযায়ী সাজাও দেয় মিয়ানমারের আদালত। আদালতের দেয়া সাজার মেয়াদ ১৪৪ জনের শেষ হয়।

দূতাবাস কর্মকর্তা সায়েম জানান, বাকি যে ২৯ জনের মেয়াদ শেষ না হলেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়ার পর বিশেষ বিবেচনায় তাদের ক্ষমা করা হয়, যাতে তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে পারেন।

এরপর মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সরকারের সাথে কয়েক দফায় বৈঠক করে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। সেখান থেকে একে একে ১৭৩ জনের তালিকা তৈরি করে কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে তাদের মিয়ানমার নৌ বাহিনীর জাহাজে তোলা হয়।

সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ওই নাগরিকরা বিভিন্নভাবে আটকা পড়েছিল। তাদের দেশে ফেরত আনা হচ্ছে।

মঙ্গলবার সকালে ইয়াঙ্গুনের বাংলাদেশে দূতাবাসের ফেসবুক পেইজে আপলোড করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দরে বাংলাদেশী নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত করার তাদের জাহাজে ওঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

একই জাহাজে ফেরত যাবে মিয়ানমারের বিজিপি
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সে দেশটির জান্তা বাহিনীর যুদ্ধ চলছে প্রায় ছয় মাস ধরে। এর জের ধরে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যসহ ৩৩০ জন।

এরপরই তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। কয়েক দফা আলোচনা শেষে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৩০ মিয়ানমার নাগরিককে সে দেশে ফেরত পাঠায়।

এরপর গত প্রায় আড়াই মাসে কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশের পালিয়ে আসে বিজিপি সদস্যসহ আরো ২৮৫ জন।

তাদেরকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগের মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মিয়ানমারের ওই নাগরিকদের নিতে যে জাহাজ বাংলাদেশে আসবে, তাতে ফেরত আসবে দেড় শতাধিক বাংলাদেশী।

তাহলে কী দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজে বাংলাদেশে ফেরত আনা হচ্ছে? এমন প্রশ্ন করা হয়েছিলো মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তার কাছে।

যদিও এই প্রশ্নের কোন উত্তর তারা জানা নেই বলে জানান দূতাবাস কর্মকর্তা সায়েম।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন বলছে, ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিরা এদেশের জলসীমায় প্রবেশের পর তাদের গ্রহণ করা হবে ইমেগ্রেশন ও বিজিবির তত্বাবধানে। ওই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ওই জাহাজে তোলা হবে মিয়ানমারের নাগরিকদের।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন মোহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘মিয়ানমার নৌ বাহিনীর জাহাজটি কখন নাগাদ বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছাবে সেটি আমরা নিশ্চিত নই। বিজিবি ও ইমিগ্রেশন বিভাগ পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবে। তাদেরকে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করবে জেলা প্রশাসন।’

মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাসের আশা বুধবার দুপুরের মধ্যেই জাহাজটি পৌঁছাবে বাংলাদেশে।

কাউন্সিলর সায়েম বলেন, ‘বাংলাদেশীদের যে জাহাজে ফেরত নেয়া হচ্ছে তা নেভাল ফোর্সের জাহাজ। সুতারং ওই জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে মিয়ানমার নৌবাহিনী।’

প্রথম দফায় যেভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছিল
গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে মিয়ানমারের যে সব নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রথম দফায় ৩৩০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছিলো কক্সবাজার থেকেই সমুদ্র পথে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে দুই দফায় বাংলাদেশের একটি জাহাজে করে তাদেরকে কক্সবাজারের জেটি ঘাট থেকে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করা মিয়ানমারের একটি জাহাজে তুলে দেয়া হয়।

সকালে প্রথম দফায় ১৬৫ জন ও বিকেলের দিকে বাকি ১৬৫ জনকে ঘাট থেকে জাহাজে করে মিয়ানমারের জাহাজে তুলে দেয়া হয়।

এর আগে ওই দিন ভোরে দুটি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ১২টি বাসে করে কক্সবাজার ইনানীর জেটিঘাট এলাকায় মিয়ানমার পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্য ও অন্যদের জড়ো করা হয়। প্রাথমিকভাবে জেটি ঘাটের কাছে একটি অস্থায়ী শেডে রাখা হয় তাদের। সেখান থেকেই একে একে তোলা হয় জাহাজে।

এছাড়া, চারটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঘাটে নেয়া হয় দেশটির আহত নাগরিকদের।

নিজ দেশের নাগরিকদের নিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় আগে থেকেই অবস্থান করে সে দেশের নৌ বাহিনীর একটি জাহাজ। আইনি জটিলতার কারণে তখন সেই জাহাজটিকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি বাংলাদেশের জলসীমায়।

ওই দিন সকালে মিয়ানমারের পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল আসেন। তারা আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের তালিকা দেখে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।

ওই সময় ফেরত পাঠানো ৩৩০ জনের মধ্যে ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, চারজন বিজিপি পরিবারের সদস্য, দুইজন সেনা সদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য এবং চারজন ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।

এবারের যে ২৮৫ জনকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদেরও বেশিরভাগই বিজিপির সদস্য।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশীদের নিয়ে মিয়ানমারের যে জাহাজটি আসছে, সেটিই তাদের সীমান্তরক্ষীদের নিজ দেশে নিয়ে যাবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement