০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


লোকছড়ার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

-

ছড়া লোকসাাহিত্য তথা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। এগুলো লোকসমাজের অনায়াস সৃষ্টি হলেও সমাজের উত্থান-পতনের ধারা বরাবর এর মধ্যে ধরা পড়েছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে সর্বত্রই এ রকম ঘটেছে। ভাষার বিকাশ ও উৎকর্ষের সাথে সাথে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের নানা ধরন সৃষ্টি হলে ছড়ারও উৎকর্ষতা ঘটেছে। ভাষায় নতুন শক্তি নতুনের শাখা (কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি) সৃষ্টি করে চললেও ছড়ার উৎকর্ষতা প্রায় উপেক্ষিত থেকেছে। কেননা ছড়া রইল লোক-মানুষের মুখের ভাষার কাছে, সহজ চিন্তার সরল প্রকাশের মধ্যে আবদ্ধ। তবুও ছোটদের মন ভোলাতে, বড়দের অদ্ভুত রসের জোগান দিতে কিংবা সাময়িক হালকা রসের অভাব মেটাতে ছড়ার আবেদন বাড়তে থাকে।
গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ কঠিন কথা, কঠিন ভাষা বোঝে না। তারা যেমন সহজ-সরল, সাদামাটা জীবন পছন্দ করে তেমনি তাদের বলার মধ্যেও একটা সহজ-সারল্য ভাব প্রকাশ পায়। তাই তাদের কাছে ছড়া কোষ্ঠ-কাঠিন্য কোনো ব্যাপার নয়, তাদের কাছে ছড়া হচ্ছে সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির সরলতম প্রকাশ। যেখানে থাকতে পারে অশালীন-অমার্জিত ভাষা এবং অসংলগ্ন-অযৌক্তিক কোনো কথামালা। আর এ কারণেই লৌকিক ছড়া কখনো ‘স্বপ্নদর্শী মনের অনায়াস সৃষ্টি’ হিসেবে, কখনো ‘ভাবের অসম্বন্ধতা’ ও ‘ভাষার অপরিপক্বতা’-এর মাপকাঠিতে সংজ্ঞায়িত হয়েছে।

প্রত্যেক জাতির মধ্যে তার সাহিত্যকর্মের দু’টি ধারা প্রচলিত। একটি মৌখিক, অপরটি লিখিত। লিখিত ধারাটির উদ্ভবের আগে কেবল মৌখিক ধারাটিরই অস্তিত্ব ছিল। ক্রমে সমাজে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারের ফলে লিখিত ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে, সব দেশেই মৌখিক ধারাটির ওপর ভিত্তি করে লিখিত ধারার সৃষ্টি ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের লোকসাহিত্যও এ মৌখিক ধারারই একটি রূপ। বাংলা লোকসাহিত্য কোনো এক বিশেষ সময়ে রচিত হয়নি। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা সহজভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এ ধারাটির মাধ্যমে। আধুনিক লোকসাহিত্যের রূপ লিখিত এবং তা সাহিত্যের মানসম্পন্ন।
চর্যাপদ তথা বাংলা কাব্য সাহিত্যের বেলায় চিহ্নিত একটি সময়কাল থাকলেও লোকসাহিত্য তথা ছড়া সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেটি এখন পর্যন্ত অনুদঘাটিতই রয়েছে। মানবসমাজের কোনো স্তরে এসে যে ছড়ার উদ্ভব ঘটেছিল তার সঠিক ইতিহাস কেউ দিতে পারে না। জনৈক বিদেশী লোকবিজ্ঞানী ছড়ার উদ্ভব সম্পর্কে বলেছেন- “The popular rhyme is a striking example of the poetic primitive, going back in its construction and psychological essence almost to the primitive archaic times, and at the same time it is frequently an expressian of new ideas and attitudes among the masses of the peopele.” - অর্থাৎ কাব্যকলার আদিম যুগের মানুষের সময় থেকে জনপ্রিয় ছড়া চলে আসছে এবং যুগের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের মধ্যে তা নতুন ধ্যান-ধারণার বাহন হয়েছে।
লৌকিক ছড়ার উদ্ভব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গ্রাম্য সাহিত্য’ প্রবন্ধে বলেছেন- আমার হাতে যে ছড়াগুলো সঞ্চিত হইয়াছে তাহা অপেক্ষাকৃত পুরাতন কি নুতন নিঃসন্দেহে বলিতে পারি না। কিন্তু দুই-একশত বৎসরে এ সব কবিতার বয়সের কম-বেশি হয় না। আজ পঞ্চাশ বছর পূর্বে পল্লীর কবি যে ছড়া রচনা করিয়াছে তাহাকে এক হিসাবে মুকুন্দরামের সমসাময়িক বলা হয়, কারণ; গ্রামের প্রাণটি যেখানে ঢাকা থাকে কালস্রোতের ঢেউগুলো সেখানে তেমন জোরের সাথে ঘা দিতে পারে না। গ্রামের জীবনযাত্রা এবং সেই জীবনযাত্রার সঙ্গী সাহিত্য বহুকাল বিনা পরিবর্তনের একই ধারায় চলিয়া আসে।

লোকসাহিত্য বিশারদ আশরাফ সিদ্দিকী বলেন- ‘কোনো কোনো লোকবিজ্ঞানী ছড়াকে লোকসাহিত্যের আদিমতম সৃষ্টি বলতে চান। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে ছড়া অপেক্ষা ধাঁধা বা হেঁয়ালিকেই প্রাচীন বলতে হয়। ধাঁধার সাথে আদিম মানুষের বহু বিশ্বাস- সর্ব প্রাণবাদ-পূর্বপুরুষের পূজা কোনো দৈব দুর্বিপাক থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া ইত্যাদির দর্শন পাওয়া যায় কিন্তু ছড়ায় এসব বড় একটা নেই। তা ছাড়া ছড়ায় যে ছন্দ-সৌন্দর্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাকেও আদিম সৃষ্টি বলা যেতে পারে না। সঙ্গীত অপেক্ষাকৃত সভ্য মানুষের সৃষ্টি। ছড়াকেও আমরা বরং সঙ্গীতের পূর্ব পর্যায় বলতে পারি।’
ছড়া যে সদা পরিবর্তনশীল- এ কথা বুমফিল্ড, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ দেশী-বিদেশী মনীষীগণ লোকসাহিত্যের আলোচনায় অনেক জায়গায়ই ব্যক্ত করেছেন। ছড়া পাঠান্তরের সাথে সাথে এর ভাষারও পরিবর্তন ঘটে। প্রাচীন ভাষা ত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত নতুন ভাষা গ্রহণ করে ছন্দ-সৌন্দর্যের নতুনত্বের প্রকাশ ঘটায়। তাই ভাষা বিচার করে ছড়ার বয়স নির্ণয় করা কঠিন। ডাক ও খনার বচনের প্রাচীনত্ব খুঁজতে গিয়ে লোকবিজ্ঞানী আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন- ‘কিন্তু এই ছড়াগুলি যেভাবে এক দিকে উড়িষ্যা এবং অপর দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করিয়াছিল এবং এখনও যেভাবে সাধারণ সমাজের মধ্যে প্রচলিত রহিয়াছে, তাহা দ্বারা ইহাই মনে হইতে পারে যে, ইহারা দীর্ঘকাল পূর্বেই রচিত হইয়াছে। কেবলমাত্র মুখে মুখে জনসমাজের মধ্য দিয়ে প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। কোনো কোনো ছড়ার মধ্যে ভাষাগত প্রাচীনত্বও কিছু কিছু রক্ষা পাইয়াছে। তাহা হইতে মনে হয়, মধ্য যুগের বিভিন্ন সময়েই ইহারা রচিত হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ছড়ায় লোকসাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো ভাষা আধুনিকতায় রূপান্তরিত করিয়া লওয়া হইয়াছে; কারণ এই বিষয়ে ইহাই রীতি; সেই জন্য ভাষা হইতে ইহাদের প্রাচীনত্বের পরিচয় পাওয়া কঠিন।’
সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন- ‘লোকসাহিত্যের উদ্ভব কখন কোন অতীতে হয়েছিল আমরা জানি না। এর ক্রমিকতা নেই, নিশ্চিন্ত একনিষ্ঠতা নেই; অনবরত পুনঃনির্মাণ, অস্বীকার এবং অনির্বাদ লোকমানস নির্ভর আনন্দের প্রশ্রয়ে যুগে যুগে এর নতুন নতুন বিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে লোকসাহিত্যের ছড়ার ক্ষেত্রে একথা বেশি সত্য।’
প্রসঙ্গক্রমে তাই বলা যায়- লিখিত সাহিত্য যখন স্বকীয়ভাব সুষমামণ্ডিত হয়নি; ভাষা যখন আধফোটা ছিল, বস্তুজ্ঞান ছিল যখন নিতান্ত হালকা বা অগভীর, রস প্রাচুর্যের যখন কোনোই অভাব ছিল না, ঠিক তখনই লৌকিক ছড়ার উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কোনো অজানা সময়কাল থেকে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মুখে ভর করে প্রচলিত ছড়াগুলো আমাদের লোকসাহিত্যে স্থান করে নিলেও তার রচয়িতা বা নির্দিষ্ট রচনাকাল তাই এখনো গবেষকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি বা আবিষ্কৃত হয়নি।
বাংলা সাহিত্যে গদ্যের উদ্ভব অনেক পরে হওয়ার কারণে কবিতার কথাই আলোচনার প্রারম্ভে চলে আসে। ‘চর্যাপদ’ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ধারণা করা হয় বাংলাদেশের লৌকিক ছড়ার প্রচলন ছিল আরো অনেক আগে থেকে। যে কোনো কারণেই হোক পণ্ডিত-গবেষকদের আলোচনায় স্থান করে নিতে ব্যর্থ হবার ফলে লোকসাহিত্যের তথা সাহিত্যের ইতিহাসে ছড়া তেমন একটা উজ্জ্বলতা পায়নি।
গ্রামবাংলার মানুষের কাছে খনার বচন অত্যন্ত পরিচিত। এখনো কৃষির সাথে সম্পৃক্ত খনার বচনগুলো পল্লীগাঁয়ের গুরুজনেরা ব্যবহার করে জ্ঞান দান করে থাকেন। খনার কৃষি সম্পর্কিত একটি বচন-

হাত বিশে করি ফাঁক।
আম-কাঁঠাল পুঁতে রাখ ॥
গাছ-গাছি ঘন সবে না।
ফল তাতে ফলবে না ॥
ডাকের বচনও খনার বচনের ন্যায়। নীতি ও উপদেশমূলক এসব বচন একশ্রেণীর বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধকদের (ডাকদের) মুখ থেকেই বিস্তৃৃতি লাভ করেছে-
নিয়ড় পোখরী দূরে যায়।
পথিক দেখিয়া আউড়ে চায় ॥
পরসম্ভাষে বাটে থিকে।
ডাক বলে এ নারী ঘরে না টিকে ॥
মানুষের মুখে মুখে খনা ও ডাকের বচন বিস্তৃতি লাভ করেছে বাংলার বাইরেও। আসাম ও উড়িষ্যাতেও খনা ও ডাকের বচনের প্রচলন আছে। এ বিস্তৃতির দিক লক্ষ্য করে আশুতোষ ভট্টাচার্য খনা ও ডাকের বচনকে মধ্য যুগের রচনা বলে মনে করেন। আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ‘এই ডাক ও খনার বচনের কতকগুলি যে বাঙ্গালার বৌদ্ধযুগের তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই।’
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’- শিশু-কিশোরদের একটি জনপ্রিয় খেলার ছড়া। এ ছড়াটি থেকেও ঐতিহাসিক কিছু তথ্য এবং সময়কাল দুই-ই আন্দাজ করতে পারা যায়-
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাক-মৃদঙ্গ ঝাঝর বাজে॥
বাজাতে বাজাতে চলল ডুলি।
ডুলি গেল সেই কমলা পুলি॥
কমলা পুলির টিয়েটা।
সূর্যি মামার বিয়েটা ॥

এ ছড়াটি সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচক বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন। তবে অধিকাংশ সমালোচকের মতে- ‘আগডুম’ অর্থ অগ্রগামী ডোম সৈন্য, ‘বাগডুম’ অর্থ পার্শ্ববর্তী ডোম সৈন্য, ‘ঘোড়াডুম’ অর্থ অশ্বারোহী ডোম সৈন্য। ছড়াটি বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করে দেয়। সেন রাজাদের সময়ে সেনাবাহিনীতে ডোম সৈন্যদের অত্যন্ত প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এ প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন- “একদিন ডোম সৈন্যই বাংলার পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা করিত। বিষ্ণুনগর, রাজনগর প্রভৃতি স্থানের সামন্তরাজগণকে ডোম সৈন্যদল রক্ষা করিত। মধ্যযুগের বাংলা লৌকিক সাহিত্য তাহাদের শৌর্য-বীর্যের কাহিনীতে পরিপূর্ণ।” অতএব ছড়াটি মধ্যযুগের ডোম সৈন্যদের সময়কালে রচিত হয়েছে বলে অনুমিত হয়।
‘আমার কথাটি ফুরুলো’- একটি সুপরিচিত জনপ্রিয় ছড়া। লোককথা, উপকথা, রূপকথা, প্রভৃতি গল্পের কাহিনীর শেষে সাধারণত এ ছড়াটি বলা হয়ে থাকে-
আমার কাইনী ফুরুলো।
নটে গাছটা মুড়–লো ॥
ক্যানডা নটে মুড়–লি?
গোরুতে কেন খায়?
ক্যানডা গোরু খাস?
রাখাল কেন চরায় না?
ক্যানডা রাখাল চরাসনা?
বউ কেন ভাত দ্যায় না?
ক্যানডা বউ ভাত দিসনে?
ছেলে কেন কাঁদে?
ক্যানডা ছেলে কাঁদিস?
পিঁপড়ে কেন কামড়ায়?
কুটুর কুটুর কামড়াবো,
চালার ভেতর সাধবো।

এই ছড়াটির একাধিক পাঠান্তর পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গায়। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, ছোটনাগপুর ও মধ্য ভারতের কোনো দেশের অধিবাসীর মধ্যেও এ ছড়াটি প্রচলিত আছে। সেন রাজাদের সময়ে অনেক তেলেঙ্গা সৈন্য (অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী) পশ্চিমবঙ্গে বসবাস শুরু করে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও তেলেঙ্গাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ মনে করেন- “অনুমান করা যাইতে পারে বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে তেলেঙ্গাদের নিকট হইতে বাঙ্গালী তাহার এই সুপ্রসিদ্ধ ছড়া পাইয়াছে।” আর আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন- “দ্রাবিড় ভাষা ও উপজাতীয় অঞ্চল হইতে ইহা উড়িষ্যা ও বাংলায় বিস্তার লাভ করিয়াছে।”
‘মাসি-পিসি বনগাঁবাসী’ ছড়াটির মধ্যে ‘গৌড়’ শব্দের উল্লেখ দেখে অনেক সমালোচক ছড়াটিকে প্রাচীনবলে দাবি করেন। ছড়াটি হলো-
মাসি পিসি বনগাঁবাসী বনের ধারে ঘর।
কখনো মাসি বলে না যে, খই মোয়াটা ধর ॥
কিসের মাসি কিসের পিসি কিসের বৃন্দাবন।
এত দিনে জানিলাম মা বড় ধন ॥
মাকে দিলুম আমন দোলা।
বাপকে দিলুম নীলে ঘোড়া ॥
আপনি যাব গৌড়।
আনব সোনার মউর।
তাইতে দেব ভায়ের বিয়ে।
আপনি নাচব ধেয়ে ॥

প্রাচীনকালে মুর্শিদাবাদ, মালদা ও বীরভূম জেলাকে গৌড় নামে অভিহিত করা হতো। ষষ্ঠ শতক থেকে গৌড় জনপদ পরিচিতি লাভ করতে থাকে। সপ্তম শতকে রাজা শশাংক গৌড় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হলে আস্তে আস্তে উত্তরবঙ্গ, উড়িষ্যা ও বিহার পর্যন্ত এর বিস্তৃতি হতে থাকে। বারো শতকের শেষ ভাগে গৌড়াধিপতিদের পতন ঘটে। তেরো শতকের প্রথম ভাগে গৌড় মুসলমান শাসকদের অধীনে চলে আসে। পরবর্তীতে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সময় (১৪৯৩-১৫৩৮) গৌড়ের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। তাই ‘গৌড়’ শব্দটিই এর অতীত ঐতিহ্যের সাথে সোনালি সময়কালকেও স্মরণ করে দেয়।
পেশা হিসেবে কৃষি অত্যন্ত প্রাচীন। কৃষি সম্পর্কিত অনেক ছড়াই আমাদের লোকসাহিত্যে ছড়িয়ে আছে। বিজয় গুপ্তের “পদ্মপুরাণ” (১৪৯৪)-এর বন্দনা অংশের একটি পঙক্তি ‘সোনার খাটে বসে দেবী রূপার খাটে পাও’- এর সাথে কিয়দংশের মিল পাওয়া যায় একটি শিশু ভুলানো ছড়ার-
খুকুমনির বিয়ে দিবো ষটমালার দেশে
তারা গাই বলদে চষে,
তারা হীরায় দাঁত ঘষে।
তারা রূপার খাটে পা ছড়িয়ে সোনার খাটে বসে।
ওয়াকিল আহমদ মনে করেন ছড়াটি পদ্মপুরাণের প্রভাবিত এবং ঐ সময়ের (১৪৯৪ খ্রি:) পরবর্তী রচনা। কিন্তু মধ্যযুগের অনেক লিখিত সাহিত্যই ‘মৌখিক ঐতিহ্য’-এর ‘ভিত্তিস্বরূপ ব্যবহৃত হইয়াছে’- এ কথা সত্য হলে ছড়াটি বরং পদ্মপুরাণের কবি বিজয়গুপ্তের সমসাময়িক কালের কিংবা অব্যহিত পূর্বের বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫) ফার্সি ভাষা ব্যাপক প্রতিষ্ঠা পায়। সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ধারণা গড়ে ওঠে ফার্সি পড়লে চাকরি পাওয়া সহজ হবে। নিচের ছড়াটিতে তৎকালীন সময়ের এমন চিত্রই পাওয়া যায়-
আর্শি আর্শি আর্শি।
আমার স্বামী পড়–ক ফার্সি ॥
ষোল ও সতের শতকে চৈতন্যদেব ও বৈষ্ণব ধর্মকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে নব্য মানবীয় প্রেমভক্তির বিকাশ ঘটে। গৌড়ীয় এই প্রেমভক্তি রসাশ্রয়ী বিপুল ঐশ্বর্যময় পদাবলী সাহিত্যের ধারা গড়ে ওঠে। নিচের শিশুবিষয়ক নাচের ছড়াটিতে সংমিশ্রণ ঘটেছে বাকুড়া জেলার বনবিষ্ণপুরের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের প্রভাব-

ধেই ধেই চাঁদের নাচন।
বেলা গেলে চাঁদ- নাচবি কখন ॥
নেচে নেচে কোলে আয়।
সোনার নেপুর দিব পায় ॥
নেচে আয়রে নীল মণি।
তোমার নাচন দেখব আমি ॥
মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর অনেক কবিতাতেই লৌকিক ছড়ার সুর ও শব্দ অনুরণিত হয়েছে। নিচের ছড়াটির মধ্যে পদাবলীর কবি চণ্ডিদাসের অনুশোচনার বেদনা অনুভব করা যায়-
দৈয়ারে দৈয়া কি কর বৈয়া
ঢেউয়ে শিং লড়ে।
আমি ত মরি বাদ-বিবাদে।
পক্ষিনী কি হালে তরে ॥
ফল খাইলাম ফুল খাইলাম
ভাচ্ছিয়া ভরাইলাম কায়া।
সুজনর সঙ্গে পিরীত করি
মরণে ন ছাড়ে দিয়া ॥
এ সম্পর্কে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন- “এই সকল পদ হইতে স্পষ্ট বোঝা যায়, চণ্ডীদাসের রাধা-কৃষ্ণ পদগুলির ভিত্তি কোথায়। এ সকল চণ্ডীদাসের পরবর্তী কি না বলিতে পারি না, কিন্তু সমস্ত বাংলাদেশে যে সকল কবিতা কোন পূর্বযুগে ফুলের মতো ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহারই পরবর্তী বৈষ্ণব কবিতায় যোগদান দিয়াছে, তাহা স্পষ্ট বোঝা যায়।”
‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ একটি জনপ্রিয় ঘুমপাড়ানি ছড়া। ছড়াটি পাবনা অঞ্চলসহ উভয় বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত আছে। ছড়াটির ঐতিহাসিক কিছু তথ্য থেকে এর সময়কাল সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। ছড়াটি হলো-
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজন দেবো কিসে?
ধান ফুরালো, পান ফুরালো খাজনার উপায় কি?
আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।

ছড়ার মধ্যে ‘বর্গী’ শব্দের উল্লেখ দেখে আঁচ করা যায় নবাব আলিবর্দী খাঁর শাসনামলে (১৭৪০ খ্রি:) বর্গী হামলার সময়ে রচিত হয়েছিল এই বহুল প্রচলিত ছড়াটি। এমন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে আরো অনেক ছড়ার উদ্ভব সময়কাল সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। নিচে এমন কিছু ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ ছড়ার উল্লেখ করা হলো :
আইলরে ফিরিঙ্গি দল।
দেশটা গেল রসাতল ॥
সবার মুখে কোম্পানির দোয়াই।
আল্লাহ রসুল দেশে নাই ॥
ইংরেজ দেখখ্যা মাইয়ার দল।
চাইয়া হাসে খল খল ॥
মনে তাদের কি যে চায়।
কেউনা তাহা টের পায় ॥
বাবুয়ানা বিবিয়ানা।
ঘরে-বাইরে একটানা ॥
ছড়াটি যে ইংরেজ আগমনের সময়কালে (১৭৫৭) রচিত তা স্পষ্টই বোঝা যায়। ইংরেজদের আগমনে বাঙালিরা খুশি হতে পারেনি। কেন খুশি হতে পারেনি তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী ছড়াটিতেই-
কি হলোরে জান।
পলাশীর ময়দানে নবাব হারাল পরান ॥
তীর পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি পড়ে বয়ে।
একলা মীর মদন সাহেব কত নিবে সয়ে ॥
ছোট ছোট তেলিঙ্গাগুলি লাল কোর্তা গায়।
হাঁটু গেড়ে মারে তীর মীর মদনের গায় ॥
নবাব কান্দে সিপাই কান্দে আর কান্দে হাতি।
কলকাতায় বসে কান্দে মোহনলালের পুতি ॥
দুধে ধোয়া কোম্পানির উড়িল নিশান।
মীর জাফরের দাগাবাজিতে গেল নবাবের প্রাণ ॥
ইংরেজদের চাল-চলন বেশ-ভূষাও বাঙালির পছন্দনীয় ছিল না। এসব পোশাক-আশাকের প্রভাব নব্য শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও পড়তে থাকে, তার প্রমাণ ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাতেও আমরা পেয়ে থাকি। পাবনা অঞ্চলে প্রচলিত কিশোর-কিশোরীদের একটি খেলার ছড়ায় এরকম সাহেবি বেশভূষার পরিচয় পাওয়া যায়-
ওপেনটি বায়স্কোপ
নাইন-টেন টেস্কোপ।
চুলটানা বেবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠক খানা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। এ সময় থেকে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতিই যৌথভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিলাতি বস্ত্র বর্জন ও দেশীয়বস্ত্রের ব্যবহার। এ সময় থেকেই চরকার ব্যাপক প্রচলন এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। নিচের ছড়াটি এ কথাই প্রমাণ করে-
চরকা আমার ভাতা পুত
চরকা আমার নাতি,
চরকার দৌলতে আমার
দুয়ারে বান্ধা হাতি।
চরকা আমার আশয়-বিষয়
চরকা আমার হিয়া,
চরকার দৌলতে আমার
সাত পুতের বিয়া।
চরকা আমার ঘুরেরে
ভন ভন ভন,
চরকা আমার বুকের লউ
সাত রাজার ধন।
বাংলা-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন যুগের বিপ্লবের ইতিহাস এমন অনেক ছড়া থেকে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন (১৯৩৯-১৯৪৫) সময়ের একটি ছড়া-
সা-রে-গা-মা- পা-ধা-নি
বোম ফেলেছে জাপানি।
বোমের মধ্যে কেউটে সাপ
বৃটিশ বলে বাপরে বাপ !
১৯৬৯ -এর গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আয়ুব খানের পতন হয়। নিচের ছড়াটিতে আয়ুবের পতনের চিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে-
আয়ুব বেটা গরু চোর
বেড়া ভেঙে দিলো দৌড়।
ধরলো কেঠা ধরলো কেঠা
বীর বাঙালি! বীর বাঙালি!
১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নায়ক টিক্কাখান এবং এর সময়কালকেও লৌকিক ছড়া চিহ্নিত করে রেখেছে-
ইলিশ মাছের তিরিশ কাটা বোয়াল মাছের দাড়ি,
টিক্কা খান ভিক্ষা করে বাংলাদেশের বাড়ি।
এর পরই শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য মরণপণ যুদ্ধ। এ যুদ্ধ চলাকালে বাংলার সর্বত্র তাই স্বাভাবিকভাবেই ধ্বনিত হয়েছে-
বীর বাঙালি অস্ত্র ধর।
বাংলাদেশের স্বাধীন কর!
আশির দশকের শেষের দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০-এ এসে ব্যাপক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর পরই নিরপেক্ষতার জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। তখন রাজনৈতিক দলগুলো উদ্ভাবন করে-
এই মুহূর্তে দরকার
কেয়ারটেকার সরকার।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে লোকছড়ার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। স্লোগান থেকে শুরু করে পোস্টার, ফেস্টুন, দেয়াল লিখনেও ছড়া ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এভাবেই পরিবর্তিত এবং আবর্তিত হয়েছে আমাদের ছড়া সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারা। বাংলাদেশের লৌকিক ছড়ায় যেমন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় সমাজের উত্থান-পতনের অনেক সামাজিক চিত্র। আর এসব তথ্য ও চিত্র থেকেই আমরা ছড়ার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে পারি।


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশ-সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে ইউরিয়া সার কারখানার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন আগামী ২ বছর উন্নয়নশীল এশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশ থাকার আশা এডিবি প্রেসিডেন্টের চুয়াডাঙ্গায় আগুনে পুড়ে পানবরজ ছাই মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, রিমান্ডে নেয়া হবে : ডিবি বৃহস্পতিবার সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ ভূরুঙ্গামারীতে চিকিৎসকের কপাল ফাটিয়ে দিলেন ইউপি সদস্য ‘পঞ্চপল্লীর ঘটনা পাশবিক, এমন যেন আর না ঘটে’ টি২০ বিশ্বকাপের পিচ পৌঁছেছে নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়া কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে লাশ উদ্ধার মোরেলগঞ্জে বৃদ্ধের ফাঁস লাগানো লাশ উদ্ধার

সকল