০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিষাদময় ঈদ

-

পরিযায়ী পাখির ডানায় ভর করে নেমে এলো সন্ধ্যা। তারপর প্রকৃতি ধীরে ধীরে মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাতের আবরণে। ঈদের নতুন চাঁদ উঁকি দিয়েছে পশ্চিম আকাশে। চারিদিকের বাজি-পটকার শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে হানিফ ব্যাপারির হৃদয় প্রকম্পিত হচ্ছে। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে ঈদের চাঁদ দেখতে পাওয়ার সুসংবাদ। আগামীকাল ঈদ। অস্বস্তিতে বারবার নিঃশ্বাস ছাড়ে হানিফ ব্যাপারি। অতঃপর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা ধরল- ঈদ আইছে তো আমার কী অইছে। শালারা ঈদ পালন করব। মজার ঈদ।’ গালাগাল শুনে রান্নাঘর থেকে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করে হানিফ ব্যাপারির সহধর্মিণী হাজেরা বেগম-
-কী কও গো, স্বপনের বাপ?
-আর কইও না, মাইকে প্রচার করতাছে চাঁন উঠছে। চাঁন যে উঠছে হেইডা আবার মাইকে, টেলিভিশনে কইয়া দ্যাওন লাগব? না কইলে যেন চাঁনডা মিছা অইয়া যাইব। বাজি ফুডায়, হুন্ডার দৌড়ায়, পিকপারে, মওজ করে, শালার ব্যাডারা।
-করুক, তোমার মনডা যে খারাপ হেইডা তো আমি জানি। শোনো স্বপনের বাপ, চিন্তা কইরা কি কিছু অইব? আল্লøায় যা করছে হেইডাই মাইন্না লওন লাগব।
একবুক ব্যথাভরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে আধমরা কঙ্কাল হাজেরা বেগম। পুরোনো দিনের ব্যথাতুর স্মৃতি মনে পড়তেই হানিফ ব্যাপারির দুচোখ ভরে গেল দুঃখশ্রুতে।
হাজেরা বেগম আর হানিফ ব্যাপারির বিয়ে হয়েছে অনেক দিন হলো। হানিফ ব্যাপারি আর হাজেরা বেগম ভালোবেসে, মন দেয়ানেয়া করেই বিয়ে করেছিল। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তাদের ঘর আলোকিত করে ভূমিষ্ঠ হয় ফুটফুটে সুন্দর মায়াবী চেহারার অধিকারী স্বপন। স্বপনই তাদের সুখের মূল উৎস। ছেলের জীবনকে সুন্দর ও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে শৈশব-জীবনের প্রাচীর পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখতেই ছেলেকে ইট-পাথরের ব্যস্ত নগরীতে পাঠিয়ে দেয় হানিফ ব্যাপারি। গেল বছর সে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে খুব করে বায়না ধরেছে, নতুন বাইক কিনে দিতে হবে। না কিনে দিলে সে এবার ঈদে বাড়িতে আসবে না। একটি মাত্র ছেলে, তাই হানিফ ব্যাপারিও আর না করতে পারেনি। ঈদের আগের দিনই ছেলের জন্য নতুন বাইক কিনে এনেছিল।

দীর্ঘ একটি বছর পর আজ ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে স্বপন। দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকলেও সে ভুলতে পারেনি তার ছোটবেলার খেলার সঙ্গীদের। এ দূরত্ব যেন আরো কাছে টেনে নিয়েছে তাদেরকে। বেড়েছে বন্ধুত্বের টান, ভালোবাসা। বাড়িতে এসেই স্বপন চলে গেছে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। বন্ধুদের সাথে দেখা করা, পুরোনো সেই আড্ডা, সব মিলিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়েছে স্বপনের। তাই সকালে স্বপনের ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। স্বপন গোসল সেরে মা-বাবাকে সালাম করতেই মা ছেলেকে ঈদ সালামি দিলেন, আর বাবা সালামির সাথে একটি নীল পাঞ্জাবি এবং নতুন বাইকের চাবি স্বপনের হাতে তুলে দিলেন। বাবার দেয়া নীল পাঞ্জাবি পরে মিষ্টিমুখ করে স্বপন বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঈদগাহে চলে গেল।
ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে বাইক নিয়ে বের হচ্ছিল স্বপন, এমন সময় হাজেরা বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন-
-কোথায় যাচ্ছিস স্বপন? স্বপন জবাব দেয়,
-সিনেমা দেখতে যাচ্ছি মা!
হাজেরা বেগম ধার্মিক মানুষ, ছেলেকে বাধা দিতে গিয়ে বললেন-
-ঈদের এই পবিত্র দিনে কেউ গুনাহের কাজে যায়? স্বপন প্রত্যুত্তরে বলল ‘এবারই শেষ মা, আগামীতে আর যাবো না। মা তবুও বাধা দিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে স্বপন সিনেমা দেখতে চলে গেল। সিনেমা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে এলো। রাস্তায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। সবার সাথেই আলাদা আলাদা বাইক ছিল। তাই বাড়ি ফেরার পথে সবাই রেইস লাগাল। ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে স্বপনের নতুন বাইক। এমন সময় স্বপনের মোবাইল টুনটুন শব্দে বেজে উঠল। রেইসে আছে বলে আর মোবাইলটা ধরল না স্বপন। তিন-চারবার রিং হওয়ার পর স্বপন ভাবল হয়তো মা কল করেছেন, রিসিভ না করলে খুবই চিন্তিত হবেন। তাই সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে রিসিভ করতে যাবে, এমন সময় সামনের দিক থেকে ছুটে আসা দ্রুতগামী একটা ট্রাক এসে অনেক জোরে ধাক্কা দিলো স্বপনকে। ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে বাইক থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল সে। বাইকটি ট্রাকের চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে বেশ দূরে সরে গেল। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল স্বপন। মৃত্যু গ্রাস করে ফেলল স্বপনকে। রাস্তার পাশে পড়ে রইল স্বপনের নেতিয়ে পড়া নিথর দেহ। স্বপনের জীবনের ইতি এখানেই ঘটে গেল। সখের বাইক বেশিক্ষণ সঙ্গ দিলো না তার।
বছর ঘুরে আবার এলো সেই ঈদ! ফের হানিফ ব্যাপারিকে কাঁদাতে। হাজেরা বেগম হাত বুলাতে থাকে হানিফ নামক জীবন্ত লাশের উপর। সান্ত¡না দেয় একে অপরকে। নিজের অজান্তেই হুহু করে কেঁদে উঠে হানিফ ব্যাপারি। কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে শোকের অশ্রু। ঈদের চাঁদের লাল রঙে ভস্মীভূত হয় হাজেরা বেগম ও হানিফ ব্যাপারি।
ঈদের চাঁদ লজ্জা পেয়ে যেন লুকিয়ে ফেলে পশ্চিম আকাশের আঁধারের অতল তলে। শুধু লজ্জা পায় নি মানবরূপী সেই রাক্ষস ড্রাইভার।
ঈদের দিন ঢাক ঢোল ডিজের বিষাক্ত আওয়াজে প্রকম্পিত ধরণীর মধ্যে হারিয়ে যায় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’।
ঢাকা পড়ে যায় ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু’ ও ‘ঈদ মোবারক’ এর মতো পবিত্র কালামগুলো।


আরো সংবাদ



premium cement