৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাংলা কবিতায় শব্দশৈলী

-

জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির দৃষ্টিভঙ্গির শিল্পময় প্রকাশ কবিতা। একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, অভিজ্ঞতা-সংবেদনা ও মননের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে কবিতার জন্ম। ব্যক্তির মধ্যে যখন কল্পনার ডানা বিস্তার করে, কালজ্ঞান কল্লোলিত হয় এবং ঐতিহ্যচেতনা প্রেরণা জোগায় তখন কবিতা নির্মিত হয়। তাই কবিতা শিল্পকলার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে প্রকাশিত হয় আনন্দময় আবহে। পৃথিবীর মানুষের মাতৃভাষারূপে কবিতা আজো জগতে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণে সমর্পিত। প্রেম-দ্রোহ, সুখ-দুখ, সুন্দর-অসুন্দর, সৃষ্টি-বিনাশের মানবীয় অনুভূতিতে বিচিত্র রঙ-রূপরেখায় কবিতা সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ কবিতার ধারায় জারিত; যুগে যুগে কবিতার স্রোতে আনন্দিত ও আধুনিককালে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় বিন্যস্ত। সে জন্য কবিতা শুদ্ধতম শিল্পকলা ও নান্দনিকতার চূড়ান্তরূপ।
মানুষের ভাবপ্রকাশ ও যোগাযোগের একমাত্র যথাযথ মাধ্যম ভাষা। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাথমিক চালিকাশক্তি হলো ভাষা। ভাষা ছাড়া মানুষের অস্তিত্বের প্রকাশ কল্পনাতীত। মানুষের সৃষ্টি ও বিকাশের অপরিহার্য শর্ত হলো ভাষা। ভাষাশিল্পের প্রধান উপকরণ শব্দ। মানুষ সভ্যতার যে স্তর বা বর্বরতার যে পর্যায়ে বাস করেছে, যে দেশ বা যুগেই তা হোক না কেন, সে শব্দে বা রেখায়, বর্ণে বা ধ্বনিতে যা কিছু সৃষ্টি করে সেগুলো তার চেতনা ও বোধের সামগ্রী। কবিতার ক্ষেত্রে কবির একমাত্র মাধ্যম শব্দ, যা বোধ বা ধারণার প্রতীক। কবিতা এ অর্থে শব্দ বা ভাষাগত বোধের শিল্প। আর কবিতার প্রকাশ-রূপ শিল্পায়ত্ত শব্দের বিশেষ বিন্যাস। ভাস্কর্যের সাধন যেমন প্রস্তর, চিত্রকলার উপায় যেমন বর্ণ, সঙ্গীতের বাহন যেমন ধ্বনি, কবিতার উপাদান তেমনি শব্দ। এই শব্দের মিলিত রূপ সৃষ্টি করে কাব্যভাষার (Poetic Diction) ইমারত, কবিতার শরীর- যার আত্মায় থাকে অর্থ।

কবিতায় শব্দব্যবহারের শৈলীই (Style বা কাব্যভাষা মূলত এক কবি থেকে অন্য কবিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেয়। গভীরভাবে তা কবির্ধমের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এ জন্য কবিতায় শব্দ-সংস্থানে দক্ষতা অর্জন প্রকৃত কবিকে করতে হয়। কবিতা হলো ‘কবির এমন এক অনুভূতি যা রচয়িতার নিজস্ব গন্ধময় শব্দ নির্বাচন ব্যতিরেকে অভিব্যক্ত হয় না।’ [আল মাহমুদ, কবির সৃজনবেদনা] একজন সমালোচকের ভাষায় : The poet achieves his effects not only by the general style of his language, but by his use of particular words. [M.J. O’donnell, Feet on Ground] সে জন্য কবিতায় শব্দচয়নের ভিন্নতাই সৃষ্টি করে কাব্যপ্রকাশে স্বাতন্ত্র্য। একজন কবি অগ্রজ কাব্য-ইতিহাসের উত্তরাধিকার নিয়েই শুধু সন্তুষ্ট থাকেন না, সৃজন-ক্ষমতার গুণে সে বিপ্লবী না হলেও ‘স্বতন্ত্র’ কবি হিসেবে কবিতাঙ্গনে চিহ্নিত হতে চান। ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকারের মতে,
এও লক্ষ করতে হবে যে, সমস্ত কবি খুব সচেতনভাবে এই অভিনব বা প্রথাভঙ্গের স্পর্ধা দেখান না; বেশির ভাগই একটা সাধারণ কাব্যভাষার উত্তরাধিকারের মধ্যে থেকে কাজ করেন, সেই উত্তরাধিকারে কোনোরকম বিপর্যয় বা ক্রমভঙ্গ না ঘটিয়ে, তারই মধ্যে নিজের ব্যক্তিত্বকে অল্পবিস্তর চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর চেষ্টা এই থাকে যে, বিপ্লবী হিসেবে না হোক, তাঁকে ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে চেনা যাক।
[পবিত্র সরকার, ‘জীবনানন্দের কাব্যভাষা’, অনষ্টুপ,]
আধুনিক কবিরা কবিতাকে শব্দের সম্ভবনা নির্ণয়ের একটি বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করেন। অর্থাৎ একটি ভাষায় ব্যবহৃত শব্দসামগ্রী অর্থ প্রকাশের দিক থেকে কতটা সক্ষম, কবি কবিতা রচনার সময় তার পরীক্ষা করে থাকেন। কবি তাঁর অনুভূতির যথার্থ শব্দের পরিমাপে করতে চান। কবির বক্তব্য কী, কবিতায় তা নির্ণীত হচ্ছে কি না; অথবা কবিতাটি কতগুলো লোকের বোধগম্য হবে তাও কোনো বিচার্য বিষয় নয়। একটি মাত্র বিচার্য বিষয় হলো : কবি তাঁর চৈতন্যে একটি বিশেষ মুহূর্তে যে অনুভূতিকে ধারণ করেছেন, সেই অনুভূতি শব্দের ধ্বনিরূপে এবং বিশেষ পদ্ধতিতে কতটা উন্মোচিত তা আবিষ্কার করা। এর ফলে, মানুষের দৈনন্দিন সংলাপের আবরণ থেকে কবিতা মুক্ত হয়েছে।
তবে একজন কবি কবিতার জন্যে শব্দ আহরণ করেন জীবন থেকে, চারপাশের পরিবেশ ও পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে। আবার এই শব্দ তিনি সংগ্রহ করেন পুরোনো কাব্য, বিশ্ব-ঐতিহ্য, আন্তর্জাতিক কাব্যধারা থেকে। এভাবে কবিতার জন্য বিভিন্ন সূত্রে তিনি শব্দ নির্বাচন করে কাব্যভাষা সৃষ্টির মাধ্যমে একজন নতুন কবিরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। জীবনানন্দের ভাষায় :
আমরা মনস্বী অগ্রজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব এ রকম একটা পরামর্শ এঁটে নতুন কবিরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে না। প্রত্যেক বিশিষ্ট কবিই তাঁর যুগ ও সমাজ সম্বন্ধে সচেতন থেকে ভাবনাপ্রতিভার আশ্রয়ে যখন কবিতা লিখতে যান, তখন তাঁর কবিতার আঙ্গিক ও ভাষা বিচিত্রভাবে সৃষ্ট হয়- এমন একটি অপরূপ সঙ্গতি পায় যা তাঁর কবিতায়ই সম্ভব- অন্য কারু কবিতায় নয়। [জীবনানন্দ দাশ, কবিতার কথা]

২.
কবিতার আঙ্গিক বিশেষণে শব্দব্যবহারের কৌশল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইংরেজি ও ফরাসি কবিতার ক্ষেত্রে যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছে, শব্দ ব্যবহারের কৌশলও এর বিশেষ পরিচয়। [সৈয়দ আলী আহসান, আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে] ইংরেজি ভাষার আধুনিক লেখকদের মধ্যে দু’জন প্রধান পুরুষ- এজরা পাউন্ড এবং জেমস জয়েস যৌবনকালে প্যারিসে নিজস্ব শব্দ নির্মাণের শিল্পে ব্যস্ত ছিলেন। এঁদের উভয়ের ওপর ফরাসি প্রতীকবাদ এবং রূপকল্প অসম্ভব প্রভাব বিস্তার করে। এজরা পাউন্ড কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে Imagist Movement-এর প্রবর্তন করেন। [জে. আইজাকস্, আধুনিক কাব্যের পটভূমি] এই ইমেজিস্ট মুভমেন্টের মূল প্রতিপাদ্য হলো- কবিতায় শব্দকে এমন এক সীমায় পৌঁছে দিতে হবে, যেন প্রতিটি শব্দ একটি অনুভূতির যথার্থ প্রতীক হয়। যেমনভাবে চীনা লিপি পদ্ধতিতে প্রতিটি চিহ্ন বা চিত্রই একটি বস্তুর প্রতীক অথবা একটি আবেগের প্রতীক, তেমনিভাবে কবিতায় শব্দকে এজরা পাউন্ড পূর্ণভাবে প্রতীকী করতে প্রয়াসী হন।
আধুনিককালের যা প্রধান ধর্ম অর্থাৎ বস্তুকে আবেগের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা না করা, এজরা পাউন্ড সেই কলাবিধিকে আবিষ্কার করতে গিয়ে কবিতায় শব্দ ব্যবহারের চূড়ান্ত পরীক্ষা আরম্ভ করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) আগে থেকেই এই পরীক্ষার সূত্রপাত হয় বলেই মহাযুদ্ধজনিত বিপর্যয় এবং সর্বনাশের কাহিনীকে ধারণ করবার অধিকার আধুনিক কবিতা অর্জন করে। আধুনিককালের সব প্রকার জিজ্ঞাসার বাহন হিসেবে কবিরা শব্দকে এবং আঙ্গিককে পাওয়ার ফলে মহাযুদ্ধের কারণে সমাজ-জীবনের অবক্ষয়, ধর্ম ও নীতির পরাজয় এবং মানুষের অসহায় অস্তিত্ব সহজেই কবিতায় পরিস্ফুট হতে পেরেছে। অন্য দিকে স্টেফেন মালার্মে কবিতার শব্দকে বক্তব্য প্রকাশের পরিসীমা হিসেবে নির্দেশ করেন। একজন ভাস্কর যেমন করে কঠিন প্রস্তরখণ্ডকে কেটে নতুন মূর্তি নির্মাণ করেন, তেমনি মালার্মে প্রতিদিনের ব্যবহার থেকে শব্দকে গভীর দ্যোতনার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফরাসি কবিদের শব্দসচেতনতার ইতিহাস অনেক পুরনো। [Joseph Chiari, Contemporary French Poetry] আধুনিককালে ফরাসিদের মতেষ্ণ সূক্ষ্ম চেতনা নিয়ে শব্দকে ব্যবহার করবার চেষ্টা ইংরেজি কবিতায় এজরা পাউন্ডই প্রথম করেছিলেন। এর ফলে তাঁর ভাষা শাণিত হয়েছিল। এজরা পাউন্ডের ‘Riposter’ (১৯১২) এবং ‘Lustra’ (১৯১৬) কাব্যগ্রন্থে শব্দ ব্যবহারের ফরাসি প্রয়োগবিধি লক্ষ্যযোগ্য। এজরা পাউন্ডের প্রধান কৌশল ছিল ইউরোপের মধ্যযুগের কাব্য থেকে শব্দের ব্যবহার ও ধ্বনিমাহাত্ম্য আবিষ্কার; ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষায় গ্রিক মহাকাব্যের অনুবাদের ফলে শব্দ ব্যবহারের বিবর্তন লক্ষ করা এবং সর্বোপরি সঙ্গীতের সূক্ষ্ম কলা-কৌশলকে কবিতার ছন্দ এবং ধ্বনি প্রকৃতির মধ্যে আবর্তিত করা।

৩.
বাংলা কবিতায় উনিশ শতকের আগেই কবিদের মধ্যে ভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ভাষার অন্তর্ভুক্ত শব্দগুলোর ব্যবহার-কৌশল সম্পর্কে যথার্থ চৈতন্য তখনো কবিদের মধ্যে দেখা যায়নি। যে চৈতন্যকে আমরা আধুনিক চৈতন্য বলি তা আধুনিককালের ফসল। একটি কবিতার ভাষায় কোন্ বিশেষ প্রকৃতির শব্দব্যবহার হবে, সেই শব্দের পাশে অন্য কোন্ শব্দ বসবে, ধ্বনিগত সাম্যে একটি শব্দ অন্য একটি শব্দের সঙ্গে কিভাবে সংযুক্ত হবে- এ চিন্তা অতীতে করা হয়নি। পাশ্চাত্য সাহিত্যে শব্দ ব্যবহারের সচেতনতা দ্বারা আধুনিককালের সূচনাকে চিহ্নিত করা হয়। বাংলা কবিতায় সর্বপ্রথম সজ্ঞানভাবে শব্দের ব্যবহার এবং শব্দের অর্থগত নয়, ধ্বনিগত বিশ্লেষণ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩)। [সৈয়দ আলী আহসান, আধুনিক বাংলা কবিতা] এর আগে বাংলা কবিতা ছিল একটা প্রথাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ; হয় তা অতি সরলায়িত ভাষায়, নয়তো জটিল তৎসম ভাষায় রচিত হতো। কিন্তু ভাষার শব্দগুচ্ছ যেমনই হোক না কেন- তৎসমই হোক বা তদ্ভবই হোক অথবা দেশজই হোক, কাব্যে তার ব্যবহার-রীতির ক্ষেত্রে একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন আনেন মধুসূদন। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে তাঁর প্রবর্তিত তিনটি পরিবর্তনের মধ্যে প্রথমটি হলো শব্দ সম্পর্কে সচেতনতা এবং দ্বিতীয়টি শব্দের ধ্বনিকে ঠিক পার্শ্ববর্তী শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত না করে পরবর্তী চরণ এবং আরো পরের অন্য চরণের মধ্যে প্রবহমান করা। তৃতীয় যে পরিবর্তন মধুসূদন এনেছিলেন, সেটি ছন্দের ক্ষেত্রে। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ-ও এক বিস্ময়কর ঘটনা।
আধুনিক সময়ে কবিতায় শব্দের প্রভাব প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শব্দবিন্যাসে বিচিত্র কৌশলের মধ্যে দিয়ে আধুনিক কবি তার মনোভঙ্গিকে প্রকাশ করে থাকেন। বাংলা কাব্যে এই আধুনিকতা মধুসূদনের হাতে সূত্রপাতের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধারায় আরো অগ্রসর হয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে শব্দকে সাজিয়েছেন এবং শব্দ নতুন বিশ্বাসে গরিয়ান হয়ে আধুনিক জীবনের প্রত্যাশাকে উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বহু বিচিত্রভাবে শব্দকে বিন্যাস এবং তার জন্য নতুন নতুন অনুষঙ্গ নির্মাণ করেছেন। বাংলা ভাষার সীমাকে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কাব্যভাষায় সঞ্জীবনী শক্তি দান করেন। বারবার নিজের কাব্যভাষাকে নতুন আঙ্গিকে উত্তরণ ঘটান। আধুনিকতার এই বিস্ময়কর প্রত্যয় রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যতটা স্বাক্ষরিত অন্য কারো কবিতায় ততটা নয়।

৪.
রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় শব্দব্যবহার একটি ব্যক্তিগত রূপসজ্জায় সর্বপ্রথম প্রকাশ পায় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রতিনিধিত্বমূলক। নজরুল প্রতিনিধি হলেন তাঁর আপন চাঞ্চল্য, স্বভাব ও উচ্ছ্বাসের। ফলে কবিতা তাঁর ব্যক্তিগত চৈতন্যের সহচর হয়ে ওঠে। সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি থেকে উদ্ভূত একটি সঙ্কটের মধ্যে কবি অবস্থান করেছেন এবং এমন অবস্থিতি কবির চিত্তে একটি ব্যক্তিগত ক্ষোভ এবং যন্ত্রণা জাগিয়েছে; তারই পরিচিতি শব্দের বিশেষ ব্যবহারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। মানুষের চিত্তে ক্ষোভ তখনই জাগে যখন সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে একটি বিচূর্ণ ব্যক্তিত্ব আপন অস্তিত্বকে আবিষ্কার করার জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শান্তি ও স্বস্তিজনিত যে নীরবতা, নজরুলের কবিতা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতো। নজরুলের আবির্ভাব এমন এক সময়ে, যখন কবিতা শব্দের মোহময়তায় সহশীলতার চরমে গিয়ে পৌঁছেছে। এ মোহময় আবেষ্টনী প্রথম ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। [বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ সঙ্কলন] কিন্তু এ ক্ষেত্রে যথার্থ সার্থকতা আসে নজরুল ইসলামের হাতে। তাঁর বক্তিত্বের চাঞ্চল্য, আত্মমুক্তি ও মানবমুক্তির সাধনা, শ্রেণিহীন সাম্যবাদী ও গণচেতনাসম্পন্ন সমাজ নিমার্ণে তাঁর কবিতার শব্দবিন্যাসকে নতুনত্ব দিয়েছে। সেই সাথে অসম্ভব কথার কলগুঞ্জনে ও অবধারিত উচ্ছ্বাসের প্রতিষ্ঠায় তিনি বাংলা কবিতার জন্য একটি নির্বাচনীয় রূপলোক নির্মাণ করেন।
বাংলা সাহিত্যে আকৃতিগত এবং ভাবনাগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কবিতার নতুন রূপলোক নির্মাণে তিরিশের দশকের কয়েকজন কবির ভূমিকা অনন্য। রবীন্দ্রনাথের পর তিরিশের কবিদের হাতে বাংলা কবিতায় শব্দের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আসে। এই দশকেই পূর্ববঙ্গের মানুষের দৈনন্দিন মুখের ভাষাকে কাব্যরূপ দিয়ে জসীমউদ্দীন সম্পূর্ণ আলাদা এক মেঠোপথ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মধ্যেই আধুনিকতাবাদী কবিতার ধারায় সৃজনমুখর হন অধিকাংশ কবি; তবে জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের দু’টি স্বতন্ত্র ধারা আল মাহমুদ, ওমর আলী ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায় এসে এক মোহনায় মিলিত হয়। পরবর্তীকালে নানামুখী প্রবাহ এখানে সৃষ্টিশীল হয়।
বিষয়ানুগ শব্দাবলির সমাবেশ, শব্দের সম্ভাবনা ও বিকাশ, কাব্যরীতি ও কথ্যরীতির মিশ্রণ, ধ্বনিব্যঞ্জনার সৃষ্টি, বিশেষ্য-বিশেষণের নিজস্ব ব্যবহার এবং আঞ্চলিক শব্দরাজির ব্যাপক প্রয়োগে বাংলাদেশের কবিতা মৌলিকতা, স্বাতন্ত্র্য ও শক্তিময়তার পরিচয়ে প্রকাশিত।


আরো সংবাদ



premium cement