২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতি বিস্মৃতির টানাপড়েন

-


মনুষ্য স্বভাবের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম বৈশিষ্টই হচ্ছে ভুলে যাওয়া। জীবনের অনেক স্মৃতি ভুলে যেতে পারি বলেই তো আমরা বেঁচে থেকে সুখ পাই, প্রাত্যহিক কাজকর্ম মন দিয়ে করতে পারি। জীবনের এমন অনেক স্মৃতি থাকে যেগুলো আমাদের বেঁচে থাকার জন্য ভুলে যাওয়াটা খুবই অনিবার্য হয়ে পড়ে। কেননা সেসব লেনাদেনা স্মৃতির এলব্যাম হাতড়ে তুলে আনলে মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। আর এমন পরিস্থিতিকে আমরা বলি মনমরা।
আবার-এর বিপরীতে এমনো হয় যে, শত চেষ্টায়ও আমরা আমাদের জীবনের অনেক স্মৃতি, লেনাদেনা... ভুলতে পারি না। যেমন, আমরা ভুলতে পারি না আমাদের শৈশব কৈশোরের সেই দূরন্তপনার দিনগুলো, ছোট ভাইবোন মিলে পড়তে বসে মাইর খাওয়াটা, স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে শরীরের কোথাও বড় ধরনের চোট লাগার ঘটনা, ক্লাসের দূরন্তপনা। আমরা ভুলতে পারি না মায়ের আদর, বাবার শাসন আর উভয়েরই অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভোলা হয় না কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রারম্ভের লাজুক লাজুক ভঙিতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখা সেই মেয়ে বা ছেলেটির ভালোলাগা বা একতরফা প্রেমে পড়ার কথা। ভোলা হয় না প্রথম যৈবিক শিহরণ আর দু’টি মনের প্রেমে পড়ার কথা। যদিও শুনেছি জীবনে কেউ কেউ বহুবার প্রেমে পড়ে!

তবুও তারাও কি প্রথম প্রেমের ইতিহাস ভুলতে পারে?
প্রতিটি ভাষাতেই একটি গুণবাচক শব্দের বিপরীত শব্দ থাকে। যেমন ভালো-এর বিপরীতে মন্দ, ভালোবাসার বিপরীতে ঘৃণা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক তেমনই স্মৃতির বিপরীত শব্দ হচ্ছে বিস্মৃতি বা ভুলে যাওয়া। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ থেকে এবার স্মৃতি এবং বিস্মৃতি এই দু’টি শব্দ সম্পর্কে একটু চোখ বোলানো যাক।
স্মৃতি [বি] ১. মনে মনে অতীত বিষয়ের অনুশীলন বা পুনরাবৃত্তি; স্মরণ। ২. মনে রাখার ক্ষমতা; স্মরণশক্তি। ৩. স্মারকচিহ্ন। ৪ ধ্যান।...(পৃষ্ঠা: ১১৮৩)
আর বিস্মৃত [বিন] ১ বিস্মৃতিযুক্ত; ভুলে গেছে এমন। ২ মনে নেই এমন... বিস্মৃতি বি স্মৃতিলোপ; বিস্মরণ। (পৃষ্ঠা: ৮৮৯)।
বাংলা একাডেমির এই ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর সাহায্য আমরা তাহলে স্মৃতি এবং বিস্মৃতি শব্দের আরো নিরেট ও গ্রন্থগত সঠিক অর্থটা অনুধাবন করতে পারলাম।


কখনো কখনো এই বিস্মৃতি বা ভুলে যাওয়াটা অন্য পক্ষের মনোবেদনার কারণ হয়। তখন যার অনেক ঘটনাকে ভুলে যাওয়া হয় সেই মানুষটি খুব আক্ষেপ করে বলে এত সহজে ভুলে গেলে! এ ক্ষেত্রে সেই লোকটি অপরজনকে মনে রেখেছে। বিপরীতে সে ভুলে গেছে। আবার এর বিপরীতে আমরাও অনেককে মনে রাখি আবার তাদের কেউ কেউও আমাদের অনেকেই ঘটনাক্রমে ভুলে যায়। এটাই জীবনের বাস্তবতা। কিন্তু এই সাধারণ মানুষের মধ্যে আবার কিছু কিছু মানুষ আছেন যার অতি ভাবালুতার কারণে ব্যতিক্রম। কবি আল মাহমুদের মতে ‘পৃথিবীর জাতিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বিচিত্র ধরনের মানুষ জন্মায় যাদের আমরা বলি কবি। যারা ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।’... কবিরাই হলেন এই বিস্মৃতিপ্রবণ মানবজাতির অনুপকারী স্মরণশক্তির একমাত্র প্রতিনিধি।’ এই কবিরাই কবিতা পড়তে পড়তে স্মৃতির জাল বুনে যান। কবিদের বেদনাময় স্মৃতি গর্ভবতী হয়ে যখন একটি কবিতা জন্ম নেয় সেই আনন্দ কবির সব বেদনাকে মলিন করে দিয়ে স্মৃতির বিজয় নিশ্চিত করে। আবার কবির একটি সুখ স্মৃতিও চিরকাল তার কবিতায় উৎকীর্ণ করে রাখোন। ফলে মনুষ্য স্বভাবের কারণে অনেক স্মৃতি একটা সময়ের জন্য কবিদের মনে একটা আলোআঁধারি তৈরি করলেও তা স্পষ্টত কবিতায় বেঁচে থাকে। পৃথিবীর মহৎ কাব্যগুলো লেখার পেছনে কবিদের স্মৃতির তাড়া অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে চিরকাল। আবার কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই বিস্মৃতি বা ভুলে যাওয়ার প্রবণতাও থাকে প্রবল। এমন স্বভাবের মানুষকে অতি স্বার্থপর বা অকৃতজ্ঞও বলা চলে। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় ‘বিস্মরণের মানুষ কবি নয়।’
মনে রাখা দরকার যে, এই স্মৃতি এবং বিস্মৃতি বিষয় দু’টি একান্তই ব্যক্তির মনচর্চার বিষয়। তবে মোদ্দা কথা হচ্ছে : সবসময় স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকাটা যেমন সাধারণ মানুষের কাজ নয়, আবার যা মনে রাখাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তা চর্চা করা কর্তব্য। কেননা অকৃতজ্ঞ হয়ে অতীত ভুলে যাওয়াটাও প্রকৃত মনুষ্য স্বভাবের বিপরীত। আর কে না জানে যে, প্রতিটি মানুষের জন্মও একটি ইতিহাস এবং স্মৃতি। একদিন মৃত্যু এসেও তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিষাদময় স্মৃতি হয়। ঘটনাবহুল আমাদের জীবনের সবকিছুই মনে রাখা সম্ভব হয় না। আবার সবকিছু ভুলে যাওয়াও সম্ভব হয় না। তাই স্মৃতির বিপরীত শব্দ বিস্মৃতি হলেও এই স্মৃতি আর বিস্মৃতির শত টানাপড়েনের মধ্যেও মনে হয় যেন এই শব্দ দু’টি একে অপরের সহোদর।

 


আরো সংবাদ



premium cement