০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আমার এবনে গোলাম সামাদ

জন্ম : ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৯, মৃত্যু : ১৫ আগস্ট ২০২১ -

দুর্ভাগ্য, সুযোগ আমাদের কল্যাণমুখী না করে চোর বানিয়ে দিয়েছে। তবে গাঙ্গেয় বাংলায় বুদ্ধিজীবীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে না। নিজেরাই সুযোগ সৃষ্টি করে নেয়। তারপর ষোলো আনা তার সদ্ব্যবহার করে। এই রকম অবস্থায় প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ নিয়ে এই রচনাটি মোটেই নিরপেক্ষ হবে না। কারণ তিনি কখনোই এই গর্হিত কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। না তিনি সুযোগসন্ধানী ছিলেন, না ছিলেন সুবিধাবাদী। আমিও সুবিধাবাদের ভূগোলের বাসিন্দা নই। আমি তার গুণগ্রাহী। সে কারণে আমার কথা মোটেই নিরপেক্ষ হবে না।
আমি মনে করি, আমাদের মননশীল, সৃজনশীল সৌরলোকের ভরকেন্দ্র কাজী নজরুল ইসলাম। আর এই আকাশকে নক্ষত্রখচিত করেছেন, খন্দকার শামসুদ্দীন মোহাম্মদ সিদ্দিকী, মীর মশাররফ হোসেন, আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আকরাম খাঁ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়া, মুহাম্মদ আবদুল হাই, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহীম খাঁ, সৈয়দ আলী আহসান, দেওয়ান মোহাম্মাদ আজরফ, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, আবু মোহামেদ হাবীবুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার, মোহর আলী, আবদুল করিম প্রমুখ।

যাদের নাম উল্লেখ করলাম, তারা সবাই যে ‘সাধুবাবা’ ছিলেন এমন মনে করার কারণ নেই। কিন্তু আমাদের আজকের জীবনের ভিতটা নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন তারাই। এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন এবনে গোলাম সামাদ। আবার একমাত্র নজরুল ছাড়া হাঙর কুমিরের ঢেউয়ের বিরুদ্ধে অন্যদের তেমন একটা লড়াই করতে হয়নি। তাকে একদিকে লড়তে হয়েছে পরাক্রান্তশালী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের ভয়ঙ্কর রক্ষণশীলতার মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। এবনে গোলাম সামাদকেও অন্যভাবে এই দুই রণক্ষেত্রে রক্তাক্ত হতে হয়েছে। তার এক পাশে রক্তচক্ষুর ফ্যাসিবাদী শাসক, অন্য দিকে সুবিধাবাদের স্রোতে ভেসে যাওয়া লালসাকাতর, মেরুদণ্ডহীন, সুযোগসন্ধানী বুদ্ধিজীবী ও আধিপত্যবাদের পায়ে সেজদায় পড়ে থাকা গণমাধ্যম। তিনি নিঃসঙ্গ প্রান্তরে একা এক তালগাছের মতো যুঝেছেন প্রবল প্রতিকূলতার সঙ্গে। তিনি কিছুরই পরোয়া করেননি। কেয়ার করেননি। তিনি নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ হতে হতে নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ হয়েছেন। কিন্তু তার উপলব্ধ জ্ঞান ও বিশ^াসের মৃত্তিকা থেকে কখনই বিচ্যুত হননি। তাকে উৎপাটিত করা যায়নি। মাথা নত করা বলতে যা বুঝি, তিনি তার ধারে কাছেও ছিলেন না। সেজন্যই তাকে ইমাম মেনেছি। তার জন্যই যেন নজরুলের উচ্চারণ :

ভীরু মানবেরে প্রবল করিতে চাহেন যে দুনিয়াতে,
তারেই ইমাম নেতা মানি আমি প্রেম মোর তারই সাথে।
আড়ষ্ট নরে বলিষ্ঠ করে যার কথা যার কাজ,
তারই তরে সেনা সংগ্রহ করি গড়ি তারই শর-তাজ।

দুই.
যে অর্থে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী শব্দের ব্যবহার আমি তাতে সন্ত্রস্ত। এদের সংস্পর্শে যেতেও অনীহা আমার। কারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘দিনরাত প্রখর বুদ্ধিমানের সঙ্গে থাকিলে নিজের বুদ্ধি লোপ পায়। ছুরিতে অবিশ্রাম শান পড়িলে ছুরি ক্রমেই সূক্ষ্ম হইয়া অন্তর্ধান করে। একটি মোটা বাঁট কেবল অবশিষ্ট থাকে।’
যাদের সাথে নিজের দেশ ও জনগণের সম্পর্ক থাকে না, যাদের সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ নাই, তারা শরীর বিচ্ছিন্ন আত্মার মতো। আবার আত্মা ছাড়া শরীরের মতো। ফলে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা একেকজন পরিণত হয়েছেন প্রেতাত্মায়। পরিণত হয়েছেন ‘ডেডবডি’তে।
আমাদের বিরাজমান পরিস্থিতিটা অনুধাবন করলে দেখা যায়, যারা আজীবন দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী কর্মে নিমজ্জিত হয়ে, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ভাড়া খাটল, যারা ‘ধর্মের ষাঁড়’র মতো ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’ গলায় ঝুলিয়ে, দুই কানকাটা বেহায়ার মতো রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটল, সেই সব আত্মপ্রবঞ্চকরা দেশবরেণ্য। আর সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ছুড়ে দেয়া মলমূত্র খেয়ে যারা নাদুসনুদুস, তারাই হলেন মিডিয়াব্যক্তিত্ব।

যদিও রবার্ট বার্টন বলে গেছেন, ‘আমরা ইচ্ছে করলেই প্রতি বছর মেজর, জেনারেল, উকিল, ডাক্তার, শিক্ষাবিদ, আমলা তৈরি করতে পারি। কিন্তু বুদ্ধিজীবী তৈরি করতে পারি না।’-এই কথা পশ্চিমের চোখে হয়তো সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে উল্টো। কারণ ছাগল, পাগল, চোর, ধান্ধাবাজ, বাটপাররাই সাধারণত এ দেশের বুদ্ধিজীবী। প্লেটো বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে গেছেন, ‘বুদ্ধি যেখানে প্রবল, লালসা সেখানে দুর্বল।’- এ কথাও বাংলাদেশের বেলায় খাটে না। কারণ, এখানে দেখা যায়, বুদ্ধি যেখানে প্রবল, লালসা সেখানে ভয়ঙ্কর। তার পরও আমরা এবনে গোলাম সামাদের নিশান হাতে তুলে নেবো। তিনি ওই সব আত্মঘাতী সম্প্রদায়ের কেউ নন। তিনি ওই সব আলতু ফালতু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি বুদ্ধিজীবী কেবল নন, তিনি মনীষী। ‘সামান্যপীড়িত’ পাললিক জমিতে তিনি অসামান্য। তিনি আমাদের আত্মা দেখার আয়না। তিনি গ্রিক দেবতা প্রমিথিউসের মতো আমাদের দিয়ে গেছেন আগুনের সন্ধান। খুঁচিয়ে গেছেন আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। যে সঙ্কট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। তিনি আমাদের জাতিরাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যদশা দূর করে প্রদান করে গেছেন নির্ভরশীল আশ্রয়কেন্দ্র।
তিনি একজন উদ্ভিদবিদের মতোই আমাদের ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় চিহ্নিত করে, আগাছা পরগাছা উৎপাটন করে, আবাদ সুরক্ষার প্রকৌশল শিক্ষায় দিয়ে গেছেন। চিনিয়ে গেছেন সেই পথ, যে পথ দিয়ে শঙ্কামুক্তভাবে কষ্টের ফসল তুলতে হবে গোলাঘরে।

তিন.
সত্যের প্রতি তার অবিচল নিষ্ঠা এবং কর্তব্যপরায়ণতা তাকে করেছে একলা। কিন্তু তিনি ক্রমাগত হয়ে উঠেছেন জনগণের মননের নায়ক।
তাকে সবসময় আমার তুলনা করতে ইচ্ছে করেছে সক্রেটিস, আবু জার গিফারী, আবু হানিফা এবং মওলানা ভাসানীর সাথে। তারা হয়তো ঐতিহাসিক কারণে মানব সম্প্রদায়ের নমস্য। তারা ছিলেন ন্যায়ের প্রতি অকুণ্ঠ। সামাদ সেই ঐতিহাসিক স্তরে এখনই যেতে পারছেন না, কারণ এর জন্য দরকার হাজার বছরের অপেক্ষা। কিন্তু তাদের গুণাবলিই যে সামাদকে অভিষিক্ত করেছে সে কথা তো সত্য।
আমাদের জাতীয়তাবাদী, ইসলামী, আওয়ামী ও বাম বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায় :
চাকরি সূত্রে জাতীয়তাবাদী
সুবিধা সূত্রে ইসলামী,
তারাই করেন পিঠা ভাগাভাগি
বাম দোকানিরা বেশ নামী।
আওয়ামী খামারে ষাঁড়ের দম্ভ
সব ভূষিমাল দুনিয়াকামী।

এ ধরনের বাক্য সামাদ সম্পর্কে ব্যবহার করা অসম্ভব। কারণ তিনি সংস্থাপনের সাথে ন্যূনতম সম্পর্কও রাখেননি। পদ, পদবি, পদক, কনসালটেন্সি ও স্কলারশিপের কাছে আত্মা বিক্রয় করেননি। তার দৃঢ়তা, তার সততা, তার নৈতিকতা আমাদের পাথেয়। তার বহুমুখীন জ্ঞান আমাদের বাতিঘর। অন্ধকারের পথে সামনে এগুবার সবুজসঙ্কেত। তিনি যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই আমাদের বারবার বলে গেছেন,
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো একলা চলো রে ॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়-
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়-
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে-
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্ব¦লো রে॥

তিনি আমাদের সাহস, সৌন্দর্য ও শক্তির অপরিমেয় উৎস। তিনি বারবার বলতে চেয়েছেন, ‘করে হানাহানি/ তবু চলো টানি/ নিয়াছ যে মহাভার।’
তিনি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আর এক দশকের মধ্যেই ইসলামী বিশে^র ভাষা হয়ে যাবে বাংলা। এটা অনিবার্য। কারণ জনসংখ্যার স্বল্পতার কারণে হয়তো আরবি তার সর্বজনীনতা হারাবে। এই কথা বলার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে নিয়ে তিনি ভ্রƒক্ষেপ করেননি। কারণ, এটা তার দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ফল। আর এই ফলাফল প্রকাশে তিনি অকুতোভয়। আমরা তার এই উপলব্ধির সাথে একমত হই বা না হই, সেগুলো তার পরোয়ার বাইরের ইট পাথর। এটাই সামাদ। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। এই উপলব্ধির মাঝখানে কোনো মতলব নেই, নেই হাততালি পাওয়ার কোনো খায়েশ। এ ধরনের দৃঢ়তাই তাকে করেছে মহিমান্বিত।

তিনি ধর্ম-দর্শন নিয়ে বিস্তর কাজ করে গেছেন কিন্তু মোল্লা হননি। মার্কসবাদকে তিনি অধ্যয়ন করেছেন গভীরভাবে। যথেষ্ট আলোড়িত হয়েছেন। কিন্তু মওলানা ভাসানীর মতোই তিনিও মার্কসবাদী হননি। তিনি আসলে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের জাতিসত্তার প্রতীক। প্রতীক পুরুষ, বিশেষ করে মননশীলতার ক্ষেত্রে। তাকে অনুসরণ করার অর্থ আত্মবিশ^াসে পূর্ণ হওয়া। নির্ভয় হওয়া।
লেনিনের কথা দিয়েই শেষ করি, দুর্গম পথে, বরফের পথে চলতে এই ধরনের বুদ্ধিজীবীরা হলেন জনগণের গাড়ির দাঁতওয়ালা চাকা ও স্ক্রু। এদের ওপর ভর করে একটি জাতি এগিয়ে যায় প্রগতি ও শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের দিকে। -কথাগুলো হুবহু এবনে গোলাম সামাদের ক্ষেত্রে খাটে।


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশ-সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে ইউরিয়া সার কারখানার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন আগামী ২ বছর উন্নয়নশীল এশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশ থাকার আশা এডিবি প্রেসিডেন্টের চুয়াডাঙ্গায় আগুনে পুড়ে পানবরজ ছাই মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, রিমান্ডে নেয়া হবে : ডিবি বৃহস্পতিবার সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ ভূরুঙ্গামারীতে চিকিৎসকের কপাল ফাটিয়ে দিলেন ইউপি সদস্য ‘পঞ্চপল্লীর ঘটনা পাশবিক, এমন যেন আর না ঘটে’ টি২০ বিশ্বকাপের পিচ পৌঁছেছে নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়া কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে লাশ উদ্ধার মোরেলগঞ্জে বৃদ্ধের ফাঁস লাগানো লাশ উদ্ধার

সকল