২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুকুল চৌধুরীর কাব্যযাত্রা

-

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কাব্যসাহিত্যে কবি মুকুল চৌধুরী একজন ধ্যানী। প্রায় চার দশকব্যাপী তার কাব্যযাত্রা। এ যাত্রা খুব কম সময় নয়। বরং বলা যায় বেশ দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্যের নানা শাখায় তিনি বিচরণ করলেও কবি পরিচয় তার সর্বাগ্রে। তবে তিনি খুব বেশি কবিতা লিখেছেন এমনটি দাবি করা যৌক্তিক হবে না। দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ছয়টি। এই সংখ্যাকে আবার একবারে কম বলাও যায় না। কবি মুকুল চৌধুরীর কবিতাচর্চা শৈশব থেকে হলেও প্রকৃত কাব্যযাত্রা তরুণ বয়সেই। ক্রমে সে পথচলা হয়ে উঠেছে লাবণ্যময়। এ প্রসঙ্গে লেখকের বরাত প্রণিধানযোগ্য :

যেদিন শহরবাসী হলাম, শহর আমাকে পাল্টে দিলো। আমার শরীর থেকে আবদা হাওরের কাদা-মাটির প্রলেপ খসে পড়ল। আমার ¯œায়ু থেকে হাওরের মাতাল বাতাসের কাদাগন্ধী ভেজা ঘ্রাণ ক্রমে ঝরে পড়তে থাকল। আমি পাঠাগার চিনলাম, বই চিনলাম, শব্দ চিনলাম, শব্দের ঝঙ্কার চিনলাম। শব্দের সাথে শব্দ জোড় লাগিয়ে ভাব প্রকাশের অনাস্বাদিত এক কৌশল শিখলাম। এ সময় এক সংঘ-সংস্র্রব আমার অপূর্ণতাগুলো ধরিয়ে দিলো। অচিরেই আমি সেই অপূর্ণতা কাটিয়ে উঠে ছন্দের নৃত্যকে শব্দের পুচ্ছে বেঁধে দেয়ার দুর্লভ কারিগরিটি আয়ত্তে আনতে সচেষ্ট হলাম। আমি আমার কৈশোরে-কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে কাছ থেকে দেখা, ভেতর থেকে হইহুল্লোড় করে বেরিয়ে আসা চিত্রকল্পকে শব্দ দিয়ে আঁকতে শিখলাম। আমি শব্দকে প্রতিশব্দ দিয়ে চিনবার, চিনানোর যে কৌশলটি শিখলাম, তাতে আমার কাছে মনে হলো আমার কবিতার শরীর আরো লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে।

এই ছিল একজন সাধারণ মুকুল থেকে কবি মুকুল চৌধুরী হয়ে ওঠার যাত্রাপথ। মুকুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অস্পষ্ট বন্দর’। যা প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ১৯৯১। কাব্যটি প্রকাশের পরপরই তিনি কবি আল মাহমুদের প্রশংসা পেয়েছিলেন। তার ‘অস্পষ্ট বন্দর’-এর কাব্যের কবিতা পড়ে কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন :
মুকুল চৌধুরী তার কবি বন্ধুদের থেকে একটু স্বতন্ত্র কবি প্রতিভা। এরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র, এটি এ মুহূর্তেই আমি বলে নিচ্ছি। কিন্তু যে কারণে মুকুল চৌধুরী তার কবি বন্ধুদের চেয়ে স্বতন্ত্র সেটি হলো তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটি। তাছাড়া, তার কবিতায় কিছু গন্ধ আছে। প্রকৃতির গন্ধ।

মুকুল চৌধুরীর কাব্যবৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হিসেবে ‘তুরাগ নদীর তীরে’, ‘বৃষ্টির বিকল্প নেই’ কবিতার পঙ্ক্তি উল্লেখ করে কথাগুলো বলেছেন বাংলাসাহিত্যের প্রধান এই কবি।
মুকুল চৌধুরীর ‘অস্পষ্ট বন্দর’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি ‘অস্পষ্ট বন্দর’। কবিতাটি ‘ফররুখ আহমদ কবি-পুরুষেষু’কে উৎসর্গকৃত। এই কবিতাটি পাঠ করতে গিয়ে আমরা তার কাব্যযাত্রার পথের সন্ধান পাই। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি পঙ্ক্তি স্মরণযোগ্য :
মাস্তুলে আনাড়ি হাত,
পতপত শব্দ শুনে শিহরনে ওপরে তাকাই
ঝরনার পানির স্র্রোতে নুড়িতে নুড়ির ঘায়ে স্বপ্নময় যেমন গোঙানি
হাতের মুঠোয় দেখি মিছিলে রণিত এক
সবুজ পতাকা ধরে দাঁড়িয়েছি আমিও নাবিক!

যেতে হবে দূরে এক অস্পষ্ট বন্দরে।
হাতে ধরা সফরের ব্যবহার্য দ্বিবিধ তালিকা-
তার এই কবিতা পড়তে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় এলিয়টের সেই উক্তিটি- “ঘড় ঢ়ড়বঃ, হড় ধৎঃরংঃ ড়ভ ধহু ধৎঃ, যধং যরং পড়সঢ়ষবঃব সবধহরহম ধষড়হব.” কবি মুকুল যে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছেন সে বিষয়ে তিনি নিজেই জানাচ্ছেন ওপরের পঙ্ক্তিগুলোতে। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যখন তার কাব্য নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন : ‘আশির দশকের কবিতার একটি চারিত্রলক্ষণ-কবিতার ছন্দ-মিলে প্রত্যাবর্তন- মুকুল চৌধুরীর কবিতায় প্রথম থেকেই স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে। তার সাথে উল্লেøখ্য তাঁর কবিতার আর একটি বিশিষ্টতা- একটি আদর্শিকতার অনুধ্যান।’ এই যে আদর্শিকতার অনুধ্যান বা কবিতায় আদর্শবাদ এটি প্রত্যেক কবির মধ্যে কিছু না কিছু আছে। কিন্তু মুকুল যে আদর্শকে স্থান দিচ্ছেন সেই আদর্শের অগ্রপথিক চল্লিøশের মানবতাবাদী কবি ফররুখ আহমদ।

‘অস্পষ্ট বন্দর’-এর পর ক্রমে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল’১৯৯৪, ‘চা বারান্দার মুখ’ ১৯৯৭, ‘সোয়া শ’ কোটি কবর’ ২০০৩, ‘অপার্থিব সফরনামা’ ২০১১ ও ‘মাটির ঘটনা’ ২০১৫। এ নামগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশেষ অর্থ এবং তার শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম থেকে আমরা অনুমান করি তার অস্পষ্ট বন্দর ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার সেই জগৎ আদর্শবাদিতার অধ্যাত্মিক রঙে রঙিন। আর সেই আধ্যাত্মিকতার ভূগোল এই পৃথিবীর মানুষের জগৎ, মানবীয় চেতনা, সমাজ, রাষ্ট্র।
আর সেই মানুষের দুঃখ বেদনা বোধ নাড়া দেয় কবি মনে। কবি তো মানব বিপর্যয় দেখে চুপ থাকতে পারে না। চারপাশে ধ্বংস দেখে লিখে ফেলেন কবিতা। যদিও সেই কবিতা লিখতে গিয়ে নিজেই ভাষা হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় থাকেন শঙ্কিত।
এত লাশ, এত ধ্বংস, এত মৃত্যুর বেদনায়
এত কান্না, এত আহাজারি, এত বিলাপের বিহ্বলতায়
কী করে যে লেখি স্বজনের শোকগাথা
এই শোকের মধ্যেও কবি বলে ওঠেন ‘শব্দের সীমান্ত নেই/শব্দও ছাড়িয়ে যায় বোধের পরিধি।/শব্দের ডানা আছে।/অলীক পাখনায় দিয়ে ভর/উড়ে যায় নক্ষত্রলোকে।/মানুষের স্বপ্নের সাম্রাজ্য ছেড়ে আরো দূর কল্পলোকে।/যেখানে শব্দের প্রতিপক্ষে পাণ্ডিত্যের কূটতর্ক, অভিধান নেই। শব্দ সংশয়মুক্ত/একক, আত্মগত, শুদ্ধ, স্বগত।’ আর ‘মানুষের চিত্ত ছাড়া শব্দের আর কোনো আশ্রয় নেই। ফলে কবিকে মানব চিত্তের জাগরণ, বিকাশ ও উন্মুক্তকরণের জন্যই লিখতে হয় কাব্যকলা। কবি মুকুল চৌধুরীও সেই পথেরই পথিক। ২২ আগস্ট কবির ৬৪তম জন্মদিন। তাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তার কাব্যযাত্রা অমর হোক।


আরো সংবাদ



premium cement