২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শাস্তি

-

দরজা খুলতেইÑ আমির তার হাতের ব্যাগটি রুহির হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, মা ফোন করেছিল? ফোন পাওয়ার কথা মাথা নেড়ে স্বীকার করে রুমের গভীরের দিকে পা বাড়াল রুহি। জুতা-মোজা খুলেÑ দরজাটি লাগিয়ে আমির রুমে এসে দেখল, রুহি শশা কাটছে। তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসেও আমির দেখলÑ রুহির মুখটি তেমনি ভার। আমির ফিরেছে, এখন তার সামনে খাবার পরিবেশন ছাড়া যেন আর কোন দায় নেই তার। আমির কিছুই বুঝতে পারছে না। সে রুহিকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
Ñকী হয়েছে ম্যাডাম, মুড অফ কেন? কোনো রকম ভান চলবে না আজ। রোজ রোজ কোনো না কোনো অজুহাত! আজকে আর কোনো তালবাহানা চলবে না। এসব ঢং ছাড়েন!
এ কথাগুলো বলতে বলতে আমির তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চাইল। কিন্তু রুহি এক ঝাটকায় খুলে দিলো আমিরের হাতের জোড়া। এখনো সে তার মুখ এঁটে রেখেছে শামুকের মতোন। ফ্লোর থেকে খাটের ওপরে উঠে বসল আমির। তারপর মোবাইলটি হাতে নিয়ে সে এলোপাতাড়ি চলতে লাগল নেট দুনিয়ার এপাড়ায়- সেপাড়ায়। আর রুহি তরকারির কড়াই হাতে গেল রান্নাঘরের দিকে। তরকারি গরম না হলেÑ আমির খেতে চায় না। রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে রুহি দেখল, মুখভারের রোগটি এরই মধ্যে আমিরকেও আক্রান্ত করেছে। খাটের ওপর আড়াআড়ি শুয়ে আছে আমিরÑ দেয়ালের দিকে ঘুরে।
রুহি বলল,
Ñআসো খেয়ে নাও। তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
আমির বলল,
Ñকী হয়েছে?
তার এবারের প্রশ্নটির ওজন ও গভীরত্ব দুই-ই বেশি।
রুহি শুধু বলল,
Ñআগে খেয়ে নাও। কিছুই হয়নি। এমনি আমাকে ভালো লাগছে না। জোরে নেমে আসো। রাত হয়েছে।
রুহি যা বলছে, এইটা যে আসল ব্যাপার নয়। এতখানি আমির বুঝতে পারছে। তবে এ মুহূর্তে আসল ব্যাপারটির সন্ধান পেতে হলে খেতে বসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। তাছাড়া তার ক্ষুধাও লেগেছে প্রচণ্ড। আজ ফিরতেও দেরি হয়ে গেছে। বাসাতে ঢোকার সময়ই সে দেখেছিল, বারোটা দশ। রাত এগারোটার আগে কোনোদিনই সে মার্কেট থেকে ফিরতে পারে না। ফার্মেসিতে বসা গ্রাম্য ডাক্তারগুলোর পরিবারিক-সামাজিক সব ধরনের অর্জনের গল্প শুনতে হয়। তারপর তাদের কাছে ওষুধের অর্ডারের কথা তোলা চলে। এভাবেই রোজ তার আরো দেরি হয়ে যায়। এক থালা ভাত যেন এক ঢোকপানির সাথে গিলে খেলো আমির। পাশাপাশি বসে রুহিও খেলো। এ সময়ে কারো মুখেই কোনো কথা ফুটল না। অথচ প্রতি রাতে খেতে বসেÑ এ বাসার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে, বাজারের টার্গেটের ব্যাপারে, আমিরের বস সম্পর্কে, জীবন-যৌবন-রাজনীতি, দেশ সম্পর্কে-বিদেশ সম্পর্কে কত কথা হয় দু’জনের মধ্যে তার হিসাব হয়তো গুগলের কাছেও নেই। থালা-বাসন সব কিছু সামলে রেখে রুহি বিছানাতে এলো। অন্য দিকে ঘুরে ছিল আমিরÑ পাশ ফিরে সে আবারো জিজ্ঞেস করল
Ñকী হয়েছে তোমার?
Ñকিছু না, মা বলছিল আমরা কবে যাব। তুমি কী বললে? কী আবারÑ বলেছি, তুমি এলে জানাব। আমার তো যা অবস্থা। বৃহস্পতিবার রাতে আমি যাব। তুমি আগেই চলে যাও। প্রয়োজনে আগামী পরশু ভোরের গাড়িতেই তুমি চলে যাও, সন্ধ্যায় হতে হতে পৌঁছে যাবে। শুক্রবার আছে, আমি তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসব। কিন্তু তার আগে, এখন এদিকে আসো! কমপক্ষে তো পনেরো দিন আপনাকে আর কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। আমিরের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেÑ বিছানাতে উঠে বসল রুহি। গলাতে ভর দিয়ে সে বলল
Ñনা, আমি যাব না। আমিরও উঠে বসল,
Ñধুর! তাই বললে হয়। জান্নাত আমার একটা মাত্র বোন। বাড়িতে মা-বাবা ছাড়া আর কে আছে? বিয়ের এত কাজ-এত ঝামেলা মা একা কিভাবে সামলাবে? তুমি আমার সাথে যেতে চাইলে হয়? বিষয়টা তুমি বোঝার চেষ্টা করো। মা আমাকেও ফোন করেছিল। মাও বলছিল, তোমাকে কালকেই পাঠিয়ে দিতে। শুধু আমার চিন্তা করলে আপনার চলবে গিন্নি? সবকিছু তো আপনাকে সামলাতে হবে। এই সাতটা-আটটা দিনÑ আমি তরকারি গরম করে খেয়ে নিবো। তুমি খালি এক কাজ করো, ফ্রিজে মাছ আর মুরগি যা আছে রান্না করে রেখে যাও, তাহলে-ই হবেন। রুহি গলা চেড়ে বললÑ না, আমি আগে না, তোমার সাথেও যাব না। আর কোনো দিন আমি তোমাদের বাড়িতে যাব না। উঠতে-বসতে, তোমার মায়ের ওই খোঁচা মারা কথা আমি আর শুনতে পারব না। আর বিয়ে বাড়ি মানে তোÑ তোমার খালা-মামীরা সবাই আসবেÑ তারা, পাড়ার সব মেয়েরা ছি-বলা করে ধরবে আমাকে। কেউ কানে কানে, আবার কেউ সবার সামনে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করবেÑ কী গো তোমারে ছেলেপেলের কী হলো? আমি কতজনকে বলব। আর কাকে কী বলব আমি? তোমরা সেদিন মেডিক্যালে শুধু তাকে খুন করোনি। আমাকেও খুন করেছÑ তোমরা আমাকেও খুন করেছ। আমারও মা হওয়ার শক্তি আল্লাহ দিয়েছিল। তুমি জানো না আমিরÑ এ কথা তুমি জানো না? তোমার মা, তোমার খালারা এ কথা জানে না? পাপ...! পাপÑ মনে সেদিন তুমি আমার কাছে এসেছিলে আমির বলো। তোমার মনে কী সেদিন রাতে পাপ ছিল? আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে কোনো পাপ ছিল না। আমি সেদিন কোনো ভুল করিনি। কিন্তু সেদিন আমি তোমাকে বারবার থামাতে চেয়েছি, বলো চাইনি। কিন্তু তুমি...! কী মরদ তুমি? সেই দিন রাতে তো অনেক বড় বড় কথা বলছিলে। দুনিয়া উল্টে দেয়ার সাহস দেখালে তুমিÑ কিন্তু তারপর... তুমি জানো আমির, মনে মনে আমি তোমাকে আর তোমার বাবাকে কতটা ঘৃণা করি। আমার এ ঠোঁটেÑ তুমি অমৃতরস খোঁজ, আমার এই বুকের মাঝে তুমি স্বর্গের স্বাদ খুঁজে পাও, বার বার তুমি আমার এই বুকে মুখ মরতে চাও কিন্তু আমির আমার নিঃশ্বাসে যেই বিষ তোমাকে পোড়াতে চায় রোজÑ তা তুমি বুঝতে পার না? কেন পার...? বাংলার ছাত্র তুমি, তুমি কিচ্ছু না আমির, তুমি কিচ্ছু না। বাঘের মতোন শুধু মাংসের গন্ধ ছাড়া আর কিছু-ই তোমাকে স্পর্শ করে না। তোমার বাবার দোষ নেই! তিনি তার কথা বলেছেন, তার কাজ করেছেন। কিন্তু তুমিÑ তুমি তোমার কথা রাখতে পারনি। তুমি খুনি আমির, তুমি আমার সন্তানকে খুন করেছ, তুমি আমাকেও খুন করেছ, তুমি আর তোমাদের কারণে আজ আমি মা হতে পারছি না। আর উল্টো শাস্তিও পেতে হচ্ছে আমাকেই।
বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়াল রুহি। যেন দাবানল ছুটে যাচ্ছে এখন তার দু’গালে। বছরের পর বছর যেই দাবানল কেবলি তার বুকটা পুড়িয়েছে। কয়েক মিনিট পর আমিরও অপরাধীর মতো বেলকুনিতে এলো। পুব দিকের এই বেলকুনির লাগোয়া আর কোনো বাসা নেই। এ পাশে লম্বা একটা জলাভূমিÑ সারা বছর এখানে জলের ঢেউয়েরা থইথই খেলা করে। আর শীত শেষে সরষের হলুদ ফুলে ফুলে ভরে উঠে এ জলাভূমির কালো শরীর। আজ এ জলাভূমির মতো ওই আকাশের বুকও আলোতে ঝলঝল করছে। চাঁদ আর সব তারাগুলো যেন একসাথে জ্বলে উঠেছে আজ।
নারদ নদ পুনঃখননের কাজ চলছিল তখন। সেদিনও এমনি জোস্নাতে ভেসে যাচ্ছিল আকাশ-মাটি সব। নারদ নদের দুই পাড়ে তাদের দু’জনের বাড়ি। কলেজের পরওÑ চাইলে দু’জনের দেখা করতে তেমন কোনো অসুবিধা হতো না। এ কথা-সে কথাতে, এ কারণে- সে কারণে রুহি চাইলেই বাড়ির বাইরে আসতে পারত। দেখা হতোÑ তাদের দু’জনের। সেই রাতে জোস্নার জোয়ার দেখে রুহি কিছুতেই বাইরে আসতে চায়নি। কিন্তু আমিরের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানে রুহি। চার দিকের কাঁচামাটির ঘ্রাণ যেন সেদিন তাদেরও বেসামাল করে তুলেছিল। পরের দিন সকালে-ই মুন লাইট থেকে আমির ওষুধ এনে দিয়েছিল। নিশ্চিত ছিল রুহি। কিন্তু তারপরও কোথায় থেকে কী হয়ে গেল... খোদা জানে!
এমনিতেও বিয়েতে রুহির পরিবারের তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। তারপরও আবার এমন একটা অঘটন। আর কার কী বলার থাকে? তবে আপত্তি ছিলÑ আমির বাবার! সে কোনোভাবেই এ বিয়েতে মত দেবেন না বলে মাড়ি এঁটে বসেন। পরে সব বুঝে, তিনি বিয়েতে মত দিতে এক রকম বাধ্য হোন। ঘোল বছর ধরে, সে ওই চর শ্যামপুর গ্রামের জুমা মসজিদের ইমাম। সাথে ওখানকার হাইস্কুলের মৌলভি স্যার। বিষয়টি কোনোভাবে জানাজানি হয়ে গেলে, তার মান-সম্মান বলে কিছুই আর থাকে না। কিন্তু তার দাবি ছিলÑ রুহির পেটের পাপের ফসলকে নষ্ট করে দিতে হবে। এবং তাও অতি গোপনে। তারপর দু’জনকে তওবা করতে হবে। তারপর বিয়ে। আমিরের বাবার সব শর্ত সেদিন সবাই মেনে নিয়েছিল। রুহি কিন্তু কিছুতেই এতে রাজি হচ্ছিল না। তার কথা, আমি আর আমির চাকরি নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। অনেক দিন আর এদিকে আসব না। আর কে এসবের হিসাব করে রাখবে? আমিরের বাবার দাবিÑ কত দূরে, আল্লাহর আসমান-জমিনের বাইরে? তাদের আমার সামনে এসে তওবা করতে হবে, আমিও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। রুহির পরিবারও গ্রামের অন্যদের মতোন আমিরের বাবাকে সম্মান করে। তিনি আল্লাওয়ালা মানুষ। তাই তাদের কাছে রুহি কোনো কথা-ই বলতে পারেনি। বরং তার পরিবারও তখন মনে করছিল, আমিরের বাবা যা করছেনÑ তা ঠিক-ই করছেন। ইহকাল ও পরকালÑ দুই জীবনের জন্যেই তা কল্যাণের। আর বাচ্চাকাচ্চা আর কী এমন ব্যাপার! আমিরও তখন রুহির কোনো কথা শোনেনি। সে বলেছিল
Ñএ রকম ঘটনা মেডিক্যালে অহরহ ঘটছে, প্রতিদিন। তোমার কোনো ভয় নেই! তারপরও একটা চাকরি-বাকরি ছাড়া সন্তান মানুষ করব কী করে হু?
গত মাসে ওদের বিয়ের সাত বছর পার হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র বছরখানেক ওরা গ্রামে ছিল। ওষুধ কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে আমিরের জানাশোনা ডাক্তারের সংখ্যাও কম নয়। বড় বড় ডাক্তারের ওপর থেকে তাদের ভরসা উঠে গিয়েছে। তাদের গ্রামে গাজী-কালুর মাজার। সেখানকার খাদেমের দোয়াও তারা নিয়েছে। নিয়ম মেনে চলছে হোমিও ওষুধ। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement