২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
আবদুল মান্নান সৈয়দের অগ্রন্থিত লেখা

গীতলতা যার কবিতার কেন্দ্রচারিত্র

-

তুমি বধূ অবিবাহের- কবি হাসান হাফিজের এরকম একটি কবিতাগ্রন্থের নাম দেখে চমকে গিয়েছিলাম একদিন। কবিতা তথা শিল্প, প্রথমত, এমনকি শেষত, কি নয় একটি আশ্চর্য বিদ্যুচ্চমক? ঝোড়ো আকাশে নয়, নীলাকাশে বিদ্যুতের এমুড়ো-ওমুড়ো ছুটে যাওয়াই কবিতা। সেই বিদ্যুৎ দেখে আমরা চমকে যাই, ভিতরে কেঁপে উঠি। হাসান হাফিজের কবিতাগ্রন্থের এরকম নাম দেখে বুঝেছিলাম, সত্তরের দশকের এই কবির ভিতরে অগ্নি আছে।
আমি অনেক সময় লিখেছি-বলেছি, সত্তর দশকে আমাদের প্রধান শিল্পমাধ্যমই ছিল কবিতা। এমনিতে কবিতা আমাদের উজ্জ্বলতম শিল্পপ্রবাহ। তার মধ্যেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের একই সঙ্গে সূর্যোজ্জ্বল এবং টালমাটাল দিনগুলিতে যে-সব কিশোর বেড়ে উঠেছেন, তাঁরা সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছেন বিংশ শতাব্দীর পূর্ব ও পূর্ববর্তী সব ক’টি দশককে। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পরে ঢাকায় চল্লিশের (যাঁদের হাতে আমাদের প্রথম আধুনিক কবিতা প্রণীত হয়) এবং ক্রমশ পঞ্চাশের কবিরা একত্রিত হয়ে এদেশের কবিতার একটি পাটাতন তৈরি করেন। ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন এই কবিতাকে গতি এবং দ্রুতি দ্যায়- আর একই সঙ্গে একটি নিঃশব্দ দিকনির্দেশনা। কবিতা কোন্ দিকে যাবে, যেতে পারে? অবশ্য এ কথাও এখানে বলা দরকার, কবিতা এরকম কোনো নির্দেশনা মানেও না। তবু একটি মৌচাক জমে ওঠে, যা পশ্চিম বাংলার কবিতা থেকে আমাদের কবিতাকে আলাদা করে দিতে থাকে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে আরও সরে যায় ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতার পরে। সত্তরের দশকের নতুন কবিদের হাতেই এই নতুন কবিতা মূলত বাণীরূপ পায়।
সত্তরের দশকের এই নতুন কবিদের বিশেষত্ব দিনে দিনে ফুটে উঠেছে- দশক পেরিয়েও গেছেন কেউ কেউ। এঁদের দু’দিকের দুই প্রতিনিধি যদি হন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আর আবিদ আজাদ, তাহলে অন্য একদিকের প্রতিভূ হাসান হাফিজ। রাজনীতিমন্থন, সমাজপরিবর্তন এঁদের অনেককেই ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় নিয়ে গেছে। জীবনযাপনেও কারো কারো উপরে সময়ের অস্থিরতার ছাপ পড়েছিল। কবিতায়ও। তাই বলে তাঁদের কবিতায় যে তাঁদের নিজস্ব টিপছাপ পড়েনি তা নয়, বরং সম্পূর্ণ নতুন একটি চিহ্ন ধারণ করেছে সাবদার সিদ্দিকী বা ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতা। অনেকেরই আগুন নিভে গেছে বা ধিকিধিকি জ্বলছে। এঁদের ভিতরে হাসান হাফিজ তাবৎ জলঝড়ের ভিতরে মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন। সম্ভবত তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে তিনিই অবিরল কবিতা লিখে গেছেন, এবং সম্ভবত তাঁর কবিতাগ্রন্থের সংখ্যাই তাঁর কালের কবিদের মধ্যে সর্বাধিক। এই অবিশ্রাম সৃষ্টিশীলতাকে আমি মূল্যহীন মনে করি না।
হাসান হাফিজ ব্যক্তিমানুষটির মধ্যে যেমন একটি স্পষ্টতা-সচলতা-সাবলীলতা-অজটিলতা আছে, তাঁর কবিতায়ও স্বাভাবিকভাবে ছাপ পড়েছে তার। তাঁর দীর্ঘকালের সাংবাদিকী অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতাকেও ঋদ্ধ করেছে, বহুচারী করেছে- যেমন হয়েছিল শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রে। ‘একটি শব্দকে আমি ভালোবেসে নিঃস্ব হতে হতে/ এ পর্যন্ত পর্যটন সম্পন্ন করেছি।’ -একটি কবিতায় একদিন লিখেছিলেন হাসান হাফিজ। সেই শব্দের সন্ধানে হাসান হাফিজের এই দীঘল সফর। বলা বাহুল্য, কবিতা আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়। কিন্তু তথ্যের ও অভিজ্ঞতার বিস্তারে ধনাঢ্য হয়েছেন কবি, তাঁর কবিতার নেপথ্যে তার একটি শ্যামায়মান ভূমিকা আছে। সংবাদ মূলত কাব্য- বিষ্ণু দে তাঁর একটি কবিতাগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সংবাদ তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন তা কবির কেন্দ্রকোরকের মধ্য দিয়ে জারিত হয়ে আসে।
শেষ অবদি সাংবাদিক হাসান হাফিজ আর কবি হাসান হাফিজের আসমান জমিন ফারাক। ফলত হাসান হাফিজ মূলত প্রেমের কবিই। এই প্রেম নারী-পুরুষের প্রেমের অর্থে তো বটেই, বড় অর্থেও। হাসান হাফিজের কবিতা তাই নারীপ্রেম-পুরুষপ্রেমের বেদনা এবং আনন্দ এবং বেদনানন্দ যেমন তুলে এনেছে তেমনি জীবনের-পৃথিবীর-স্বদেশের-সমাজের-রাজনীতির ছায়াছবি তাঁর কবিতার চতুর্দিকে ঘূর্ণমান। তাঁর চমৎকার গদ্যগ্রন্থ বিদেশিনী বধূ-তে যে হাসান হাফিজের উপস্থাপন, কবিতাসমগ্র-এর হাসান হাফিজ তা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। শব্দের-ছন্দের-বিষয়ের সৃজনে-নির্মাণে তিনি কবি এখানে, পরিপূর্ণত কবি। স্বাভাবিকভাবেই তিন দশকের অধিক কাল ধরে কবিতা লিখছেন যে কবি, তিনি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ করেছেন- তার উপান্ত কবিতা মরমিয়তাকে স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে আরো দূরে। তবে সর্বাবস্থায় তিনি লিরিক কবি- গীতলতা তাঁর কবিতার কেন্দ্রচারিত্র।
প্রথম অনুচ্ছেদে বলেছি, ‘ঝোড়ো আকাশে নয়, নীলাকাশে বিদ্যুতের এমুড়ো-ওমুড়ো ছুটে যাওয়াই কবিতা।’ অর্থাৎ পরম্পরা। অর্থাৎ ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার মধ্যেই নতুন উন্মেষ। হাসান হাফিজ তাঁর কবিতায় কবিতায় এই নতুন জাগরণ ঘটিয়েছেন। হাসান হাফিজ তাঁর কবিতার পর কবিতায় ‘অনির্ণেয় অন্য কোনও মানে’ খুঁজে চলেছেন। এটাই কবিতার কাজ। কবির কাজ।
[বি.দ্র. লেখাটি কবি হাসান হাফিজের মাধ্যমে পাওয়া]


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা আটক জীবন্ত মানুষকে গণকবর আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিস্কার নামাজ আদায় আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না মিয়ানমারে ফিরল সেনাসহ আশ্রিত ২৮৮ জন বিএনপি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : কাদের

সকল