২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফররুখ আহমদ-এর সঙ্গীত জগৎ

-

ফররুখ আহমদের বহুমুখী প্রতিভা সর্বত্র সুবিদিত। তিনি কবিতা, কাব্য-নাটক, ছড়া, কিশোর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ব্যঙ্গ ও সনেট রচনা করেছেন। আধুনিক তথা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াব্দে মহাকাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ পুঁথি সাহিত্যকে ‘বটতলার সাহিত্য’ বলে ছুড়ে ফেলা হলে তিনি সে সাহিত্যকে আধুনিক রূপ দিয়ে অনন্য ও মৌলিক সাহিত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অনুবাদ সাহিত্যেও তিনি ছিলেন অন্যতম।
কিন্তু কিছু পাঠকের সঙ্কীর্ণতার কারণে তাকে ‘মুসলিম রেনেসাঁসের কবি’ বলে আখ্যায়িত করে তার সৃষ্ট কর্মের প্রকৃত রূপকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং তাকে গোষ্ঠীবদ্ধ লেখক বানিয়ে ফেলেছে। অথচ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন মৌলিক কবি আছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে সঙ্গীত স্্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীনের মতই ভিন্ন মেজাজে ও সুরে তিনি মানব হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন আপন মহিমায়।
কোলকাতা থেকে তিনি সঙ্গীতে নতুন ধারা সৃষ্টি শুরু করেন আহমদ আবদুল্লাহ ছদ্মনামে ‘কথা’ শীর্ষক মাসিক মোহাম্মদীর আষাঢ় ১৩৫২ সংখ্যায়। এরপর থেকে নিয়মিতই সৃষ্টি করেছেন নানা মেজাজের ও সমাজ বিনির্মাণের গান। যে গানে দেশপ্রেম, আধুনিক, জাগরণী, হামদ, নাত, নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন ও মানব হৃদয়ের জয়গান ছিল মুখ্য। কখনো সাম্প্রদায়িকতা বা একপেশে শব্দমালা তার সঙ্গীতে ঠাঁই পায়নি।
তার জীবদ্দশায় সঙ্গীত সৃষ্টির কোনো সমগ্র বা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়নি। ১৯৮৮ সালে প্রথম ‘মাহফিল’ শীর্ষক একটি সঙ্কলন বের হয়। সে প্রকাশনার মধ্য দিয়ে গানের সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে কিছুটা বিকৃতি ঘটে। উল্লেখ্য কেউ কেউ দাবি করেন, ‘দেশভাগের পর এ অঞ্চলের সঙ্গীত ক্ষেত্রে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। বেতারে তখন গভীর শূন্যতা- গীতিকার নেই, সুরকার নেই, নেই তেমন সঙ্গীতশিল্পী। ফররুখ আহমদ সেই শূন্যতা পূরণে আত্মনিয়োগ করেন।’ এ বক্তব্যটি ঠিক ধরলে ফররুখ প্রতিভার প্রতি কিছু অবিচার করা হয়। মূলত তিনি কবিতার মাধ্যমে যেভাবে নিজের মনের প্রতিচ্ছবি আঁকতেন সেভাবে গানের মাধ্যমেও করতেন। অন্যথায় ‘কথা’ নামক সঙ্গীত সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল না।
তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে তার সঙ্গীতে নিজের বিশ্বাস ও নিশান ফুটে উঠেছে বজ্র আঁটুনি কণ্ঠে। যেমন খোদার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ‘সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ-রাব্বুল আলামীন/তুমি রহমান, রহীম তোমার রহমত শেষহীন॥’ তার ঈমানের পরিচয় আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ‘তোরা চাস্নে কিছু কারো কাছে/ খোদার মদদ্ ছাড়া,/ তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে/ নিজের পায়ে দাঁড়া’ গানে।
অথবা তিনি যখন রাসূল (সা.)-এর প্রশংসা করে বলেন, ‘ওগো নূরনবী হযরত/আমরা তোমরি উম্মত/তুমি দয়াল নবী, তুমি নূরের রবি, তুমি বাসলে ভাল জগত জনে/ দেখিলে দিলে পথ।’ তখন তার পরিচয় ফুঠে উঠে। তিনি সংশয়বাদী ছিলেন না। তিনি অল্পজ্ঞানীও ছিলেন না। ফলে তিনি ইসলামের সে বিশ্বাস বা আদর্শ ধারণ করে কাউকে কখনো আঘাত করে কোনো কিছু সৃষ্টি করেননি। তিনি যেখানে যা কিছু সত্য পেয়েছেন তা গ্রহণ করেছেন। তার ‘হাতেম তাঈ’ একটি অনন্য ও বিরল উদাহরণ।
তার সঙ্গীতের বিষয়বস্তু ও সুর-তাল-লয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে কথাগুলো প্রায়ই অনুচ্চারিত থাকে তা হলো- তার দেশাত্মবোধ। এ দেশাত্মবোধের মূল অনুপ্রেরণার জায়গা ছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবিভক্ত বাংলায় স্বতন্ত্র্য বাংলাদেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। তার জন্মের পূর্বে বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের প্রভাব এবং এর প্রেক্ষিতে বাল্য বয়সে বাঙালি মুসলমানদের উপর নিষ্পেষণ ও ত্রিশের দশকে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের প্রেক্ষিতে যে অনিশ্চয়তা চলছিল তা মনের গহিনে রক্তক্ষরণ করেছিল। ফলে তিনি দেশের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি সংরক্ষণে কাজ করেছেন। সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানিরা যেভাবে বাংলা ভাষার প্রতি আঘাত হেনেছিল তা তিনি প্রতিবাদ করেছেন নানাভাবে। ফররুখ আহমদ মাতৃভাষাকে নিয়ে যে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন, তা ভাষাবিষয়ক যেকোনো গানের ছেয়ে শ্রেষ্ঠ। তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা/ খোদার সেরা দান/ বিশ্বভাষার সভাই তোমার/রূপ যে অনির্বাণ।’ এখানে লক্ষণীয় তিনি দু’টি বিষয় উপস্থান করেছেন।
এক, তিনি মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। দুই, পৃথিবীর সকল ভাষার আলাদা স্বরূপ তুলে এনেছেন। মজার বিষয় ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষণার মাধ্যমে সকল ভাষাকে সম মর্যাদা দেয়ার আহ্বান করেছে। অথচ এ বিষয়টি ফররুখ আহমদ অনেক আগেই উল্লেখ করেছেন।
দেশাত্ববোধক গান সৃষ্টিতেও তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি দেশের কথা তুলে ধরেন এভাবে, ‘সকল দেশের চেয়ে সেরা আমার দেশের মাটি,/ মায়ের কোল ছেড়ে মাটি-মায়ের কোলে হাঁটি॥/ এই মাটিতে চলি ফিরি এই মাটিতে বসি/ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই মাটিরে চষি,/এই মাটিতে দেখিরে ভাই সোনার শীতল পাটি॥’ এ দেশ গঠনে খোদার সহযোগিতা প্রয়োজন তাও তিনি বলতে কখনো ভুলেননি। একটি গানে বলেন, ‘দাও আমাদের পূর্ণ ঈমান মহান শিক্ষা তৌহিদের/গড়ব আবার ভ্রাতৃসমাজ বিশাল বক্ষে এ বিশ্বের।/ দেশ কাল, প্রথা, আঞ্চলিকতা/হবে হারানো অতীতের কথা/ বর্ণ গোত্র হবে একাকার ভ্রাতৃসমাজের মহা প্রেমের।।’ ঠিক তেমনি অন্য একটি গানেও তিনি একইভাবে বলেন, ‘নিষ্প্রাণ এই জাতিকে আবার হে মাবুদ, প্রাণবন্ত করো/মুমিনের এই নব জাগরণে সব জড়তার অন্ত করো।/গাফিল প্রাণের গাফলতি প্রভু যত শিথিলতা চূর্ণ করো/দুর্বল ভীরু ঈমানদারের বক্ষ ঈমানে পূর্ণ করো।’ এভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তার গানে যে আবেদন বা দর্শন প্রকাশ পেয়েছে তার ওপর ভিত্তি করেই মূলত পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং বাহাত্তরের সংবিধানে যে চারটি মূলতন্ত্র ঠিক করা হয়েছে তাও ফররুখ আহমদেরএসব গানে প্রকাশ পেয়েছে। কেবল মাত্র সময়ের প্রেক্ষাপটে বিকৃতির কারণে ফররুখ আহমদের মূল বক্তব্যকে যেমন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে তেমনি সংবিধানের মূলতন্ত্রেরও ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করা হয়।
আবার ফররুখের জাগরণী গানের ভাষা ও আবেদন কোন কোন ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সমকক্ষ। তার ‘সামনে চল্ ... সামনে চল্ তৌহিদেরি সান্ত্রীদল/সামনে চল্ ... সামনে চল্ ॥/ আসুক ডর, আসুক ভয়,/ আসুক হিম দুঃসময়/আসুক দুখ্ পাষাণ বুক/মৃত্যু বাধা, ঝড় বাদল/সামনে চল্ ... সামনে চল্॥’ গানটি সব দিক থেকেই একটি উচচাংগ ভাব বহন করে।
সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি গণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছেন। তাই গণ মানুষের গান রচনা করেছেন একের পর এক। যেমন নদীর গান, পাহাড়ের গান, পূর্ণিমা চাঁদের গান, সমুদ্রের গান, চাঁদের গান, মুসাফিরের গান, পরীর গান, কবির গান, গোলাবের গান’সহ অসংখ্য গান। সুতরাং সঙ্গীত ¯্রষ্টার বিবেচনায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের আবেদন তিনি পরিপূর্ণভাবে চিত্রায়িত করেছেন। ফলে তাকে বিশেষ অভিধায় অভিহিত করে অবিচার করা কারো সমীচীন নয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement
যদি বন্ধু হও, সীমান্তে অহরহ গুলি কেন : ভারতকে ফারুক সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে ২ ভাইকে হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ শ্রীলঙ্কাভিত্তিক এয়ারলাইন্স ফিটসএয়ারের ঢাকা-কলম্বো সরাসরি ফ্লাইট চালু রোহিঙ্গা ইস্যুতে একসাথে কাজ করবে ঢাকা-ব্যাংকক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইলি হামলায় আহত শিশুর মুখে ২০০ সেলাই বিষখালীতে মৎস্য বিভাগের অভিযান : জেলে নিখোঁজ, আহত ২ দক্ষিণ এশিয়ার যে শহরগুলোর তাপমাত্রা এখন সর্বোচ্চ গাজীপুরে দাঁড়িয়ে থাকা কাভার্ডভ্যানে অটোরিকশার ধাক্কায় হতাহত ৫ চৌগাছায় সিদ কেটে স্বর্ণের দোকানে চুরি দুর্নীতির মামলায় কৃষিমন্ত্রীকে আটক করল ইউক্রেন

সকল