২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
যে ক থা হ য় নি ব লা

সাফল্য ও ব্যর্থতার দোলাচলেই জীবন

আতা সরকার; কথাশিল্পী
-

লেখক না হয়ে আর কি হতে চেয়েছেন?
লেখক কি হতে চেয়েছি? লেখক কি হয়েছি? বর্ণপাঠ নেয়ার পর রবীন্দ্র-নজরুল পাঠ নিজেকে তাড়িত করে নিজে থেকেই। সেটা আমার ভেতরকার বোধ। তাই লেখালেখির সাথে জড়িয়ে আছি এই বোধ থেকেই। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক এবং জাগতিক জীবনের মাঝে কোনটি বেশি উপভোগ করেন?
লেখক জীবন যে জাগতিক জীবনের বাইরে, তা তো জানতাম না। যদি আলাদাও ধরে নিই, দুই জীবনের উপভোগের তুলনা করি কিভাবে? পোলাও কোরমা আর শুটকি ভর্তা পান্তা ভাতের দুটোর স্বাদই তো আলাদা আলাদা। উপভোগ দুই জীবনেরই, যাতনাও। একইরকম।
কী প্রতিবন্ধকতা জয় করে লেখক হলেন?
লেখক হয়েছি কি? লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিতেই তো পারিনি। ছোটকাল থেকেই কানের কাছে অহর্নিশ বাণী: তোমাকে এসডিও হতে হবে (তখনকার মহকুমা শহরে এসডিওই সর্বেসর্বা। আর তারা বাংলো থেকে ভোরবেলা ফুল চুরি করে খুব আমোদ পেতাম), ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। আর আমার ইচ্ছে করত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা কবি হতে। কবি তো হওয়া হয়ই নাই, আর লেখকের এই দশা।
আবার এমন অবস্থা: গলা খুলে কথা বলা যাবে না। মন খুলে কলমের কালি খরচ করা যাবে না। ঝুট-ঝামেলায় তো কম পড়তে হয়নি। সেই ছোটকাল থেকে। ক্লাস এইটে পড়া কালে ১৯৬৬ সালে জামালপুর শহর থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করলাম আমারই সম্পাদনায়। পুলিশ এসে সব কপি নিয়ে নিল। ময়মনসিংহ এসে হাজিরা দিতে হলো ডিসি অফিসে। সেটা তো পরশাসনের কালে। স্বাধীন দেশেও কি কম ঝামেলা! আমারই গল্প ছেপে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে যেতে হলো হাজতে। ম্যাগাজিনের সব কপি বাজেয়াপ্ত। গোয়েন্দাদের মুখোমুখি বসতে হযেছে আরো দুই লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে। তাই এখন নিজেই নিজেকে সেন্সরে রাখা ছাড়া আর উপায় কি! লেখক হওয়া আর হলো কই!
লেখক জীবন ও ব্যক্তি জীবনের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
আমার লেখক জীবন তো ব্যক্তি জীবনেরই অন্তর্গত। কোনো তফাৎ খুঁজে পাই না।
খ্যাতির তৃষ্ণার পেছনে একজন লেখক কেন ছোটেন?
ছোটেন কি? লেখক তো লেখার পিছনে ছুটেই দিশকুল পান না। তবে লেখকের একটা প্রত্যাশা থাকে। তার লেখাটা কেউ পড়ুক। লেখায় আনন্দ থাকতে পারে, লেখক সে আনন্দ পাঠকদের সাথেই ভাগ করে নিতে চায়, এর মাঝেই তো লেখার সার্থকতা। তাই লেখক চান, তাঁর লেখা অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছুক। খ্যাতিটা সেখান থেকেই আসতে পারে। লেখক খ্যাতির জন্য লেখেন না। লেখার পর খ্যাতির তৃষ্ণা পাঠকের কাছে পৌঁছারই আকুলতা।
সমাজের প্রতি একজন লেখকের কোন দায় আছে কি?
লেখক কি সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ? সমাজের প্রতি একজন মানুষের যে দায়, লেখক মানুষ হিসেবে সে দায় এড়াবে কি করে? লেখক যে কাজে নিয়োজিত, সেই লেখালেখির মাধ্যমে তাকে সামাজিক দায় সাধনে যুক্ত থাকতেই হয়- সচেতন ভাবে অথবা না জেনে-বুঝেই। লেখাই তার সামাজিক দায়।
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যকে কিভাবে দেখছেন?
এ প্রজন্মের সাহিত্য বিশেষ করে কথাসাহিত্য মনোযোগ দিয়ে পাঠ করার চেষ্টা করি। এখনকার লেখকদের কলম অনেক শক্তিশালী ও শাণিত। তাঁদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অনেক গভীর। এ সম্ভার পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে যথাযথ মর্যাদায়।
নিজেকে নিয়ে প্রিয়জনের কোন অভিযোগ মিষ্টি মনে হয়?
অভিযোগ তো সবসময় টক টকই মনে হয়। কখনো চেখে দেখিনি তো কোন্ কোন্ অভিযোগ মিষ্টি মিষ্টি লাগে!
লেখালেখির পাশাপাশি ব্যক্তি জীবন কতখানি সফল মনে করেন?
লেখালেখি তো ব্যক্তি জীবন থেকে আলাদা নয়, সবই একই জীবনের অন্তর্গত। জীবনের নানা দিক রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন মাত্রা। জীবন তো এখনো বহমান। হিসাবের খেরোখাতা এখনো তো মেলে ধরি নাই। সাফল্য ও ব্যর্থতার যোগ বিয়োগ এখনো মিলানো হয়নি।
জীবনের ব্যর্থতা কি?
জীবনের পুরোটাই কি ব্যর্থতায় ভরা? না, হিসাব মিলাইনি। কখনো কখনো মনে হয়, কিছুই তো করা হলো না। তবু বেঁচে আছি তো এতো কাল ধরে। সাফল্য ও ব্যর্থতার দোলাচলেই তো জীবন।
শিল্পসম্মত রচনা সৃজনের উপায় কি হতে পারে?
আমি বৈয়াকরণিক নই, শাস্ত্রবিদও নই। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের দ্বারস্থ হওয়াই ভালো। ব্যাকরণের দিকে তাকিয়ে সাহিত্য হয় না, বরং ব্যাকরণই সাহিত্যকে অনুসরণ করে। জীবনের চাইতে বড় শিল্প আর নেই। জীবনকেই অনুসরণ করতে হবে।
জীবনের যে অপূর্ণ স্বপ্ন?
স্বপ্ন কি কখনো পূর্ণ হয়? পূর্ণ হলেও হাজির হয়ে যায় হাজারো নতুন স্বপ্ন। স্বপ্ন অফুরান।
কবিতা যেমন উন্নত হতে হবে, কবিকেও হতে হবে উন্নত মানুষ। আমাদের কবিরা কি একথা ভাবেন?
কবিরা তো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সমাজেরই প্রোডাক্ট। কবি-সত্ত্বাই একজন কবির জন্ম দেয়। আর তার উৎসমূল সমাজে। কবিতার ভেতরেই এক মহত্ত্ব বোধ থাকে। কবি নিজে এবং পাঠক কবিতা থেকেই শিক্ষা নিতেই পারেন।
সাহিত্যিক জীবনের শেষ ইচ্ছে কি?
লিখেই যাওয়া।
আপনার সাহিত্য দর্শন কি?
জীবনের গভীরে ঢুকে পূর্ণ মানবিকতার উত্থান।
কোন বই বারবার পড়ার ইচ্ছা এখনো তাড়িত করে?
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। ব্রেখটের গল্পগুলোও।
পাঠকের ভালোবাসা কেমন পান?
তাই তো! কোনো পাঠিকা কোনো লেখা পড়ে ছুটে এসে ফুল দেয়নি তো। কোনো পাঠকও মুগ্ধ হয়ে বাড়ি বয়ে এসে মিষ্টির হাঁড়ি দিয়ে যায়নি! তবু লিখছি কেন? পাঠকের ভালোবাসাই তো তাড়িত করে।
এখনো উজ্জীবিত রাখে যে বাণী।
হও কর্মেতে স্থির।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মেজবাহ মুকুল


আরো সংবাদ



premium cement