১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


মানুষের মর্যাদা ও সৃষ্টিশীলতা

-

পৃথিবীতে যারা জীব শ্রেণীর সদস্য তাদের মধ্যে যারা দৈহিক শক্তিতে শক্তিবান যেমন বাঘের ক্ষিপ্রতা, চিতার দৌরাত্ম্য হায়েনার হিং¯্রতা আর সাপের বিষাক্ততার কাছে মানুষ অত্যন্ত অসহায়। যে মাতৃগর্ভে থেকে অসহায় হয়ে জন্মগ্রহণ করে। মানুষের ভিতর সব রকম পশুত্ব বিদ্যমান। যেমন, ক্ষিপ্রতা, হিং¯্রতা, বিষাক্ততা এবং দানবীয় ধ্বংসাত্মক মনোভাব। এগুলো মানুষের ভিতর বর্তমান। কিন্তু মানুষের পাশবিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আছে উন্নত জ্ঞানের শিক্ষা। যে জ্ঞান আহরণের ফলে হিং¯্রতা ও দানবীয় উন্মত্ততা ধূলির সাথে মিশিয়ে দিয়ে জগৎকে শান্তির লীলাভূমিতে পরিণত করতে পারে। জীবন যেখানে আছে সমস্যা সেখানে আছে। মানব জীবনের সমস্যার শেষ নেই। তার যেমন আছে যান্ত্রিক দিক তেমন আছে আধ্যাত্মিক দিক। মানুষ দুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হয় না। বরং তাকে দুনিয়ার ভিতর পরীক্ষার ভিতর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দুনিয়া হলো মানুষের জন্য পরীক্ষার স্থল। এই পরীক্ষায় যে জয়ী হতে পারবে সে পাবে স্বর্গীয় বারিবর্ষণের সঙ্কেত।
মানুষ হলো মর্যাদাবান প্রাণী। এই প্রাণীর আছে উন্নতমানের মগজ এবং মনীষা। সক্রেটিস, বুদ্ধ, ঈসা আ:, মূসা আ:, মুহম্মদ সা:, শেকসপিয়ার, আইনস্টাইন, নিউটন, কান্ট, সার্ত্রে, রবীন্দ্র, নজরুল প্রমুখ ব্যক্তিকে আমরা শ্রেষ্ঠ বলি কিসের জন্য। যাদের অবদান মানব সভ্যতায় বেশি তারা তত বেশি শ্রদ্ধার পাত্র এবং মর্যাদাবান। মর্যাদাবান হওয়ার জন্য কোটিপতি, সেনাপতি, রাষ্ট্রপতি হওয়ার দরকার নেই। পৃথিবী থেকে বহু সেনাপতি, রাষ্ট্রপতি, কোটিপতি বিদায় নিয়েছেন তাদের কথা কেউ স্মরণ করে না। অথচ তাদের দাপটে দুনিয়া ছিল অন্ধকার। তাদের অনেকের সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলার মতো সাহস ছিল না। তারা খেয়ালখুশি মতো আচরণ করতেন এবং মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবতেন এবং ভোগের আসরে উন্মত্ত থাকতেন। পৃথিবীতে এমন অধিপতির বিদায় হয়ে গেছে তারা মানব সভ্যতার পায়ের নিচেও ন্যূনতম কোনো ঠাঁই করতে পারেননি। মানুষকে দেয়া হয়েছে উন্নত মগজ। যারা এই মগজের কাজ বেশি করতে পেরেছেন তারা হয়েছেন তত স্মরণীয় ও মর্যাদাবান। ব্রিটিশ রাজা-রানীদের দাপটে দুনিয়া ছিল কম্পমান। তারা সভ্যতার গান গাইত এবং পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং সব রকম প্রচারমাধ্যমে ছিল তাদের নখদর্পণে। কিন্তু তারা কি শেকসপিয়ারের মতো মর্যাদাবান হতে পেরেছেন। শেকসপিয়ারকে ব্রিটিশ রাজাদেরও রাজা বলা হয়। (ঝযধশবংঢ়বধৎব রহ পধষষবফ ঞযব করহম ড়ভ ঃযব ঊহমষধহফদং করহম) মানবসভ্যতার গহিন অন্ধকারে আমরা কিছু আলোর তারকা মিট মিট করে জ্বলতে দেখি। তারা তাদের মেধা মনন এবং সৃষ্টি দ্বারা দুনিয়ার বুকে হয়েছেন শ্রদ্ধার পাত্র। মগজের কাজ যে যত বেশি করতে পেরেছে সে তত বিখ্যাত হয়েছেন। তবে বিকৃত মগজের চর্চা করলে তার দ্বারা সভ্যতার উপকার তো হবে না। বরং অপকার হয়। মানুষের কল্যাণের জন্য যারা জীবনটা বিসর্জন দিয়েছে তারা হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠসন্তান। তারা শ্রদ্ধার পাত্র। এই শ্রদ্ধা আসতে হবে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। যদি লোকদেখানো কাজ হয় এবং সেটা যদি মানবজাতির উপকারে না আসে এবং তার দ্বারা যদি মানবচিত্ত বিকশিত ও প্রস্ফুটিত না হয় তাহলে তার দ্বারা শ্রদ্ধেয় কাজ সৃষ্টি হতে পারে না। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক, ধর্মপ্রচারক যারা দুনিয়ায় আছে তাদের মধ্যে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে যাদের কাজ তাদের শ্রদ্ধা সেইভাবে দিতে হবে। কারণ একটা সুন্দর সভ্যতা যদি মানবসৃষ্ট কাজে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় তাহলে সব রকম সৃষ্টি, কৃষ্টি ও ধ্বংস হবে। এই সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য আমরা মহামানবের আগমনের আহ্বান জানাই। কারা এই সুন্দর সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই দিতে পারবে। তারা হবে জাতির আলোকবর্তিকা।
পৃথিবীতে যারা মগজের কাজ যত বেশি করেছেন তারা হয়েছেন শ্রদ্ধার পাত্র। বাংলা ভাষাভাষী জাতির ভিতর রবীন্দ্র, নজরুল সবচেয়ে মগজের কাজ করেছেন তাই তারা সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র। শারীরিক শ্রমের চেয়ে মস্তিষ্কের চর্চার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। মানবেতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রাচীনকালে মানুষ বন্য দশায় জীবন যাপন করত। তারা পাথরের হাতিয়ার তৈরি করে পশু হত্যা করত। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য গুহার ভিতর অবস্থান করত। গুহাবাসী মানুষ স্বপ্ন দেখত পাখির মতো আকাশে উড়তে এবং মাছের মতো সাঁতার কাটতে। মানুষের এই চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে আবিষ্কার হয়েছে চাকা, আগুন ও যন্ত্র। মানুষের কাজে আগে জন্তুর ব্যবহার ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জন্তুর স্থলে এলো যন্ত্র। মানুষ আজ পাখির মতো আকাশে উড়ে আবার মাছের মতো সাঁতার কাটে। মানুষকে দেয়া হয়েছে ঐন্দ্রিয়ের স্বাধীনতা। কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা মানুষের স্বাধীনতাকে বিপর্যয়ে ফেলেছে। প্রাচ্যের এক চিন্তাবিদ বলেছেন যে মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত। তবে যারা জোর-জুলুম করে শৃঙ্খল ভাঙার জন্য মস্তিষ্ক ও পেশিশক্তি ব্যবহার করেছেন তাদের শ্রদ্ধা না নেয়াই ভালো। মানুষ জন্মের পর জাগতিক আলো বাতাসে বেড়ে ওঠে। সৃজনশীল কর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখে।
মানুষকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে না মানুষ স্বচেষ্টায় জ্ঞানী হয়েছেন এ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। এই জ্ঞান দ্বারা জাগতিক মুক্তির কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই মুক্তি হবে সব রকম অশান্তি থেকে মুক্তি। এই মুুক্তি বস্তুবাদী জ্ঞান দ্বারা সম্ভব কি না সেটা ভাববার বিষয়। কারণ বস্তুলোভী সমাজের কারণে জগতে শোরগোল বৃদ্ধি পেয়েছে। জাগতিক চাকচিক্য তার কাছে স্থায়ী এবং সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু হঠাৎ প্রাণপ্রদীপ নিভে নিরাশার অন্ধকার জগতে হাবুডুবু খাওয়া মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। মানুষ নিছক যন্ত্র নয়। যন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য আছে। আমরা জাগতিক রঙিন চশমায় যদি সভ্যতাকে বিচার করি তাহলে অর্থবিত্ত এবং ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেবো এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ তারা ভাবে জাগতিক জীবনই একমাত্র জীবন। তবে অন্য দিকে যদি মানুষের মধ্যে অন্য কোনো শিক্ষা থাকে যা সে পারলৌকিক জীবনে মুক্তি পাবে তাহলে সেটা আয়ত্ত করা বৃদ্ধিমান সত্তার বহিঃপ্রকাশ। এই জ্ঞানে জ্ঞানী যারা তারা জীবনকে অন্যভাবে ভাবেন। এই শিক্ষার কথা যারা প্রচার করেন তারা সভ্যতার অস্তিত্ব এবং ধ্বংসাত্মক চেতনা থেকে বেরিয়ে এসে শান্তির পথ অবলম্বন করেন। তবে আজ বস্তুবাদ এবং আধ্যাত্মবাদের মধ্যে একটা বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সত্য পথের পথিক যারা তারা আজ আর জ্ঞান দ্বারা নিজকে ও জাতিকে জাগাতে পারেন না। তারা নিজেকে অজ্ঞেয়তার ভিতর পড়ে গেছে। যার কারণে সে তামাশার পাত্র হিসেবে নিজকে আবিষ্কার করেছে। অথচ তারা ছিল সভ্য, সত্য উন্নত। তারা যখনই জ্ঞানের কথা বলে তখন তাদের আজ বিশ্ব অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ শ্রেণীর সদস্য ভাবা হচ্ছে। এ থেকে মুক্তির পথ আবিষ্কার করতে হবে। নইলে জগতের স্থায়িত্ব ও অস্তিত্ব বেশি দিন টিকবে না। মানুুষ যদি জগতে শান্তিতে পদচারণা করতে চায় এমনকি সৃষ্টি এবং সভ্যতাকে টিকে থাকতে দিতে চায় তাহলে আমাদের বস্তুবাদের সাথে আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় সাধন করতে হবে। আর এই শিক্ষা যারা প্রচার করবে তারা হবে সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং মর্যাদার অধিকারী।
সত্য সহজ, সরল যেখানে সব সৌন্দর্য ও মুক্তির নিশ্চয়তা মিশে আছে। কিন্তু আজ মানুষ কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা নিয়ে দ্বন্দ্বের ভিতর পড়ে গেছে। জাগতিক রঙিন চশমার জগৎকে দেখলে আংশিক সত্য আবিষ্কার হবে। কিন্তু তার দ্বারা মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হবে না। কারণ বাহ্যিক ও আংশিক সত্য দ্বারা খণ্ডিত মুক্তির সম্ভাবনা থাকতে পারে কিন্তু কালজয়ী সুসামঞ্জস্য ও সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়। আমরা আংশিক ও বাহ্যিক সত্যকে নয় বরং মৌলিক ও শাশ্বত সত্যের সন্ধান চাই যা আমাদের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করবে।
মানুষ যে সমাজেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন সে সমাজের ভাষা সংস্কৃতি তাকে পরাধীন করে ফেলে। আর এই পরাধীনতার ভিতর সে স্বাধীন। খাঁচার ভিতর বন্দী বাঘের চেয়ে মুক্ত স্বাধীন গাধা অনেক ভালো। মানুষকে জ্ঞান প্রদান করে স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে যেকোনো পথ বেছে নেবে এবং সত্য-মিথ্যার বিভ্রান্তির হাত থেকে মুক্ত থাকবে। কারণ বিভ্রান্ত মতাদর্শ মানুষকে সাময়িক মুক্তি দিতে পারলেও চিরস্থায়ী মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়। মানুষকে সৃষ্টি করে ¯্রষ্টা তার পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।। মানুষ সৃষ্টি না করলে তার জগৎ সৃষ্টি ব্যর্থ হয়ে যেত কি না তা নিয়ে চিন্তাশীল সমাজ আন্দোলিত হয়েছে। এই মানুষের মর্যাদা এত ওপরে চলে গেছে যে মানুষের স্থান সৃষ্টি জগতের ভিতর স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে। মানুুষ হয়েছে মর্যাদাবান। সুতরাং তারাই মর্র্যাদাবান যাদের দ্বারা সভ্যতার জঞ্জাল পরিষ্কার করেছে। সত্য পথের দিকনির্দেশনা পেয়েছে ও যারা সৃজনশীল কাজে স্বাক্ষর রেখেছেন এবং মানবতাকে ও মননশীলতাকে পরাজয়ের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। তারা হয়েছেন বিশ্বপ্রেমিক ও বিশ্বজয়ী।


আরো সংবাদ



premium cement