১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয় চিন্ত

-

ইন্দ্রিয়কে বাদ দিয়ে অতীন্দ্রিয়কে ভাবা যায় না। মানুষ সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী। তার যেমন আছে চযুংরপধষ দিক তেমন আছে গবঃধঢ়যুংরপধষ দিক। সার্জনের ছুরি দিয়ে তাদের পৃথক করা যায় না। একটি বস্তুর যেমন আছে উপাদান তেমন আছে আকার। আকার ছাড়া বস্তুর অস্তিত্ব নেই। উদ্দেশ্যহীন বস্তুর সৃষ্টিকর্তা নেই। মানবজ্ঞানের অস্তিত্ব একমাত্র বস্তুর জ্ঞানকে বোঝায়। বস্তুর জ্ঞান ইন্দ্রিয় জগতের জ্ঞান। বস্তু দ্বারা অতীন্দ্রিয় জ্ঞানকে মাপলে চলবে না। সেটা অন্য ধরনের জ্ঞান। তার মাপকাঠি ভিন্ন। আমি আছি বলে বস্তু দেখছি আবার বস্তু আছে বলে আমি দেখছি। আমি নেই কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমি আছি সব কিছুর অস্তিত্ব আছে। সুতরাং আমি কর্তৃক জ্ঞান বস্তুজগতের জ্ঞান। জাগতিক রঙিন চশমার জগতকে ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়। কিছু যারা বিশ্ব প্রহেলিকায় জট খুলেছে তাদের কাছে জগতে ভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। জগতের প্রতি মোহ মানুষকে জটিল ঘোরের ভিতর ফেলে দিছে। তার কাছে জাগতিক ভোগ সুখ ও চাকচিক্য চূড়ান্ত এবং স্থায়ী মনে হয়। কিন্তু যারা চাক্ষুষমান এবং আলো আঁধারীর সন্ধিক্ষণে জগতকে চিনতে ও জানতে পেরেছে তাদের কাছে বিষয়টি ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়। জগতের অস্তিত্ব এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে শুরু হয়েছে। এখনো চলতে আছে এবং ভবিষ্যতে জগত ধ্বংস পর্যন্ত চলতে থাকবে। কারণ এর কোনো মীমাংসা নেই। এটা বস্তু নয় অবস্তু।
মানুষ জগতে আসার পর বিস্ময়বোধ করে এবং এই বিস্ময়বোধ থেকে দর্শনের যাত্রা শুরু হয়। তবে নিজের অস্তিত্ব এবং অধিকার এবং দায়দায়িত্ব মানুষকে গোলক ধাঁধার ভেতর ফেলে দিয়েছে। সে অন্ধকারে হাতড়াতে থাকে। কিছু বস্তুর জ্ঞান আর অবস্তুর জ্ঞান এক নয়। ইন্দ্রিয় জগতের জ্ঞান এত সংক্ষিপ্ত যে, এত সামান্য জ্ঞান নিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাণী চলতে পারে না। তার আছে অতীন্দ্রিয় জ্ঞান যা তাকে পূর্ণতা দিয়েছে। এই পরিপূর্ণ জ্ঞান মানুষের মানবিক জ্ঞান দিয়ে প্রমাণিত হতে পারে না। স্রষ্টা তার আপন মহিমায় শ্রেষ্ঠ জীবের প্রতি সে জ্ঞান দিয়েছেন। জাগতিক এবং মহাজাগতিক যত জ্ঞান আছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান হলো নিজেকে চেনা, নিজেকে জানা। নিজের প্রতি জ্ঞান মানুষ আয়ত্ত করতে পারলেও পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। গ্রিক মহাগুরু সক্রেটিস বলেছেন, ‘শহড়ি ঃযুংবষভ.’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। নিজেকে জানতে গেলে আগে নিজের পরিচয় পাওয়ার দরকার। ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান এবং দর্শন মানুষের পরিচয় দিয়েছে বিভিন্নভাবে। মানুষ যদি প্রকৃতভাবে জগত এবং জীবন নিয়ে চিন্তা করে তাহলে আমাদের স্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ তিনি যদি সৃষ্টি করেন এবং চলার পথকে সহজ করেন, তাহলে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বৃদ্ধিমান সত্তার জ্ঞানের কথাকে প্রকাশ করে।
নিজেকে জানা এমন কঠিন যে আমেরিকা মহাকাশে স্টেশন তৈরি করতে পারবে, সমুদ্রে উথাল পাথাল করে পাড়ি দিতে পারবে এমনকি জীবনকে পর্যন্ত জয় করতে পারবে কিন্তু সক্রেটিসের ‘শহড়ি ঃযুংবষভ’ এর মতো একটি বাক্য তৈরি করতে পারবে না। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এত বেশি যে সে শুধু স্রষ্টাকে চিন্তাই করতে পারে। বাস্তবে প্রত্যক্ষ তার জ্ঞানের সীমানার অতীত। হজরত আলী বলেছেন, ‘যে নিজকে জানতে পেরেছে সে তার স্রষ্টাকে জানতে পেরেছে।’ মানুষের প্রতি স্রষ্টার প্রথম ঐশ্বী বাণীÑ ‘পড়ো তোমায় প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ এখানে নিজের জ্ঞান এবং পরম বুদ্ধিমান সত্তার জ্ঞানের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে এবং নিজেকে জানার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
জ্ঞান মানুষের আত্মা এবং মনকে প্রভাবিত করে। আত্মাকে বিকশিত, প্রস্ফুটিত এবং সংশোধন করার জন্য দরকার আধ্যাত্মিক শিক্ষা। বস্তুবাদের চর্চার মাধ্যমে মানুষের ভেতর শোরগোল বৃদ্ধি পাবে। মানুষ খামাখা রক্তপাতের পথকে বেছে নেবে এটা স্বাভাবিক। মানুষের আছে দুটি সত্তা- একটি দৈহিক ও অন্যটি আত্মিক। পাশবিকতার কারণে সে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ মানুষের ভেতর জাগতিক ও ইন্দ্রিয়ের সুখ ও বিলাসসামগ্রী ও না পাওয়ার হাহাকার এবং মরণি প্রবৃত্তি মানুষকে অমানুষ বানিয়ে দিয়েছে। এই পশু প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দরকার আত্মার পরিশুদ্ধি তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞান। এই জ্ঞান দ্বারা সে যেমন নিজকে জানতে পারে তেমনি সে জাগতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সত্যই সুন্দর সত্যই মুক্তি। আমরা বর্তমানে পাশ্চাত্যের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাবো তারা এখন ইৎবধফ ধহফ নঁঃঃবৎ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু দিয়ে আছন্ন হয়ে পড়েছে। যার প্রয়োগ আছে সেই সত্য আর যার প্রয়োগ নেই সেই মিথ্যা। তারা খামাখা যন্ত্র হিসেবে মানুষকে পরিচয় দিয়েছে। মানুষ যদি নিছক যন্ত্র হবে তাহলে দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মানবতা, সৌন্দর্যচেতনা থাকবে কেন? যন্ত্রের তো এমন কিছু থাকতে পারে না। মানুষের আছে মানবিক দিক। যার দ্বারা সে পতিত জনতার মুক্তির জন্য পাগল হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মানুষ যখন নি¤œ শ্রেণীর মানবিকতার চর্চা করতে থাকে এবং জগত এবং জীবন সম্পর্কে একপেশে চিন্তা করতে থাকে, তখন তার ভেতর হিংস্রতা এবং বর্বরতা দখল করে সৌন্দর্যের স্থান। তার মন জগতে ধূলির জন্ম নেয়। একটি আয়নায় ধূলিবালি পড়লে যেমন চেহারাটা দেখা দুরূহ হয়ে পড়ে। তদ্রƒপ মানুষের মনে যদি ধূলি পড়তে থাকে তখন মানুষের ভেতর স্বচ্ছ ও সৌন্দর্যের চিন্তায় ময়লা পড়তে থাকে যার দ্বারা প্রকৃত জীবনবোধ এবং চেতনার চিন্তা মলিন হতে থাকে। ধীরে ধীরে সে অদৃশ্য এবং যান্ত্রিক হয়ে যায়। তার ভেতর মানবিক বিষয়গুলো লোপ পেতে থাকে। মননশীল বিষয়গুলো অস্পষ্ট এবং অদৃশ্য হতে থাকে।
জগত এবং জীবন নিয়ে অলঙ্ঘনীয় প্রশ্নের মীমাংসা দেয়া কঠিন কাজ। কারণ এগুলো মানব জ্ঞানের সীমানার অতীত। যখন মানুষ মিথ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তখন জাগতিক ভোগ সামগ্রী এক চাকচিক্য চিরন্তন এবং স্থায়ী মনে হয়। কিন্তু হঠাৎ প্রাণ প্রদ্বীপ নিভে যাওয়াই প্রমাণ করে যে সে ভুলের ভেতর ছিল। এই ভুল কাজ থেকে মুক্তি দেয়া কঠিন কাজ। আর যারা মানবজাতিকে এসব থেকে মুক্তি দিয়েছেন তারা হয়েছেন মানবজাতির আলোকবর্তিকা।
মানুষের জীবনে সমস্যার শেষ নেই। জীবন শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম চলতে থাকবে যত দিন প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠন এবং মানবজাতির চাওয়া পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে এবং সভ্যতাকে ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু জাতিসঙ্ঘকে আজ কঠিন চিন্তার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে। যার কারণে শান্তির পিপাসায় বিশ্ববাসীকে মুক্তি দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। জাতি-ঊর্ধ্ব সংগঠন না থাকলে এবং মানুষের যদি জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে জগত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। শ্রেষ্ঠ জীবের দুর্দশা দেখে মানুষ কাঁদতে শুরু করেছে। বিশ্ব মানবতা যাবে কোথায়? এ সব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে জাতি-ঊর্ধ্ব সংগঠন তৈরি করার জন্য জাতিসঙ্ঘের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষের মহাজাগতিক চিন্তা ও চেতনার দ্বন্দ্ব মানুষকে মহাসঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। বিশ্ব আজ পারমাণবিক যুদ্ধের হুঙ্কারে শঙ্কিত। শুধু মার্কিনীদের হাতে যে পরিমাণ অস্ত্র মজুদ আছে তা দিয়ে দুনিয়াকে কয়েকবার ধ্বংস করা যায়। কিন্তু জীবনকে এই ধ্বংস হতে না দেয়ার পক্ষে আন্দোলন জোরদার করতে হবে। আজ সমস্যার শেষ নেই। পরিবেশ দূষণ, মারণাস্ত্র রোবটের প্রার্থনা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, আত্মহত্যা, জাতিগত দমন, গণহত্যা দুর্ঘটনা প্রভৃতির কথায় বিশ্ববাসী শঙ্কা পাচ্ছে। এ থেকে বাঁচার উপায় কী? মানুষের ভেতর খাদ্যের সমস্যায় পাশাপাশি চিত্তের সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। স্থূল বিনোদনের দিকে ঝুঁকে থেকে মানুষ মনন লোকে সত্য ও সুন্দরের চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শিল্প ও সংস্কৃতির চিন্তায় মানুষ বস্তুবাদী এবং ভোগবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যার কারণে মানুষের মানবিক বিষয়টি শূন্যের দিকে যাচ্ছে। জাগতিক সমস্যা দূর করার জন্য আছে মহাজাগতিক চিন্তাচেতনা। কিন্তু মহাজাগতিক চেতনার সত্য শিক্ষা কোথা থেকে আসবে। মানুষ কি এই চিন্তা তার নিজের ভেতর যে চেতনা আছে তা থেকে গ্রহণ করবে, যা মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞান। না তার ভেতর এই জ্ঞানের পাশাপাশি যদি কোনো ঐশ্বী জ্ঞান থাকে তাহলে আমরা সেটাকে সত্য বলে বিনা বিচারে মেনে নিতে পারি। কারণ এই জ্ঞানের প্রচারকরা জীবনে একটিও মিথ্যা কথা বলেননি। আমাদের অতিন্দ্রীয় জ্ঞান আসে বিশ্বাস এবং চিন্তার মাধ্যমে। আর এই বিশ্বাস লৌকিক বিশ্বাস নয়; বিজ্ঞান যতটুকু অগ্রসর হয়েছে তা দিয়ে কিছুটা পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
আত্মার কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব নেই। এটা আমরা প্রমাণ করতে পারি না। তবে আমাদের ভেতর যদি অবস্তুগত সত্য জ্ঞান থাকে তাহলে সেটা দিয়ে আমাদের মানবিক, মানসিক এবং বস্তুগত চাহিদার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ হবে। মানুষ হবে জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণীর দাবিদার। যা দিয়ে সে ফেরেশতাতুল্য এমনকি তারও উপরে চলে যাবে। যার মাধ্যমে জাগতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে এবং ইন্দ্রীয় ও অতিন্দ্রিয় মিলন ঘটবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement