২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ

-

১৯৪৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী শাসক-শোষক-নিপীড়ক সাগর পাড়ের বেনিয়া ইংরেজদের বিতাড়ন ও দেশ বিভাগের উত্তেজনা প্রশমিত হতে না হতেই নতুন রাষ্ট্র গঠন ও নবজাতি নির্মাণের উদ্দীপক মুহূর্তে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চারিত হয় পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী মহল। এবারের প্রতিপক্ষ কোনো বিদেশী শক্তি নয়, দেশীয় কংগ্রেসও নয়, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের নব্যশোষক গোষ্ঠী। স্বাধীনতার অর্থ মুক্ত আলো-হাওয়ায়, বাধা-বন্ধনহীনভাবে নিজেকে সার্বিকভাবে বিকশিত করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ। নিজেকে বিকশিত করার অপরিহার্য উপাদান ভাষা। বিশেষত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক ও অন্তর্লোকের বিকাশে ভাষা প্রধানতম মাধ্যম। এ পক্ষত্রে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। তাই মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের দাবিতে উর্বরা পলিমাটির সবুজ প্রান্তর আন্দোলিত-রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। তখনকার সে উত্তেজক মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে কিছু তরুণ কবি কচি কিশলয়ের মতো তাদের স্নিগ্ধ কোমল স্বরের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে দেন। ভোরের সোনালি সূর্য-কিরণে পললিত ফুলের সুবাসে যেমন আমোদিত হয় শিশিরসিক্ত সবুজ অরণ্যÑ বাংলা সাহিত্যাঙ্গণেও তেমনি এক অনাঘ্রাত নতুন সুরের কাকলি ছড়িয়ে দিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজল্লাহ, আব্দুস সাত্তার, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, ওমর আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শহীদ কাদরী প্রমুখ। প্রত্যেকের মধ্যেই এক নতুন ব্যঞ্জনা, কললিত উচ্ছ্বাস, আবেগমথিত হৃদয় নিছড়ানো অভিব্যক্তি ও লাবণ্যকান্তি দীপ্তিময় সুরের প্রাবল্য। তাদের উচ্চারণে, শব্দে-অনুরণনে, প্রকাশভঙ্গিতে পূর্ববর্তীদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকলেও রঙ-রূপে, স্বভাব-আদলে তারা অনেকটাই নতুনত্বের অভিব্যঞ্জনায় ও অনুরণনে দীপ্ত-সমুজ্জ্বল।
পূর্বসূরি কবি গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম, বেনজির আহমদ, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, আবদুুল কাদির, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, সানাউল হক প্রমুখ খ্যাতিমান কবিদের কাল তখনও অবসিত হয়নি, বরং তাদের কারো কারো প্রোজ্জ্বল আলোকচ্ছায়ায় পঞ্চাশের দশকের অনেকেরই প্রতিভার সুরভিত পুষ্পকোড়ক স্নিগ্ধ-সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তবু নতুনত্বের নব গুঞ্জরনে তখন মুখরিত চার দিক। এ নতুন সম্ভাবনার উজ্জ্বল আলোকরশ্মি নিয়ে রক্তরাগের মতো দীপ্ত বিকশিত হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ উজ্জ্বলতর হলেও অন্যরাও কোনো অংশে নি®প্রভ নন। বিশেষত এখানে কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর কথাই গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই।
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর (জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩৩, মৃত্যু ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩) প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জুলেখার মন’। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতেই তাঁর কাব্যচর্চার সূত্রপাত। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সর্বপ্লাবী স্রোতে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দেন। আন্দোলনে উত্তাল ঢাকা মহানগরীর মিটিং-মিছিলে তাঁর দীপ্ত পদচারণা। ভাষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেমের আজিমপুরের বাড়িতে তাঁর নিত্য আনাগোনা। ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘তমদ্দুন মজলিস’ ও এর মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকার তিনি নিয়মিত লেখক। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ভাষাসৈনিক শাহেদ আলী। সম্পাদনার কাজে বিভিন্নভাবে আরো জড়িত ছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফুর (পরবর্তীতে সম্পাদক), সানালাউল্লাহ নূরী প্রমুখ। আসকার ইবনে শাইখ, কবি শামসুর রাহমান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার অনেকেই লিখতেন সৈনিকের পাতায়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। ভাষা আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার ফলে মাহফুজউল্লাহর এ সময়কার কবিতায় দ্রোহের তাড়না, স্বদেশ প্রেমের উত্তেজনা ও গণমানুষের আশা-অভীপ্সার প্রতিফলন ঘটেছে।
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর রচিত কাব্যের মধ্যে রয়েছেÑ জুলেখার মন ১৯৫৯, অন্ধকারে একা ১৯৬৬, রক্তিম হৃদয় ১৯৭০, আপন ভুবনে ১৯৭৫, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর কাব্য-সম্ভার ১৯৮২, বৈরিতার হাতে বন্দী ১৯৯০, সময়ের বিমর্ষ দর্পণে ২০০৬, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর কবিতা সংগ্রহ ২০০১। এ ছাড়া কয়েকটি সুদীর্ঘ ও সংলাপধর্মী কবিতাসহ তাঁর অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যা প্রায় ৫০০। কবিতা ছাড়াও তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। কবি ও প্রবন্ধকার উভয় পরিচয়ই তাঁর ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। কবি হিসেবে তিনি মূলত গীতিকবি। তবে সনেট রচনায় তিনি পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর রচিত সনেটের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন শ’। অনুশীলনধর্মী তাঁর সনেটগুলো বিধি-সংবদ্ধ ও মানোত্তীর্ণ। এগুলো একত্রে স্বতন্ত্র গ্রন্থে সঙ্কলিত হলে সনেটিয়ার হিসেবে মাহফুজউল্লাহর পরিচয় অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। তাঁর রচিত শিশুতোষ ছড়া-কবিতার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। মানোত্তীর্ণ এসব ছড়া-কবিতার আলাদা একটি সঙ্কলন হলে বাংলা শিশুসাহিত্যে তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে পরিগণিত হবে।
কবিতার আসল সৌন্দর্য বহুলাংশে নির্ভর করে কবির চয়িত শব্দ, শব্দবিন্যাস-নৈপুণ্য, রূপক-উপমা চিত্রকল্পের ব্যবহারে মুন্সীয়ানা, ভাব ও বিষয়ের আবেগঘন হৃদয়-সংবেদী উপস্থাপনার ওপর। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ এসব ক্ষেত্রে সনিষ্ঠ ও সর্বদায় অনুশীলন প্রয়াসী। জুতসই শব্দচয়ন ও তার যথাযথ বিন্যাসে তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য সবার সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রূপক-উপমা চিত্রকল্পের ব্যবহারেও তাঁর ব্যতিক্রমী কৌশল পাঠককে মুগ্ধ করে। সর্বোপরি সহজ-সরল-মানবিক আর্তি ও সংবেদনাপূর্ণ ভাব ও বিষয় তাঁর কবিতার সর্বত্র এক স্নিগ্ধ অমলিন আবেশ ছড়িয়ে রেখেছে। দুর্বোধ্যতা, দুর্জ্ঞেয়তা তাঁর কবিতার ভাব ও বিষয়কে কখনো আচ্ছন্ন করেনি। তাই তাঁর কবিতার আবেদন সহজেই পাঠকের হৃদয়কে পাললিত করে। ঐতিহ্যাশ্রয়ী বিষয় ও আবেদন সৃষ্টিতেও তাঁর বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। সর্বশেষ তবে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, তাঁর সময়ে যখন অনেক আধুনিক কবি অশ্লীল শব্দ ও অনৈতিক ভাব-বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে উন্ন্যাসিক ও বিকারগ্রস্ততার পরিচয় দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে তিনি পরিচ্ছন্ন, পরিমল, শ্লীল শব্দরাজি, চিৎকর্ষমূলক ভাব-বিষয় নিয়ে অনবদ্য কবিতা রচনায় অনুকরণযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এ জন্য তাঁর কবিতা সর্বশ্রেণীর পাঠকের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানে দু-একটি উদাহরণ দেয়া হলোÑ
অফুরন্ত বৃষ্টি চাই আজ।
গ্রীষ্মের দুপুরে ক্ষীণ-কণ্ঠে বাজে কান্নার আওয়াজ
অফুরন্ত বৃষ্টি চাই আজ।

এখন পৃথিবীজুড়ে নুহের প্লাবন আসে যদি
যদি তা ডুবিয়ে দেয় পৃথিবীর মাঠ-বন-নদী-
এমনকি দিগন্তের ধূ-ধূ সেই দূরের কিনার
তা’হলে প্রশান্ত হবে পৃথিবীর আর্ত-হাহাকার।
(বৃষ্টির জন্যে : জুলেখার মন)
ঘুম নেই দু’চোখে আমার।
এখন রাতের ছোঁয়া সময়ের পাখির পালকে;
মাঝে মাঝে ছায়া-অন্ধকারে
আকাশে ছিটানো তারা-অবারিত তারার জৌলুস।
(তারার প্রেম : জুলেখার মন)
হৃদয় রেখেছি আমি এ-দেশের নদীর কিনারে,
তিতাসের বালুচরে আ-সকাল-সন্ধ্যা আমি একা-
দেখেছি হাজার পাখী, সাদা-নীল, আরও রঙ-রেখা
বিচিত্র পালকে আঁকা, -উড়ে যায় দিগন্তের পারে
খয়েরি মেঘের নিচে গোধূলির ম্লান অন্ধকারে;
(হৃদয় রেখেছি আমি : অন্ধকারে একা)
গদ্যশিল্পী মাহফুজউল্লাহর কৃতিত্ব একসময় তাঁর কবিখ্যাতি ছাড়িয়ে যায়। মূলত গদ্য-পদ্য উভয় রীতিতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সাহিত্য সমালোচনা, সাহিত্যের ইতিহাস রচনা, বিভিন্ন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের মূল্যায়ন, সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর চিন্তা-চেতনা সংবলিত তাঁর মননশীল রচনার পাশাপাশি আত্মজৈবনিক রচনা, উপন্যাস-গল্প ইত্যাদি রচনায়ও তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী। তাঁর গদ্যের ভাষা প্রাঞ্জল ও গতিশীল।
সাংবাদিকতার জগতেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। মাহফুজউল্লাহর মতো কীর্তিমান প্রতিভাবান সৃজনশীল ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি। বিশিষ্ট সাহিত্যবোদ্ধা প্রফেসর কবীর চৌধুরীর একটি মন্তব্য দিয়ে আলোচনা শেষ করছি। তিনি বলেনÑ
‘নানা ভাব ও বিষয়কে সচেতন আঙ্গিক-বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা মাহফুজউল্লাহর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি।...আমরা একদিকে তাঁর কবিতায় সৌন্দর্য-সচেতন বিস্ময়মাখা রোমান্টিক সুর সহজেই লক্ষ্য করি। অন্য দিকে অনেক কবিতায় তিনি আবার ব্যঙ্গাত্মক, কঠোর বাস্তববাদী, ঋজু ও দৃঢ়, জীবনে হতাশা, নৈরাশ্য, শঙ্কা, বঞ্চনা ও অশুভের উপস্থিতি সম্পর্কে নির্ভুলভাবে সচেতন।... কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমকালীন যুগ-যন্ত্রণার শিকার হয়েও তিনি নৈরাশ্যে বা নৈরাজ্যে নিমজ্জিত নন। তাঁর কাজে তিনি শুভ ও কল্যাণকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, নিজের অন্তর সত্তার আবেগ ও অনুভূতিকে আকর্ষণীয় উপমা ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে রূপায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বিশেষভাবে তাঁর অনেকগুলো সনেটের ঋজু সংহত রূপ, মিল-বিন্যাস, ছন্দ প্রকরণ এবং ভাবের অভিব্যক্তি তাঁকে একজন যতœবান কৃতী কারুশিল্পী রূপে তুলে ধরেছে’ (কবীর চৌধুরী : সচিত্র সন্ধানী, ২৭শ’ সংখ্যা, নভেম্বর, ১৯৮২)।


আরো সংবাদ



premium cement
গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ীভাবে বাকশালে পরিণত করতেই খালেদা জিয়াকে বন্দী রেখেছে সরকার : রিজভী বন্যার আশঙ্কায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার কৃষকরা ফিলিপাইনে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচণ্ড গরম থাকবে তীব্র তাপদাহে পথের ধারে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া তজুমদ্দিনে আগুনে পুড়ে ১৩ দোকান ছাই গাজা নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে সৌদি আরব যাচ্ছেন ব্লিংকেন ধামরাইয়ে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ, কাঁদলেন মুসুল্লিরা বান্দরবানে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ২ কেএনএফ সদস্য নিহত এসএসসি পরীক্ষার ফল ৯ থেকে ১১ মে’র মধ্যে প্রকাশ কলাপাড়ায় বালুর জাহাজ থেকে ছিটকে পড়ে শ্রমিক নিখোঁজ যেসব কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে আপনার ফেসবুক আইডি ও পেজ

সকল