একজন কবির থাকে একটি আলাদা জগৎ। একটি অন্যরকম ভুবন। যে জগৎ কেবলই কবির। যে ভুবন কেবলই কাব্যের। হতে পারে কবির এ জগৎ আনন্দ বেদনার অথবা দুঃখের। হোক। কিন্তু সে আনন্দ সে বেদনা এবং সে দুঃখ শুধুই কবির একাকীর। শুধু তাঁর নিজস্বতার অনুভব। কবি এ ভুবনে থেকেই লেখেন। একজন কবি যা রচনা করেন তাঁর সব শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হয় না। সব লেখাই এক মানের কিংবা মানোন্নত হয় না। এক মানের না হওয়ার পেছনে গোপন থাকে নানা কারণ। কিছু কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। কিছু ব্যাখ্যাতীত। সব কথা যেমন প্রকাশ করা যায় না, সব স্বপ্নের যেমন ভাষা নেই, সব আশার যেমন রঙ নেই; তেমনই সব কারণেরও প্রকাশ নেই। সব কারণ ভাষার কাছে আত্মপ্রকাশ করতে রাজি নয়। সব কারণ নিজের দেহের রঙ চড়াতে চায় না। ফলে সব বিষয়ের মতো এ বিষয়েও কিছু কারণ গোপন থেকে যায় চিরকাল। এ গোপন বিষয় ভেদ করা হয়তো সম্ভব নয় কোনোদিন।
একজন লেখক যখন তাঁর রচনার দীঘিতে ডুব দেন, তখন তিনি আর স্বাভাবিক কোনো অবস্থার ভেতর থাকেন না। স্বাভাবিকতার কাছে থাকে না তাঁর অনুভূতি। তাঁর কল্পনা। তাঁর ধ্যান। সব কিছু ওই ধ্যানের নিকটবর্তী হয়ে ওঠে। সব কিছুতেই তাঁর রচনার রহস্য জেগে থাকে। একটি রচনার জন্য একজন লেখককে কত না ধ্যানী হতে হয়। কতটা গভীরে তলাতে হয় সে কথা একজন পাঠক কি উপলব্ধির আঙিনায় আনতে সক্ষম হবে! একজন কবির বোধের জায়গায় একজন পাঠক পৌঁছাতে প্রায় অক্ষম।
হয়তো কিছুটা ভাবতে পারবে। কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। কিন্তু পুরোটা! না। কম্মিনকালেও নয়। একজন লেখক তাঁর জগৎ নিয়ে বেঁচে থাকেন। তাঁর জগতে তিনি একা। একাই চলেন তিনি। তিনি যে তাঁর জগতে একা এ কথাও একজন পাঠক সহসাই উপলব্ধি করতে অক্ষম। পাঠক জানেন না অথবা উপলব্ধি করার সামর্থ্য রাখেন না যে, একজন কবি কতটা ক্ষরণের ভেতর রচনা করেন তাঁর কবিতাটি।
একজন কবি একা পথের পথিক। তাঁর সঙ্গী সাথী যে বা যারাই হোন, তাঁরা কিন্তু তাঁর চিন্তার আকাশ স্পর্শ করতে পারেন না। তাঁর ভাবনার জগতে প্রবেশ করার শক্তি রাখেন না। লেখকের কাছে পৌঁছানো সহজ। কিন্তু লেখকের জগতে প্রবেশ করা অনেক কঠিন। কঠিনই বলি কেন, একে বলতে হয় অসম্ভব। এমন অসম্ভব জগৎ নিয়ে চলেন একজন কবি। চলেন কিংবা ডুবে থাকেনÑ যা-ই বলি এটি তাঁর নিজস্ব জগৎ। তাঁর একান্ত বিচরণের জগৎ। তাঁর অনুভূতির জগৎ। তাঁর স্বপ্নের জগৎ।
যখন তিনি লিখতে বসেন, তখন তাঁর জগতের দরজা খোলেন তিনি। প্রবেশ করেন সন্তর্পণে। তাঁর ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে আর কোনো উপস্থিতি থাকে না। থাকতে পারে না। তিনিও রাখতে সম্মত নন অথবা এ বিষয়ে ভাবেনও না তিনি। তাঁর ভাবনার জগৎ তখন তাঁর সৃষ্টিকে ঘিরে। তাঁর রচনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তাঁর এ আবর্তনে কোনো রকম কৃত্রিমতা নেই। কোনো হেলাফেলা নেই। কোনো দায়সারা গোছের কিছু থাকে না। বরং তিনি সর্বোচ্চ মগ্নতা ঢেলে তাঁর রচনার শরীর নির্মাণ করেন। ধ্যানময়তা নিয়েই তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর কাক্সিক্ষত বিষয়। এ মগ্নতার কোনো নাম নেই। কোনো শরীর নেই।
কবিতার কথাই বলি। একজন কবি যখন কবিতার আনন্দে নিজেকে নির্মাণ করেন, তখন তাঁর সারা ভুবন ভরে কবিতার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। কবিতা ছাড়া তিনি আর কিছুকেই হিসাবের ভেতর গণ্য করেন না। কবিতাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাঁরই অস্তিত্বের ভেতর। তাঁর স্বপ্ন তাঁর আশা তাঁর চেতনার বাতিঘর সবই ঘুরপাক খেতে থাকে কবিতার জন্য। তিনি কবিতা খোঁজেন। কবিতার আত্মা খোঁজেন। খোঁজেন কবিতার শরীর। কবিতার অন্তর্গত আনন্দ খোঁজেন। খোঁজেন কবিতানন্দের সুখ।
কোথায় থাকে কবিতা? এ প্রশ্ন তাকে বিচলিত করে। সে নিজেকে নিজেই অপরিচিত করে তোলে কবিতার কাছে। কবিতা তাঁর নাকি সে-ই কবিতার। অথবা একে অপরের সবটিই তো সত্যের মতো চলে। কবিতাকে কবির করে তোলা অনেক কঠিন কাজ। এ কাজে নিবেদিত হতে হয়। এ নিবেদনে কোনো ফাঁকিঝুঁকির আশ্রয় নেয়া চলে না। যদি কোনো কবি কবিতায় ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেন তবে তাঁর কবিতার কাছে পৌঁছানো দুর্লভ হয়ে ওঠে। কবিতা তাঁর কাছে ধরা দিতে চাইবে না। তাঁর নিকটবর্তী হতেও অনীহা প্রকাশ করবে। তাকে কবিতা অবহেলা করবেই। সে যতই বলুক কবিতার ভালোবাসার কথা, যতই বলুক প্রেমের কথা; তাঁর ভালোবাসায় খাদ থেকে যাবে। তাঁর প্রেম কখনো নিখাদ হবে না। প্রেম নিখাদ না হলে প্রেমও পালিয়ে যায়। সেও চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রেমের কাছে হার মানতে হয়। পরাজিত হতে হয়। আমরা পরাজিত হতে শিখি না। পরাজিত হতে পারি না। ফলে আমাদের বিজয়ও আসে না। আসে না প্রেমের প্রশান্তির দিন। প্রেম অনুভব করার বোধ দরকার পড়ে। বোধহীন অথবা তরল বোধের মানুষেরা এ জগৎ এবং এ আনন্দের খবর কোনোদিন পাবে না। পেতে পারে না।
কবিতার মগ্নতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ অনেক। অনেক পথ একজন কবিকে ডাকে। কিন্তু কবির পথ একটিই। এক পথেই তাকে ছুটতে হয়। থাকতে হয়। যেতে হয় ধীরে। অতি ধীরে। কবিতায় কোনো সহসা কিছু ঘটে না। এ পথ অনেক দীর্ঘ পথ। অনেক লম্বা। অনেক কষ্টের। অনেক ত্যাগের। অনেক সাধনার। যে কবি কবিতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন না, করতে পারেন না; তাঁর জন্য কবিতার কোনো অপেক্ষা নেই। কবিতা তাঁর কাছে ধরা দেবে না। তাঁর প্রেমে কবিতা মজে না কোনো দিন। কবিতাকে ভালোবাসতে হয় হৃদয়ের পুরোটা দিয়ে। বুকজুড়ে কবিতার ঘর নির্মাণ করতে হয়। মনজুড়ে থাকে কবিতার সংসার। সারাটা চেতনাজুড়ে থাকে কবিতার পৃথিবী।
হৃদয়ের সর্বত্র সব দুয়ার ধরে কবিতা থাকে বিদ্যমান। কবিকে এ কথা বুঝতেই হবে। যদি না বোঝেন কবি তবে তাঁর ব্যর্থতা কে ঠেকাবে? কেউ না। কেউ ঠেকানোর নেই। কবিতা লেখেন একজন কবিতার অন্তরের বাসনা থেকে। হৃদয়ের প্রবল ভালোবাসা থেকে। ভালোবাসার বিকল্প কোনো পথ কবিতার জগতে খোলা নেই। বিকল্প বিষয়ের প্রতি কবিতার কোনো আগ্রহ-উচ্ছ্বাস নেই। সমর্থনও থাকে না। কবিতা কেবল কবিতাকেই ভালোবাসে। কবিতার প্রেমেই মজে থাকে কবিতা। এ ক্ষেত্রে কবিতাকে নির্মম বলাও যেতে পারে।
হ্যাঁ, কবিতা নির্মম। নিষ্ঠুর! সে সহসা ধরা দিতে চায় না। প্রেমের গভীরতা বিনে সে কাছে আসে না। সামান্যতেই তাঁর অভিমান অনেক। অল্পতেই তাঁর অনেক মেজাজ। ভীষণ অভিমানী সে। মুহূর্তেই ছলকে যায়। ছিটকে পড়ে দূরে। কোথায় যে থাকে সে খবর কিছুতেই দিতে চায় না। তাঁর আগমন-নির্গমন, তাঁর চলাফেরাÑ সবই নিঃশব্দতার প্রাচীর বেয়ে। কোথাও তাঁর অবস্থিতি নেই। কোথাও নেই বাসস্থান। তবু কবি খোঁজে তাকে। খোঁজে হৃদয়ের পরতে পরতে। মনের আঙিনাজুড়ে। শরীরের গোপন কণিকায়। জীবনের বাঁকে বাঁকে। কবিই তাঁর একমাত্র সঙ্গী। একমাত্র বন্ধু। একমাত্র প্রেমিক। তাঁর সঙ্গী কবিতার প্রেমে মজে যাওয়া পাঠক।
একজন পাঠকও কবিতার প্রেমিক হতে পারেন। হতে পারেন কবিতার ঘনিষ্ঠজন। কিন্তু সে প্রেম তো কবির প্রেমের মতো নয়। সে ঘনিষ্ঠতা কবির ঘনিষ্ঠতার কাছাকাছি হবে না। কবি যেভাবে কবিতাকে প্রেম দেবেন, সেভাবে তো কবিতাপাঠক দেবেন না। দিতে পারেন না। পারেন না কারণ কবিতা-পাঠকের হৃদয়ে এত প্রেম কোথায়? এত ভালোবাসা কোথায়? কবি তো তাঁর হৃদয়ের সর্বস্ব দিয়ে কবিতাকেই ভালোবাসেন। কবিতাকেই নিবেদন করেন প্রেম। একজন পাঠক কি তা করবেন? কিংবা করতে পারবেন? পাঠককে খাটো করা নয়। পাঠক অনেক বড়। কবিতার আশ্রয় তো পাঠকের কাছেই। কিন্তু হৃদয়গতভাবে একজন কবিতা-পাঠকের প্রেম আর একজন কবির প্রেমের ব্যবধান থাকবেই। থাকতেই হবে। এ ব্যবধানই একজনকে কবি করে তোলে। আরেকজন পাঠক হয়ে যান। একজন হন সাময়িক প্রেমিক। আরেকজন চিরকালের। একজন সময় না পেলে ভুলে যাবেন। আরেকজন সময়-অসময় গণ্য করেন না। কবিতার প্রেমই তাঁর সব প্রেমের ঊর্ধ্বে। কবিতা প্রেম তাকে জীবনের অর্থ বোঝাতে সাহায্য করে। জীবনকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ করে দেয়। জীবনের লুকায়িত সব রহস্যের দরজা চিনিয়ে দেয়। সৌন্দর্য চেতনার যাবতীয় বিষয় কবির চোখে মুক্ত হয়ে যায়। কবি এ মুক্তির আনন্দে পৃথিবীকে বুকে চেপে ধরে বলতে থাকেনÑ পৃথিবী তুমিও আমার কবিতা।
কবিতার জগৎ কবির আনন্দের জগৎ। কবির বেদনার জগৎ। কবির স্বপ্নের জগৎ। এ জগৎ ছেড়ে কোথাও যেতে চান না কবি। কোথাও না। তাঁর যত ক্ষতি যত দুঃখ-বেদনা থাক, তিনি কবিতার পক্ষ ত্যাগ করেন না। তাঁর ঘুম-জাগরণ কবিতার সাথেই হতে থাকে। তাঁর সময়-অসময় কবিতার সাথেই মিলে যায়। তাঁর আহার-বিহারে সর্বত্র কবিতার ছাপ লেগে থাকে। বাইরে তিনি সাধারণ। ভেতরে কবিতারই সৌন্দর্যে মগ্ন। এ মগ্নতা ছিন্ন করার সাহস কারো নেই। কোনো শক্তিই পারে না বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তুলে দিতে।
কবি জীবনভর কবিতার স্বপ্নে বিভোর থাকেন। আর সব চাওয়া-পাওয়া গৌণ হয়ে যায়। আর সব প্রেম ম্রিয়মাণ হয়ে যায় কবিতা প্রেমের কাছে। তাঁর কাছে কবিতার মতো সুন্দর আর কিছুই নেই। কেননা কবিতার জগৎ আর কবির জগৎ চিরকালই নান্দনিক। এ নান্দনিকতা তাকে নিয়ে যায় জীবনের গহীন থেকে গহীনতর ভুবনে। নিয়ে যায় কাল থেকে মহাকালের অন্দরে। একজন কবি তাঁর জগতের সৌন্দর্যের মতো আর কোনো সুন্দর অবলোকন করেন না। তাঁর জগতের মতো প্রেম আর কোনো জগতের ভেতর অনুভব করেন না। কবির জগৎ একান্ত তাঁরই জগৎ। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা