২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ড. ইউসুফ আল কারযাভীর জীবনালেখ্য

-

ড. ইউসুফ আল কারযাভী গত ২৬ অক্টোবর সোমবার কাতারে জোহরের সময়ে ৯৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মিসরের পশ্চিম প্রদেশের আল মাহাল্লাহ আল কুবরার ‘সাফত-তুরাব’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি অনেক পুরনো গ্রাম, যেখানে মিসরে ইন্তেকাল করা সর্বশেষ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আলহারিস ইবনে জুযআলযুবায়দি কবরস্থ হন। এখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা হাসিল করেন এবং বয়স দশে পৌঁছানোর আগেই আল কুরআন মুখস্থ করে ফেলেন। এরপর রাজধানীতে আসেন। সেখানে ‘মা’হাদ আল-আজহার এ প্রাথমিক সেকেন্ডারি ও ‘এ’ লেভেল পাস করেন। এ লেভেলে মিসরের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এখান থেকে আল আজহারের কুল্লিয়্যাত উসুলিদ্দিন থেকে ১৯৫৩ ডিগ্রি পাস করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে।

১৯৫৪ সালে তিনি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে টিচিংয়ে ডিগ্রি নেন এবং পাঁচ শ’ ছাত্রের মধ্যে তিনি প্রথম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

১৯৫৮ সালে তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্যে হায়ার ডিপ্লোমা নেন এবং ১৯৬০ সালে কুরআন ও সুন্নাহ অনুষদ থেকে মাস্টার্স সমমান ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তিনি আল-আজহার থেকে ডক্টরেটে ভর্তি হয়েও শেষে বহিষ্কৃত হন। পরে পাকিস্তান থেকে ডক্টরেট নেয়ার চেষ্টা করেন। অবশেষে আল-আজহার থেকেই ১৯৭৩ সালে ডক্টরেট নিতে সক্ষম হন।
তিনি প্রথমে মসজিদের খতিব হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর মিনিস্ট্রি ওফ আওকাফের অধীনে শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি আল-আজহারের প্রকাশনা বিভাগে কাজ শুরু করেন।

১৯৬১ সালে তিনি কাতার সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে ‘মা’হাদ সানাওয়ি’ (এ লেভেল কলেজে) চাকরি শুরু করেন। এখানেই তিনি তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। একে গোটা দেশের সেরা ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তুললেন তিনি। ১৯৭৩ সালে সরকার তার কাঁধে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক কলেজ অব এডুকেশন প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দেয়। এটিই পরবর্তীতে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। ১৯৭৭ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি শরিয়াহ ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে নিয়োগ পান। এই পদে ছিলেন ১৯৯০ পর্যন্ত। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ গবেষণা বিভাগ ‘বুহুথ আসসুন্নাহ ওয়া আস-সিরাহ’ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৯১ সালে তাকে আলজেরিয়ার সরকার নিজ দেশের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর সুপারভিশনের দায়িত্ব দেন। সেখান থেকে ফিরে এসে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুহুথ আস সুন্নাহ ওয়া আস-সিরাহ’র দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

তিনি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৯০ সালে তিনি অর্থনীতিতে অবদানের জন্য আইডিবি পুরস্কার লাভ করেন। ১৪১৩ হিজরি অর্থাৎ ১৯৯২ সালে ইসলামী স্টাডিজে অসামান্য অবদানের জন্য মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে পরিচিত কিং ফয়সল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাকে। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টিশীল কাজের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া তাকে পুরস্কৃত করে। ১৯৯৭ সালে তিনি ব্রুনাইয়ে সুলতান হাসান বলখিয়া পদক লাভ করেন। তিনি হলেন ওই আলেমদের মধ্যে গণ্য যারা উম্মাতের জন্য সভ্যতা প্রকল্পের কাজ করেছেন। তার লেখা ১৩০টি বই আমার কাছে আছে। আরো ২০টির মতো বই কয়েক বছরে বাজারে এসেছে। তার বহুমুখী কাজের বিভিন্ন লেখাগুলো সারা পৃথিবীকে ঋদ্ধ করেছে। তার অবদানগুলোকে আমরা নিচের কয়েকটি দিক ও বিভাগে পৃথকভাবে আলোকপাত করতে চাচ্ছি, যাতে তার কাজের সামগ্রিকতা যে কেউ অনুধাবন করতে পারেন :

মৌলিক ক্রিয়েটিভ ইজতিহাদি ও ফিকহি অবদান : বর্তমান জমানায় যারা ইসলামী জ্ঞান গবেষণায় মৌলিক ও ক্রিয়েটিভ কাজ করেছেন তার মধ্যে ড. কারযাভীর অবদান আকাশছোঁয়া। তিনি ইসলামী ফিকহ, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, আন্দোলন, থিয়োলজি, রাজনীতি বিজ্ঞান, ইসলামী সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্য এবং ইতিহাস বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে বই লিখেছেন, যা সবটাই মুসলিম সমাজ, অমুসলিম গবেষক এবং পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে তার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো :

প্রথমত, তিনি তার লেখনীর তথ্য উপাত্ত নিতে ইসলামের মৌলিক গ্রন্থাবলির কাছেই গেছেন এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরত সালাফ সালেহিন কর্মপন্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানা বিষয়ের আলোচনা করেছেন। এসব করতে গিয়ে তার লেখনীতে আমরা যেমন প্রাচীনতার স্বাদ পাই, তেমন নতুনত্বের ব্যঞ্জন উপলব্ধি করি এবং সবচেয়ে মজার বিষয় পাই আধুনিকতম মেথোডোলোজির ব্যবহারে যুব ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মন ও মননছোঁয়া অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনা।

দ্বিতীয়ত, তিনি তার আলোচনা ও পর্যালোচনায় তিনটি বিষয় খুব খেয়াল করেছেন, তা হলো- জ্ঞান গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, চিন্তা ও দর্শনের সঠিক প্রয়োগ ও সমাজ সংস্কারে গভীর অনুধ্যান।

তৃতীয়ত, তিনি অত্যন্ত নিখুঁত ও জ্ঞাতসারেই অন্ধ তাকলিদ, মাজহাবি গণ্ডি এবং প্রাচ্য প্রতিচ্যের ভাব দর্শনের ছায়া থেকে নিজকে সরিয়ে রেখেছেন। ফলে তার লেখাগুলোতে ইসলামী ইজতিহাদের স্বাদ যেমন টইটম্বুর, তেমন ইতিহাসের
দার্শনিক ও উলামাদের সুগন্ধ প্রতিটি ছত্রে ছড়িয়ে আছে।

চতুর্থত, তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবেই চিন্তা দর্শনে মধ্যপন্থা, প্রায়োগিক পর্যায়ে সহজতা ও দাওয়তি ক্ষেত্রে ইনসাফ এবং কোমলতা অনুসরণ করেছেন। ফলে তার সিদ্ধান্তগুলো কোনো রকম বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির রোগমুক্ত হয়ে উঠেছে। এই জন্য ‘আল উম্মাহ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ড. হাসানাহ ড. কারযাভী রচিত
‘আস সাহওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ বায়নাল জুমুদ ওয়া আততাতাররুফ’ (উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী আন্দোলন) বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, ‘ড. কারযাভী হলেন অতি সামান্য এমন ইসলামী চিন্তকদের অন্তর্ভুক্ত যারা মধ্যপন্থী, যারা শরিয়তের সরল দিকগুলো এবং যুগের চাহিদাগুলো এক করে উপস্থাপন করেছেন।

পঞ্চমত, তার লেখনীতে আড়ষ্টের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। অত্যন্ত সহজ করে, মনোমুগ্ধকর করে এবং সাহিত্যের ছোঁয়া ঋদ্ধ করে মানুষের নাগালে ইসলামের অত্যন্ত জটিল বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।

ষষ্টত, তিনি তার লেখাগুলো আধুনিক বিশ্বের ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে বারুদের মতো ব্যবহার করেছেন। ভেতর-বাইরের ইসলামের দুশমনদের তিনি চিনেছেন, ফলে একাধারে তার লেখা যেমন ইসলামের চিরচেনা শত্রুদের দর্শনগুলোর জড়ো কেটেছেন, অন্য হাতে কলম ধরেছেন মুসলিম সমাজের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে।

সপ্তমত, তার লেখনী, বক্তৃতা, ডিবেট, আলোচনা সবটাতে একজন দাঈ ইলাল্লাহের ভাষা, একজন মুরব্বির আদর এবং একজন একনিষ্ঠ ইসলামপ্রেমীর ভালোবাসার বন্যা বয়ে যায়। তার সম্পর্কে যারাই লিখেছেন, বলেছেন, তার গ্রন্থসমূহ ও লেখনীতে একজন বোদ্ধা ফকিহর চুলচেরা বিশ্লেষণ, একজন সাহিত্যকের চমক, একজন দাঈ ইলাল্লাহর উষ্ণ আবাহন, কিংবা একজন মুজাদ্দিদের গভীর দৃষ্টি দেখতে পাবেন।

তিনি নাটক লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, স্কুল কলেজের উপযোগী বই লিখেছেন, গবেষণা ঋদ্ধ আর্টিকেলে বিশ্ব লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করেছেন, তার যুগের সেরা সব ম্যাগাজিন ও সাময়িকীতে লেখার ঢেউ তুলেছেন।
যারা তার ‘ইসলামে হালাল-হারাম’ পড়েছেন, ‘ফিকহ আয-জাকাত’ দেখেছেন, তারা অকপটে স্বীকার করবেন যেন ইসলামী ফিকহের যে ডাইমেনশন এখানে তিনি রচনা করেছেন তাতে মৌলিকত্ব, আধুনিকতা, ইজতিহাদ ও যুক্তির প্রাচুর্য যুগপৎভাবে ফুটে উঠেছে।

(দ্বিতীয় অংশ আগামীকাল)
(সূত্র : আস সিরাহ আয যাতিয়্যাহ : ড. ইউসুফ আল কারযাভী)


আরো সংবাদ



premium cement