২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সন্তান যখন মা-বাবার জন্য সদকায়ে জারিয়া

-

প্রত্যেক মা-বাবার কাছে সন্তান পরম আদরের ধন। তাদের কলিজার স্পন্দন। সন্তান বিপদে পড়লে মা-বাবার অন্তর ছিঁড়ে যায়। তার খুশির জন্য সে নিজের জীবনকেও কঠিন বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। তবুও সে সন্তানের ভালো চাইবে। সন্তান-সন্ততির প্রতি মা-বাবার অন্তরে আল্লাহ তায়ালা এক অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য...।’ (সূরা কাহফ-৪৬) ‘...তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তায়ালার পরীক্ষা মাত্র...।’ (সূরা আনফাল-২৮)

আমরা সন্তানের পার্থিব কল্যাণের কথা এত বেশি চিন্তা করি যে, যখন সে আখিরাত হারাতে বসে তাকে সেখান থেকে বের করে আনার চিন্তাও করি না। তাকে দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষাগুলো থেকে দূরে রাখি। শিশু-কিশোর ও যৌবনে সে এমন সব কাজ করে, যা দ্বীনের বিপক্ষে তো যায়-ই; এমনকি মানবতার জন্যই ক্ষতিকর। সে নিজে পাপ করছে। কখনো পাপের ধারা তৈরি করছে; যাতে ক্রমাগত তার আমলনামায় মন্দ কাজের পুরস্কার যোগ হতে থাকে। এ কারণে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার সবক দিতে হবে। ইসলামের বিধিবিধান, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে তাকে অবহিত করতে হবে। তাই মহানবী সা: বলেছেন, ‘... সন্তানকে আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দান করা একসা (একটি পরিমাপ) শস্য আল্লাহর রাস্তায় সাদকা করা থেকেও উত্তম।’ (তিরমিজি) অন্য এক হাদিসে মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘কোনো পিতা তার সন্তানকে ভালো আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া থেকে উত্তম আর কোনো পুরস্কার দিতে পারে না।’ (তিরমিজি)

পিতামাতা হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই সন্তানের কল্যাণকামী। সুতরাং আপনি সন্তানকে এমন শিক্ষাই দান করবেন যে শিক্ষা নিয়ে সে, নিজের জীবনকে আল্লাহর রাহে নিবেদিত করবে। দুনিয়ার জীবনের আমলগুলোকে সে আখিরাতের জন্য তৈরি করবে। যে কাজের মধ্যে সে আল্লাহর অসন্তুষ্টি দেখতে পাবে জীবন গেলেও সে দিকে সে ধাবিত হবে না। স্বার্থের চেয়ে সে ঈমানের গুরুত্ব বেশি দেবে। মানুষের হক নিয়ে ভাববে। নিজের আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ব্যাপারে দ্বীনের নীতিকে অনুসরণ করবে। এ জন্য দরকার দ্বীনের জ্ঞান। মহানবী সা: বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ’। (ইবনে মাজাহ) প্রশ্ন হতে পারে, এই জ্ঞান কোন ধরনের আর তার সীমাই-বা কতটুকু? এখানে জ্ঞান বলতে ইসলামী জ্ঞান। সহজ কথায় বলতে গেলে, একজন মুসলমানের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে কী কী হুকুম রয়েছে আর তা রাসূল সা:-এর তরিকা অনুযায়ী কিভাবে পালন করা যায়, তা জানা অপরিহার্য। তাই মানুষের জ্ঞান ও কর্মের পরিধি অনুযায়ী সে যখন কোনো কাজ করতে অগ্রসর হয় তখন তাকে ওই কাজের ব্যাপারে দ্বীনের বিধানগুলো কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে সুন্দর করে জেনে নিতে হয়। এই জানার মধ্যেও বান্দার জন্য অনেক কল্যাণ রয়েছে। মহানবী সা: বলেন, ‘রাতের কিছু সময় জ্ঞানচর্চা করা পূর্ণ রাত্রি (ইবাদতে) কাটানো অপেক্ষা উত্তম’। (দারেমি)

সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা দিন। কঠিন সময়েও সে বিপথগামী হবে না। কারণ মানুষের মধ্যে যখন সঠিক দ্বীনি জ্ঞানের অভাব থাকে শয়তান ভালো কাজের ছলনায় তাকে দিয়ে অনেক মন্দ করিয়ে নেয়। তাই মন্দ থেকে ভালোর তফাত জানতে হলে শরয়ি জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। এতে আপনিও জবাবদিহিতার হাত থেকে বাঁচবেন, সন্তানও বাঁচবে জাহান্নামের আগুন থেকে। মনে রাখবেন, আপনার দায়িত্বহীনতার কারণে যদি সে দ্বীনের সঠিক শিক্ষা না পায়, সে বাপ বলে পরকালে আপনাকে ছাড় দেবে না। নিজে তো জাহান্নামে যাবেই, আপনাকে সাথে নিয়ে যাবে। তাই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জাহান্নামের আগুন থেকে তোমরা নিজেরা বাঁচো আর তোমাদের পরিবার-পরিজনকেও বাঁচাও’। (সূরা তাহরিম, আয়াত-৭)

এই জ্ঞানার্জন করার জন্য আপনাকে যে মাদরাসায় পড়তে হবে বিষয়টি তেমন নয়। আপনি হয়তো জানেন আলিম হতে হলে মাদরাসায় পড়া শর্ত নয়। যদি তাই হতো, তাহলে সাহাবি আজমাইন আ:, তাবেয়িসহ এমনটি আমাদের ইমাম ইমামে আজম আবু হানিফা রহ:-ও ইমাম ছিলেন না। সন্তানকে আল্লাহর মারেফাত সম্পর্কে শিক্ষা দিন। যে শিক্ষার দ্বারা সে আল্লাহর তাওহিদের জ্ঞান লাভ করতে পারে। কারণ যে আল্লøাহকে চিনতে পারে না সে কখনো আলেম হতে পারে না। যে রাসূল সা:-এর পরিচয় জানে না সে তার উম্মত হতে পারে না। তাকে দ্বীনের জ্ঞান সম্পর্কে দক্ষ করে তুলুন, যাতে সে দলিলের মাধ্যমে দ্বীনের বিধানগুলো জানতে হবে। এমন সন্তান আপনার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনবে।

তাই দুনিয়াকে শুধু অগ্রাধিকার না দিয়ে দ্বীনের কথা ভাবুন। কারণ মানুষের প্রকৃত বন্ধু ও কল্যাণকামী হলো সেই ব্যক্তি, যে তার আখিরাতকে সুন্দর ও শান্তিময় করার চেষ্টা করে। যদিও এতে তার দুনিয়ার কিছু ক্ষতি হয় তাও সে স্বীকার করে নেয়। আর মানুষের শত্রু হলো সেই ব্যক্তি, যে তার আখিরাতের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। যদিও এর দ্বারা সে দুনিয়ার কিছু ফায়েদা লুটে নেয়।

সুতরাং আপনি সন্তানের ব্যাপারে এমনভাবে চিন্তা করুন যেন সন্তানগুলো আপনার জন্য নেক সন্তান হয়ে যায়। বৃদ্ধ বয়সে হজরত ইবরাহিম আ: আল্লাহর কাছে সৎপুত্র সন্তান লাভের জন্য দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালাও তার দোয়া মঞ্জুর করলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সে কথা মানবজাতির উদ্দেশে তুলে ধরলেন, ‘হে আমার রব! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন’। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০০) বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তায়ালা হজরত জাকারিয়া আ:-কে সৎপুত্রসন্তান দান করেছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পূতঃপবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা কবুলকারী।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৩৮)

আমরা আল্লাহর কাছে নিজের চাহিদামতো অনেক কিছু চাই, কিন্তু নেক সন্তান চাই না। যদিও তিনি আমাদের নিজ অনুগ্রহে এই নিয়ামতে ধন্য করেন তার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করি না। আমাদের প্রতি তার যে হক রয়েছে তা-ও আমি আদায় করি না। আমাদের দায়িত্বহীনতায় যে যখন খোদাদ্রোহী হয়ে যায়, কথা ও যুক্তিতে সে এমন সব মত প্রকাশ করে, যা আল্লাহ ও তার প্রিয় হাবিব সা:-এর বিপক্ষে চলে যায়, তখন তাকে নিয়ে আফসোস করতে থাকি। অনেকের এই আফসোসও জাগ্রত হয় না। আপনার মধ্যে এই অনুশোচনা আসুক আর নেই বা আসুক, আপনি অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন।

আর সময়ের অপেক্ষা নয়, বিবেককে জাগিয়ে তুলুন। সন্তানদের প্রয়োজনীয় দ্বীনি শিক্ষা দিন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করুন, মানুষ হিসেবে বিশেষ করে একজন মুসলমান হিসেবে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে শিখুক। সুশিক্ষা, চারিত্রিক মাধুর্য, দাওয়াতে ইলাল্লাহর দায়িত্বসহ আধুনিক ও ইসলামী জ্ঞানের সমন্বয়ে একজন তাকওয়াবান প্রকৃত মানুষে পরিণত করুন। এই সন্তান কখনোই আপনার অবাধ্য হবে না। কারণ সে পিতামাতার হক সম্পর্কে জানে। মানুষের মর্যাদা বোঝে। এসব দিক বিবেচনায় রাসূল সা: বলেছেন, ‘সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল কিয়ামতের ময়দানে প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার ঘরের অভিভাবক, তাকে তার অধীনে থাকা সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। মহিলা তার স্বামীর ঘরে একজন অভিভাবক, তার থেকে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে কৈফিয়ত নেয়া হবে।’ (বুখারি)

আপনি সন্তানকে মানুষ হওয়ার নসিহত করুন। পবিত্র কুরআনে দেখুন, লোকমান হেকিম তার সন্তানকে কত সুন্দরভাবে নসিহত করছেন- ‘হে বৎস, যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয় আর তা যদি পাথরের ভেতরে কিংবা আসমানগুলোয়ও লুকায়িত থাকে অথবা তা যদি থাকে জমিনের ভেতরে, তা-ও আল্লাহ কিয়ামতের দিন এনে হাজির করবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মদর্শী, সব বিষয়ে সম্যক অবগত।’ (সূরা লোকমান, আয়াত-১৬) দেখুন, সন্তানের ঈমান-আমল ও মানবিকতা উন্নয়নে কত সুন্দর কথা বলছে কুরআন। ‘হে বৎস, নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ করো আর বিপদ এলে সবর করো। নিশ্চয় এটি সাহসিকতার কাজ। আর অহঙ্কারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না, আল্লাহর জমিনে কখনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।... তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো, অবশ্যই আওয়াজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর হচ্ছে গাধার আওয়াজ।’ (সূরা লোকমান, আয়াত : ১৭-১৯)

আপনার সন্তানের কোমল হৃদয়ে এগুলো জায়গা করে দিতে পারলে সে অবশ্যই নেক সন্তান হবে। এই নেক সন্তান সম্পর্কে মহানবী সা: বলেছেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমলের সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি আমল তার জন্য খোলা থাকে। তা হলো- সাদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় আর নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম) ‘... আল্লøাহ জান্নাতে নেককার বান্দার মর্যাদা সমুন্নত করবেন, তখন জান্নাতি ব্যক্তি বলবে, হে আমার রব, কেন আমার জন্য এই উচ্চ মর্যাদা? তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমা প্রার্থনা করার কারণেই তোমার জন্য এই মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।’ (মুসনাদ আহমাদ)

লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement