০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মার্কিন কংগ্রেসে ইসরাইলের সমালোচনায় চিঠি

-

বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনের বৈধ অধিবাসীদের সরিয়ে দিয়ে তাদের অবৈধ কলোনি নির্মাণ করেই যাচ্ছে। আর তাকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন সরকারগুলো। আর এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প অনেকের চেয়ে খোলামেলা ভূমিকা পালন করছেন। অন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যেখানে রয়ে-সয়ে বা একটু কথার মারপ্যাচ রেখে ইসরাইলকে সমর্থন করেছেন, সেখানে ট্রাম্পের বুক আর মুখে কোনো ভিন্নতা নেই। দরাজকণ্ঠে তিনি ইসরাইলের প্রতি নিজের সমর্থন ব্যক্ত করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলোÑ প্রতিবেশী আরব দেশ কিংবা মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইউরোপিয়ান নেতাদের পক্ষ থেকে এর তেমন কোনো প্রতিবাদ আসেনি। বরং বছরের পর বছর ধরে তাদের পক্ষ থেকে নিরুত্তাপ যেসব বিবৃতি এসেছে, তা এতই আটপৌরে যে, ইসরাইল ও মার্কিন নেতারা তা আগে থেকেই বুঝতে পারেন এবং যথারীতি উপেক্ষা করেন।
বরং এ ক্ষেত্রে চমক হিসেবে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের পক্ষ থেকে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে লেখা একটি চিঠি। মিশিগানের নবীন কংগ্রেস সদস্য অ্যান্ডি লেভিনের পাঠানো ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন আরও ১০৬ জন কংগ্রেস সদস্য। এটা সত্য, লেভিনের চিঠিটি কোনো আইন নয় বা তার এই চিঠিতে মার্কিন নীতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না, তার পরও এ চিঠিটি আলোচনায় আসার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
এ চিঠিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑ এতে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইলের দখলদারিত্বের ব্যাপারে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন প্রয়োগের ব্যাপারটিতে ব্যাপক জোর দেয়া হয়েছে। মাইক পম্পেওকে পাঠানো ওই চিঠির তৃতীয় ও শেষ প্যারায় বলা হয়েছেÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ নম্বর ধারাকে লঙ্ঘন করছে। ওই ধারায় নিশ্চিত করা হয়েছে, ‘কোনো দখলদার গোষ্ঠী তার দখলকৃত জায়গার বেসামরিক লোকজনকে ওই অঞ্চল থেকে স্থানান্তর করতে বা নির্বাসন দিতে পারবে না।’ এ ক্ষেত্রে যদি যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে থাকে, তাহলে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য আরও বিশৃঙ্খল ও নির্মম একবিংশ শতাব্দীর শঙ্কাই করতে পারি।
মূলত এই প্রথমবারের মতো মার্কিন কংগ্রেসের যথেষ্ট সংখ্যক সদস্য ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের প্রায়োগিকতার বিষয়টি তুলে এনেছেন। এর আগে ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে এসব কনভেনশন লঙ্ঘনে ইসরাইলকে জবাবদিহি করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে রেজ্যুলেশন পাস করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র যেসব কারণে এ কনভেনশনকে মেনে নিতে অস্বীকার করে, তার মূল কারণ হলোÑ ইসরাইল ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নেয়ার বিষয়টিকে ‘দখল’ বলে মানতেই রাজি নয়। তাদের দাবি, এটা ফিলিস্তিনি ভূমি নয় বরং এটি একটি ‘বিতর্কিত’ ভূমি। এর সূত্র ধরেই ইসরাইল দীর্ঘ দিন ধরে এ কনভেনশন ফিলিস্তিনি ওই ভূমিগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে রাজি নয়। কারণ এটি যদি প্রয়োগ করা হয়, তা হলে ইসরাইল যেসব অপরাধে অপরাধী হবে, তার খতিয়ান বেশ দীর্ঘ। তাদের অপরাধের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল, ফিলিস্তিনিদের সম্পদ-বাড়িঘর ধ্বংস করা, ওইসব স্থানে নিজেদের নাগরিকদের জন্য কলোনি তৈরি করা, ওইস ব ভূমির খনিজসম্পদ চুরি করা, ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা ইত্যাদি। আর এর সাথে যুক্ত হবে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের অত্যাচার করা, শাস্তি দেয়া এবং অবৈধভাবে আটকে রাখার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন করার মতো গর্হিত অপরাধগুলোও।
ইসরাইল মূলত তাদের ওয়াশিংটন লবিস্টদের দিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে শুধু তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান বা পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালায় না, বরং তারা এদিকেও নজর রাখে যে, ফিলিস্তিনি জমির যেকোনো আলোচনায় যেন ‘দখলদার’ বা ‘দখলদারিত্ব’ শব্দ না থাকে। ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বার্নি স্যান্ডার্সের একটি কমিটির খসড়ায় ‘দখলদারিত্ব’ ও ‘কলোনি’ শব্দ দু’টি যুক্ত করার জন্য বেশ চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু ইসরাইলি লবির কারণে তাদের সে প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে কিছুটা নীতি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ইসরাইলের দখলদারিত্বের ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তারা পশ্চিম তীরে ইসরাইলি দখলদারিত্বের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নিন্দা জানিয়েছেন। এমনকি তারা বলেছেন, ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরাইলের আচরণের ওপরই তেলআবিবের প্রতি ওয়াশিংটনের সহায়তা কার্যক্রম নির্ভর করবে। আর গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে একটি বিল পাস হয়, যাতে ফিলিস্তিনের ‘রাষ্ট্র’ বিষয়টিকে সমর্থনের পাশাপাশি পশ্চিম তীরের যেকোনো স্থানে ইসরাইলি দখলদারিত্বের কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।
তবে তাদের এ প্রচেষ্টা ছিল অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ। অন্য দিকে লেভিনের চিঠিটি ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি দায়বদ্ধ করে তুলেছে। যেখানে ডেমোক্র্যাটদের পদক্ষেপগুলো ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর জুটির বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে পারে, সেখানে লেভিনের চিঠি এসবের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বরং ইসরাইলের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার আইন মেনে নেয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছে।
দেশটিতে লেভিনের চিঠিটির মতো আগেও এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার এ চিঠিতে যতখানি সমর্থন পাওয়া গেছে, তেমন সমর্থন আসেনি আর কখনও। আর এতে স্বাক্ষরকারী বা সমর্থনকারী যারা আছেন, তাদের মধ্যে যেমন প্রবীণ রাজনীতিকরা আছেন, তেমনি আছেন নবীন কংগ্রেস সদস্যরাও। এ ছাড়া আফ্রিকান-আমেরিকান, ল্যাটিন, আরব-আমেরিকান, আমেরিকান ইহুদিসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কংগ্রেস সদস্যরাও এতে সই করেছেন।
তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, লেভিনের এমন একটি প্রচেষ্টাকে স্রেফ উপেক্ষা করে গেছে বেশির ভাগ মার্কিন গণমাধ্যম। অবশ্য ইহুদি প্রভাবাধীন গণমাধ্যমে এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করাও ভুল। তবে ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে দিন দিন মার্কিন জনমত যে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং মাঝে মধ্যেই তার স্ফূরণ ঘটছে, এটাই আশার কথা। আর জুলুম নির্যাতনের মধ্যেও এভাবেই হয়তো মানবতাগুলো বেঁচে থাকে চিরকাল।


আরো সংবাদ



premium cement