২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উগ্রবাদ থেকে ফিরে তারা বললেন, ভুল করেছিলাম!

সঠিক পথে ফেরানোর কাজ চলছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
-

সিলেটের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রবাদী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরে যুক্ত হন শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪)। ২০০৯ সালে যোগ দেন আনসার আল ইসলামে। ২০১১ সালে মেডিক্যাল শিক্ষার্থী নুসরাত আলী জুহিকে (২৯) বিয়ে করেন। স্বামীর পথ ধরে নুসরাতও উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরে সংগঠনের নির্দেশনায় তারা ঢাকায় চলে আসেন। উগ্রবাদে জড়ানোয় শাওন ও নুসরাতের সাথে তাদের স্বজনদের দূরত্ব তৈরি হয়। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ভয়ে পারিবারিক জীবনে দানা বাঁধে অশান্তি। একপর্যায়ে তারা বুঝতে পারেন ভুল পথে হাঁটছেন। এভাবে বাঁচার কোনো মানেই হয় না। পরে র্যাবের সাথে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। শুধু শাওন আর নুসরাতই নয়, ভুল বুঝতে পেরে উগ্রবাদের পথ ছেড়ে সঠিক পথে ফিরতে আত্মসমর্পণ করেছেন আরো সাতজন। তারা হলেনÑ কুমিল্লার আবিদা জান্নাত আসমা (১৮), আবদুর রহমান সোহেল (২৮), চাঁদপুরের মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হাসান গাজী (২৩), মো: সাইফুল্লাহ (৩৭), ঝিনাইদহের মো: সাইফুল ইসলাম (৩১), চুয়াডাঙ্গার মো: আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬) ও মো: সাইদুর রহমান (২২)।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা আসমা বলেন, ২০১৯ সালে এসএসসি পাস করি। তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজনের সাথে জড়িয়ে বিয়ে করি এবং উগ্রবাদে জড়িয়ে যাই। উগ্রবাদে জড়িয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সে নিঃসঙ্গ জীবন অনেক কষ্টের ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ভুল করে এ পথে এসেছিলাম। ভুল বুঝতে পেরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করি এবং আশা করছি আমার স্বামীও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
শাওনের বাবা শওকতুর রহমান বলেন, আমি একজন ব্যাংকার ছিলাম। আমার ছেলে কিভাবে উগ্রবাদে জড়িয়েছে আমি তা জানি না। কান্নাকণ্ঠে তিনি আরো বলেন, কারো সন্তান যাতে এভাবে উগ্রবাদে না জড়ায় সবাইকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আসমার মা শাহিনা সুলতানা বলেন, আমার মেয়ে মেধাবী ছিল। সে অনেক কিছু করবে সমাজের, অনেক বড় অফিসার হবে; কিন্তু কিভাবে যে কী হয়েছে, জানি না। এখন আমার মেয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তাদের আত্মসমর্পণ উপলক্ষে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত ‘নব দিগন্তের পথে শীর্ষক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তারা। এ সময় মন্ত্রী ফিরে আসা নয়জনকে তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দেন এবং তাদের পুনর্বাসনে সহায়তা দেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ, র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ করা উগ্রবাদীদের মধ্যে ছয়জন জেএমবির এবং তিনজন আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শুধু জঙ্গিবাদ কঠোর হস্তে দমন করছি তাই নয়, পাশাপাশি ডির্যাডিকালাইজেশনের মাধ্যমে তাদের ভুল পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তাদের ট্রাক্টর, কৃষিজ উপকরণ, নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ কখনো জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কখনো বলি না জঙ্গিবাদকে মূলোৎপাটন করেছি। বলেছি জঙ্গিবাদকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। অনেক দেশ থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তোমরা কিভাবে জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করছো? আমি বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ কখনো জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না বলেই আমরা জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
৯ জঙ্গির আত্মসমর্পণের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা বিভ্রান্ত হয়েছিল, পথ হারিয়েছিল, যারা ভুল পথে ভুল আদর্শ বুকে নিয়েছিল তারা আজ বাবা-মার কাছে ফিরেছেন, বাবা মার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, যা অনেক দিন পর দেখছি। এ জন্য র্যাব অগ্রণী ভূমিকা রাখায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
আইজিপি বলেন, যারা এখনো জঙ্গিবাদের মতো ভুল পথে, তোমরা ফিরে এসো। কারণ ওই ককটেল, জর্দার কৌটা বা এ জাতীয় জিনিসপত্র দিয়ে তোমরা কারো বিরুদ্ধেই বিজয়ী হতে পারবে না। বরং ওই পথে গিয়ে তোমরা পরিবার-সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছো। বেঘোরে প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ অন্ধকার জগৎ তোমার নিজেকে, পরিবারকে ও রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলতে পারে।
সভাপতির বক্তব্যে র্যাবের ডিজি বলেন, যারা আজ সমাজের মূলধারায় ফেরার জন্য আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের এ সমাজ যেন আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। তুই জঙ্গি বলে যেন তাকে আবারো নেতিবাচক পথের দিকে ঠেলে দেয়া না হয়। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ একটা আদর্শিক সমস্যা, এটা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন সঠিক ধর্মীয় ব্যাখ্যা। তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে চাই। আত্মসমর্পণ করা নয়জনের মধ্যে আটজনই তাদের পরিবারের কাছে ফেরত যাবেন। একজনকে আইনের কাছে সোপর্দ করা হবে। আইনি কার্যক্রমের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে ফেরত যাবেন তিনি। র্যাব প্রধান বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা আভিযানিক কার্যক্রম আরো বেগবান করব। কোথাও জঙ্গিরা টিকে থাকতে পারবে না। তাই যারা পলাতক আছেন আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করুন।
র্যাব জানিয়েছে, আবিদা উগ্রবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পর পরিবারকে না জানিয়ে ২০১৮ সালে আনসার আল ইসলামের এক সদস্যকে বিয়ে করেন। পরে তিনি পরিচিতদের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছা জানান। সোহেল জেএমবির সদস্য ছিলেন। ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার উগ্রবাদী কার্যক্রম শুরু করেন। ফের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। মাদরাসাশিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ সহপাঠীর মাধ্যমে জেএমবিতে যুক্ত হন। তার কিছু সঙ্গী গ্রেফতার হলে তিনি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মোহাম্মদ হোসেন ২০১২ সালে ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। সাইফুল্লাহর মাধ্যমে তিনি জেএমবিতে যুক্ত হন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস সাইফুল শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় জেএমবিতে যোগ দেন। তিন নিজ এলাকা ঝিনাইদহে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালান। নিজেদের কয়েকজন সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তিনি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। মামুন ও সাইদুর উগ্রবাদের ভিডিও দেখে জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।


আরো সংবাদ



premium cement